লিখেছেন আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ
নকল অট্টালিকা বা দালান আমরা সবাই কম-বেশি দেখেছি, চলচ্চিত্রের পর্দায়, টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে কিংবা ঐতিহাসিক ঘটনার স্বারক হিসেবে। কিন্তু ব্যস্ত শহরের অভিজাত কোনো এলাকায় দেড়শো বছরের বেশি সময় ধরে নকল বাড়ি সাজিয়ে রাখাটা একটু অন্যরকমই বটে।
বিশ্বের বড় শহরগুলোর প্রায় সবগুলোতেই রয়েছে এমন নকল বাড়ি। কোনো ক্ষেত্রে বাড়িগুলো নির্মাণ করা হয়েছে বায়ু চলাচলের সুবিশাল পথের শূন্য গহ্বর সাধারণ মানুষের চোখের আড়ালে রাখতে, কোথাও হয়তো তৈরি করা হয়েছে বিশাল যন্ত্রদানবের আকৃতিকে আশেপাশের ঘরবাড়ির সাথে খাপ খাওয়াতে। আমাদের আজকের আলোচনা থাকবে এমন একটি নয়, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা দুটো বাড়িকে নিয়ে। ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনের অন্যতম এলাকায় সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা এই বাড়িগুলো দেখতে এতটাই ‘আসল’ যে রোজ সামনে দিয়ে পার হয়ে যাওয়া অনেক পথচারীও জানে না, এগুলো ডামি হাউজ বা নকল বাড়ি।
লিনস্টার গার্ডেন, পশ্চিম লন্ডনের অভিজাত এলাকাগুলোর একটি। হাইড পার্ক থেকে একটু সামনে এগোলে, বে’স ওয়াটার আর কুইন্স ওয়ে টিউব (পাতাল রেল) স্টেশন থেকে একেবারেই কাছে এই লিনস্টার গার্ডেন। ১৮৪০ সালের দিকে এই এলাকার গোড়াপত্তন ঘটে। সারবাঁধা একই গড়নের সুবিশাল সব অট্টালিকায় সাজানো পুরো এলাকাটি। এখানকার বেশিরভাগ বাড়ির সামনে রয়েছে ঝোলানো বারান্দা, সাদা প্লাস্টারের প্রলেপের উপর সূক্ষ্ম কারুকাজ, আর রয়েছে প্রাচীন বনেদী রাশভারি চেহারা। কালের বিবর্তনে পুরো এলাকা হয়ে উঠছে আগের চেয়েও দর্শনীয়, সেই সাথে পুরোনো এই বাড়িগুলোর বেশ কয়েকটিকে বর্তমানে হোটেলে পরিবর্তন করা হয়েছে।
লিনস্টার গার্ডেন ধরে চলতে থাকলেই দেখা মিলবে ২৩ আর ২৪ নম্বর দেওয়া বাড়ি দুটোর। প্রথমবার দেখলে হয়তো অসামাঞ্জস্য কিছুই চোখে পড়বে না। একটু গভীরভাবে সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে চোখে পড়বে কিছু পার্থক্য। প্রথমত, অন্যসব বাড়ির কাচের জানালা দিয়ে যেখানে অর্কিডের সারি কিংবা রান্নাঘরের আবছায়া চোখে পড়ে, সেখানে এই দুই বাড়ির জানালাগুলো ধূসর রঙে ঢাকা। অস্বচ্ছ কাচের বদলে কেন ধূসর রং করা থাকবে বিলাসবহুল কোনো অট্টালিকাতে! সেখানেই শেষ নয়। পায়ে হাঁটা পথ ধরে এই বাড়ি দুটোর সামনে এসে দাঁড়ালে চোখে পড়বে আরেকটি অসামাঞ্জস্য। দরজা যেখানে থাকবার কথা, সেখানে দরজা আছে অবশ্যই, কিন্তু অস্বস্তিকর ব্যপার হলো এতে কোনো হাতল নেই। চিঠি ফেলবার জন্যে আশেপাশের সব বাড়িতে ডাকবাক্স বসানো থাকলেও এই বিশেষ দুটো বাড়িতে নেই চিঠি ফেলার কোনো বাক্স। বাড়িগুলোর অদ্ভুত আচরণের মূল কারণ, এগুলো আসলে কোনো বাড়ি নয়, বাড়ির সামনের মুখোশ কেবল!
