হতাশ এক সাবেক সামরিক জেনারেলের সঙ্গে মিলে একটি পরিকল্পিত অভ্যুত্থান ঘটাতে ব্যর্থ হয়ে ভারতীয় ভাড়াটে সাংবাদিক সুবির ভৌমিক এবার সরাসরি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে টার্গেট করে এক প্রচারণা শুরু করেছেন। চাটুকারদের মাধ্যমে ভুয়া নিউজ পোর্টাল খুলে ভৌমিক সম্প্রতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বৈরি আক্রমণ জোরালো করেছেন। এর আগে তার বিশ্বস্ত কয়েক জন ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে নিয়েও অপপ্রচার চালানো হয়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষতি করার এবং তার ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয়কে হেয় করার চরম প্রচেষ্টা হিসেবে ভৌমিক ফটোশপ প্রযুক্তিরও সহায়তা নিয়েছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে শেখ হাসিনার একটি পোট্রেট। বিগত এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে পাকিস্তান সফরে যাননি শেখ হাসিনা। ইমরান খানের সম্ভাবনাময় প্রধানমন্ত্রীত্বের আমলে তো নয়ই। তারপরও ভৌমিক তার ইস্টার্নলিংক নামের ভুয়া পোর্টালে ইমরান খানের কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে চিত্রিত করেছে। সেখানকার দেওয়ালে জিন্নাহর একটি ছবিও টানানো দেখা গেছে।
ফটোশপকৃত সেই ছবি
ইন্ডিয়ান ইনসাইডার-এর একটি ডিজিটাল ফরেনসিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে জি৭ সম্মেলনের পার্শ্ববৈঠকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনঝো অ্যাবের সঙ্গে সাক্ষাতের একটি ছবি থেকে শেখ হাসিনার ছবিটি কেটে নিয়ে ইমরান খানের ছবিটির সঙ্গে জোড়া লাগানো হয়েছে। এ থেকেই দেখা যায় হাসিনাকে হেয় করতে কতদূর পর্যন্ত যেতে পারেন সুবির ভৌমিক। অন্যদিকে ইমরান খানের ছবিটি নেওয়া হয় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তোলা একটি ছবি থেকে।
যে দুই ছবি কেটে ওপরের ছবিটি বানানো হয়েছে
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মরিয়া বিষেধগারের অংশ হিসেবে সুবির ভৌমিক হাসিনার বিরুদ্ধে ‘পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব’করার পাশাপাশি তার দল ‘পাকিস্তানি গোষ্ঠীদের দখলে গেছে’ বলে অভিযোগ করেছেন। কেবল এই কারণে যে তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ১৫ মিনিট ফোনে কথা বলেছেন।
ভারতকে উসকে দেওয়ার এক অদ্ভূত চেষ্টা হিসেবে তার কথিত ‘হাসিনা চ্যালেঞ্জ’ (ভাবখানা এমন যে, হাসিনা ভারতের জন্য হুমকি) মোকাবিলায় দিল্লি কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে তা তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
হাসিনার বিরুদ্ধে সুবির ভৌমিকের ভারতকে উস্কে দেওয়ার অপচেষ্টা এটাই প্রথম নয়। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সুনির্দিষ্ট একটা অংশের কাছাকাছি যেতে তিনি বিএনপি’কে সহায়তা করেন। সেইসব অসৎ কর্মকর্তা ভারত সরকারের আনুষ্ঠানিক নীতির সঙ্গে সরাসরি বিরোধিতা করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে, নির্বাচনে জয় পেতে বিএনপির রণকৌশলকে সহায়তা দেয়। শেখ হাসিনা ২০১৭ সালে দীর্ঘদিনের চেপে রাখা ক্ষোভ উগড়ে দেওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে মিত্রদের কার্যক্রমকে বৈধতা দিতে কলাম লেখা শুরু করেন সুবির ভৌমিক।
আইএসআই সংশ্লিষ্ট ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন সুবির ভৌমিক। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী এই গোষ্ঠীটিকে বিএনপি সমর্থন দিয়ে সারা বিশ্বে তাদের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে সহায়তা করেছে। অন্যদিকে ভারতের অনুরোধে শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার কিছু দিনের মধ্যেই বাংলাদেশে পলাতক উলফা নেতাদের গ্রেফতার করে। আবার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর বাংলাদেশে সক্রিয় ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সব গোপনীয় অভয়াশ্রম নির্মূল করেছেন তিনি। সে কারণে খুবই স্বাভাবিক যে সুবির ভৌমিক সুযোগ পেলেই শেখ হাসিনার দিকে বন্দুক তাক করবেন।