কোনোকালেই সেগুলো আসল বাড়ি ছিল না, এমনটাও কিন্তু নয়। লন্ডন শহরের আধুনিকায়ন আর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে ১৮৬৪ সালের দিকে পাতালরেল নির্মাণের বিল পাশ হয় তৎকালীন ব্রিটিশ সংসদে। সেসময়ের নির্মাণ কৌশল বর্তমান যুগের মতো সহজ আর উন্নত ছিল না। পাতালরেল নির্মাণের একমাত্র পদ্ধতি হিসেবে সেসময় গণ্য করা হতো ‘কাটো, বানাও, আর ঢেকে দাও’ ধরনের ধাপ। বিশ্বের প্রথম পাতালরেল ব্যবস্থা নির্মাণের জন্যে যে পথ বেছে নেয়া হয়েছিল, সেই পথের মাঝে পড়ে যায় ২৩ আর ২৪ নম্বর লিনস্টার গার্ডেনের বাড়ি দুটো।
সেই কারণে আসল বাড়ি দুটো ভেঙে এর নিচ দিয়ে তৈরি করা হয় পাতাল রেলের চলাচলের পথ। মূলত রেলের দীর্ঘ টানেলের ভেতরে বাতাস চলাচল নিশ্চিত করার জন্য এবং কয়লাচালিত রেল ইঞ্জিনের বিষাক্ত ধোঁয়া বের করে দেয়ার জন্যে বড় ফাঁকা অংশ রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। ফারিডন থেকে দক্ষিণ কেনসিংটন পর্যন্ত পাতালরেল নির্মাণের এই মহাযজ্ঞের ক্ষুদ্র বিসর্জন হয়ে যায় লিনস্টার গার্ডেনের বাড়ি দুটো।
কিন্তু এলাকাবাসী এবং মেট্রোপলিটন রেলওয়ে কো. (তৎকালীন সেই রেলপথের মালিক পক্ষ) এর মাঝে বাড়ি ভাঙা নিয়ে বিভেদের সৃষ্টি হয়। বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি লিনস্টার গার্ডেনে বসবাস করতেন এবং তাদের দাবি ছিল, ভাঙা বাড়ির শূন্য জায়গায় এমন কিছু তৈরি করা উচিত, যাতে এলাকার সৌন্দর্যে কোনো ক্ষতি সাধন না হয়, আবার একই সাথে রেললাইন তৈরিও বাধাপ্রাপ্ত না হয়। অবশেষে দুই পক্ষ সমঝোতায় আসে, রেল নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষ ২৩ এবং ২৪ নম্বর বাড়ির ফাঁকা অংশে নকল বাড়ি বা ডামি হাউজ তৈরি করে দেবে। যেগুলো দেখতে এর চারপাশের বাড়ির মতোই হবে, কিন্তু এর প্রস্থ হবে মাত্র ৫ ফুটের মতো। এতে দূর থেকে দেখে বোঝা যাবে না, এর নিচে রয়েছে পাতাল রেলের টানেল কিংবা টানেল থেকে বের হওয়া রেলগাড়ির ধোঁয়াও চোখে পড়বে না কারো।
১৮৬৮ সালে এই বাড়ির মুখোশ বা নকল বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হয়। ২৩ এবং ২৪ নম্বর বাড়ি দুটোর নির্মাণে দক্ষতার পরিচয় দেখা যায় সর্বত্র। একই রকমের ঝুলবারান্দা, মোটা কলাম, লম্বাটে জানালা আর রাশভারি ধাঁচের চেহারা রেখেই নির্মাণ করা হয় বাড়ি দুটো। শুধু তা-ই নয়, এই বাড়ি দুটোর দরজাগুলো পাশাপাশি রাখা হয়নি। ২৩ নম্বর বাড়ির দরজাটি তৈরি করা হয়েছে এর কাছ ঘেঁষা হোটেলের দরজার আদলে। আর ২৪ নম্বর বাড়িতে ব্যবহার করা রয়েছে দুই ভাগের সাদা একটি দরজা এবং উত্তর পাশে আলাদা একটি দরজা।