২০১৭ সালের শেষ দিকে সুবির ভৌমিক একটি ঘৃণ্য তত্ব নিয়ে এগিয়ে আসেন। যাতে বলা হয় শেখ হাসিনাসহ ভিভিআইপিদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত স্পেশ্যাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) কিছু কর্মকর্তা তাকে হত্যা এবং সরকার উৎখাতের চেষ্টা করেছে। শেখ হাসিনাকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও এই বিরক্তিকর অসত্য ছড়াতে এবং আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মীদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য তিনি সতর্কভাবে নির্বাচনের আগের বছরকেই বেছে নেন।
পরবর্তীতে সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে ওই মিথ্যা ভাষ্যের বিপরীতে সত্য উন্মোচন করা হয়। সুবির ভৌমিক এমন একজন এসএফএফ কর্মকর্তাকে হত্যার গল্প ফেঁদেছিলেন, যিনি তখন লন্ডনে প্রধানমন্ত্রীর সামগ্রিক নিরাপত্তার অংশ হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
প্রতিবেদনের মাধ্যমে যে ভীতি তৈরি করা হয় তা উড়িয়ে দিতে প্রকাশ্য বিবৃতি দিতে বাধ্য হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ের (পিএমও) কর্মকর্তারা। তারপরও নিজের ফাঁদা গল্প প্রত্যাহার না করে সুবির ভৌমিকের উৎসাহ দ্বিগুণ হয়ে যায়, দাবি করেন পিএমও অফিসকে ওই বিবৃতি দিতে বাধ্য করেছে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা।
শেখ হাসিনার ইলাস্ট্রেশন: সাইদুল ইসলাম, ছবিসূত্র: মিডিয়াম.কম
দীর্ঘদিন থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারকে টার্গেট করে আসলেও সুবির ভৌমিক অবশ্য সতর্কতার সঙ্গে প্রকাশ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি আক্রমণ করা থেকে বিরত থেকেছেন। এমনকি তিনি হাসিনা সমর্থক হওয়ার আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ করেছেন। পাকিস্তানের আইএসআই’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখা সুবির সম্প্রতি লিখেছেন, ‘দেশের জন্য শেখ হাসিনা যা করেছেন সে জন্য তার প্রতি আমার বিপুল শ্রদ্ধা রয়েছে। তারপরও সেটি আমাকে আওয়ামী লীগের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা এবং তার সরকারের ব্যর্থতাগুলো পর্যালোচনা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।’
বর্তমানে প্রশাসনিক সক্ষমতার শীর্ষে রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শ্রদ্ধা পাচ্ছে আর এমনকি শেখ হাসিনার নির্দেশনায় দেশ হৃদয়গ্রাহী অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করছে। সীমিত সামর্থ্য নিয়ে অনেক উন্নত এবং প্রতিবেশি দেশের তুলনায় বেশ ভালোভাবে কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলা করেছে বাংলাদেশ। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামের মতো বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও কোনও সুযোগ পাচ্ছে না, যদিও বেশিরভাগ দুর্দশার জন্য তাদের নিজেদের কর্মফলই দায়ী। তারপরও সুবির ভৌমিক শেখ হাসিনার ‘ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা’ ও ‘ব্যর্থতা’ উৎপাদন করেছেন।
এক বা দুইবার নয় সুবির ভৌমিক বারবার শেখ হাসিনাকে স্বৈরশাসক হিসেবে চিত্রিত করতে চান। তার দাবি, মিসরের হোসনি মোবারকের মতো হাসিনাও একটি পুলিশি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। সুবিরের দাবি, হাসিনা উগ্রবাদীদের প্রতি নমনীয় এমনকী তাদের পৃষ্ঠপোষক। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে এবারে তিনি যা করেছেন সেটি আরও বেশি ভয়াবহ। কেবল সরকারকে অস্থিতিশীল এবং এর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিভক্তি তৈরির চেষ্টা করে নয়; এবার তিনি সীমা অতিক্রম করে শেখ হাসিনাকে উৎখাতের চেষ্টা করেছেন।
হতাশ সাবেক সামরিক জেনারেল হাসান সারওয়ার্দীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তিনি। শেষ দিকে হাসান পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থাটি দুনিয়ার অন্য যে কারও চেয়ে বেশি করে শেখ হাসিনার মৃত্যু কামনা করে।
শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশি গোয়েন্দা সংস্থা ওই ষড়যন্ত্র সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে দিয়েছে। আর যেহেতু ষড়যন্ত্রকারী সামরিক জেনারেলকে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে সেহেতু সুবির ভৌমিকের মুখোশটাও খুলে গেছে। স্পষ্টত হতাশ ভৌমিক এখন ছায়ার সঙ্গে টিকে থাকার অবাস্তব চেষ্টা চালাচ্ছেন আর আরও স্পষ্টভাবে শেখ হাসিনার ওপর আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সূত্র: মিডিয়াম.কম