সময় নিয়ে সূক্ষ্মভাবে নকল বাড়িগুলো নির্মাণ করা হলেও পেছনের রেল টানেলের ফাঁকা অংশকে সেগুলো যে পুরোপুরি ঢেকে দিতে সক্ষম হয়েছে, তা কিন্তু নয়। কোনো পথচারী যদি নকল বাড়ির দেয়ালের ফাঁকা দিয়ে দেখার চেষ্টা করে কিংবা পেছনের রাস্তা দিয়ে ঘুরে এসে তাকায়, সেক্ষেত্রে অবশ্যই তারা পাতালরেলের টানেলের অংশ সহজেই দেখতে পাবে। সামনের মুখোশ সুন্দরভাবে তৈরি করা হলেও পেছন থেকে দেখলে নিরেট দেয়াল আর দুই পাশের ঠেস দেয়া ধাতবদণ্ড সহজেই চোখে পড়ে। নিচের দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যায়, রেলগাড়ি চলে যাওয়ার লাইন আর অর্ধবৃত্তাকৃতির রেলগাড়ির টানেল। এই রেল টানেল আর্লস কোর্ট থেকে এজওয়্যার রোড পর্যন্ত চলাচলকারী রেলগাড়ির চলাচলে ব্যবহৃত হয়।
নকল এই বাড়িগুলো নিয়ে প্রচলিত রয়েছে নানা ঘটনা। কিছু ক্ষেত্রে নকল বাড়ির বিষয় না জানা মানুষকে বিপাকে ফেলে অন্য কিছু মানুষ। যেমন- ২০০৯ সালে রিপোর্টে উঠে আসে যে, পিৎজা ডেলিভারির দোকানিরা প্রায়শই বিপাকে পড়েন নকল এই বাড়ি দুটোর নামে করা অর্ডার ডেলিভারি দিতে গিয়ে। অনেক সময় খাবার ছাড়াও আসবাব থেকে শুরু করে অনান্য অনলাইন ডেলিভারির দ্রব্যও এ ঠিকানায় অর্ডার করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিপাকে ফেলার অভিযোগ শোনা যায়।
নকল বাড়িকে পুঁজি করে অন্য মানুষকে বোকা বানানোর ঘটনা আধুনিক সময়েই হচ্ছে, এমনটাও কিন্তু নয়। ১৯৩০ সালে সান্ধ্যকালীন দাতব্য অনুষ্ঠানের নাম করে টিকেট বিক্রি করে একটি চক্র, যারা অনুষ্ঠানের ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করে এই নকল দুই বাড়িকে। বিশেষ সাজপোশাক পরে ছাদের উপরের বিশেষ সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে অতিথিরা আবিষ্কার করেন মূল ঘটনা। কিন্তু ততক্ষণে টিকিট বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া চক্র হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে নকল বাড়ির পেছনের অংশের মতোই।
অ্যান্ড্রিও মার্টিন নামের একজন লেখক ২০১৩ সালে প্রকাশিত তার বই ‘আন্ডার গ্রাউন্ড, ওভার গ্রাউন্ড’ এ উল্লেখ করেন, একই এলাকায় বাস করা অনেক প্রতিবেশীও আসলে জানে না আসল ঘটনা। সেই বইয়ে উল্লেখ করা হয়, নকল বাড়ির দু’পাশে থাকা হোটেলগুলোতে তিনি একবার দেখতে যান এবং দুই জায়গায় একই প্রশ্ন করেন, তাদের হোটেলের পাশের রহস্যময় এই নকল বাড়িগুলো কাদের বা এগুলোর মালিক কে? ১০ মিনিটের মাঝে দেখা যায়, দুই হোটেল পক্ষের মানুষ ২৩ এবং ২৪ নাম্বার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে একে অপরকে অবাক হয়ে বলছে যে, তারা জানতো, এটা প্রতিবেশী হোটেলের সম্পত্তি!
ইতিহাসের পাতায় বহু বছর ধরে নাম লেখানো এই রহস্যময় বাড়ি দুটো সাম্প্রতিক সময়ে অনেকের নজরে আসে বিবিসি নির্মিত বিখ্যাত টিভি সিরিজ ‘শার্লক’-এর ‘হিজ লাস্ট ভাও’ পর্বে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের কারণে। এ পর্বের বিশেষ রহস্য খোলাসা করতে বাড়িটিকে নকল চেহারার প্রতিকৃতি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল।
দেড়শো বছরেও বেশি পুরনো এই নকল বাড়িগুলো কিন্তু এখনও ভেঙে পড়েনি, মলিন হয়ে আশেপাশের অন্য বাড়িগুলো থেকে আলাদাও হয়ে যায়নি। লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড কর্তৃপক্ষ নিয়মিত দেখভাল করে সুন্দর আর উজ্জ্বল করে রাখে এই নকল বাড়ি দুটোকে।