লিখেছেন মোঃ ইয়াকুব আলী
ছবির শুরু এক হোস্টেলের ছাত্রদের মাঝরাতে একে অপরকে পানি মারার খেলা দিয়ে। তারা নিজেদের হলের মধ্যে একে অপরকে পানি মারা শেষ করে অন্য হলে গিয়ে হামলা করে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এভাবে সহপাঠীদের পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেয়া ছিল নির্মল আনন্দের উৎস।
পড়াশোনা করতে বিরক্ত লাগতে শুরু করলেই ছাত্র-ছাত্রীরা এমন অদ্ভুত সব কাজ করেই বিনোদনের ব্যবস্থা করত। এটা ছিল ছবির অন্যতম প্রধান চরিত্র আন্নির (অনিরুদ্ধ পাঠক – সুশান্ত সিং রাজপুত) স্মৃতি। এরপরই দেখা যায় আন্নির বর্তমান জীবন।
এক কোম্পানির উচ্চপদে কর্মরত আন্নি। বিয়ে করেছিলেন একসময়ের সহপাঠিকে (মায়া – শ্রদ্ধা কাপুর)। তাদের আছে এক সন্তান (রাঘব পাঠক – মোহাম্মদ সামাদ)। ইতোমধ্যেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। আর ছেলের কাস্টডি পেয়েছে আন্নি। সেই ছেলে বড় হয়ে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলের অপেক্ষায় আছে, তাই তার মাথায় সারাক্ষণই ফলাফল কী হবে সেটা ঘুরপাক খায়। এমনকি মাঝরাত্রে বন্ধুদেরকে ফোন দিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তুলেও সে জিজ্ঞেস করে ফলাফল কেমন হতে পারে, কার কোন বিষয়টি ভালো হয়েছে। তার মাথায় সারাক্ষণই ঘুরপাক খায়- যদি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় তার চান্স না হয় তাহলে পরিস্থিতি কী হবে, কারণ তার বাবা-মা দুজনই ছিল টপার। এটাও তার মনোজগতে বাড়তি চাপ তৈরি করে। তার মাথায় সবসময়ই ঘুরতে থাকে- টপার বাবা-মায়ের সন্তান হয়ে চান্স না পেলে সবাই থাকে লুজার বলে সারাজীবন ক্ষেপাবে।
একসময় সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হয়। ছেলের বন্ধু ফলাফল দেখে, কারণ ছেলে অনেক দুশ্চিন্তার কারণে নিজে দেখতে ভয় পাচ্ছিল। ছেলের বন্ধু ফলাফল দেখে কম্পিউটারের মনিটরটা ছেলের দিকে ঘুরিয়ে দেয়, যেখানে লাল কালি দিয়ে লেখা উঠে আছে “বেটার লাক নেক্সট টাইম।” এরপর কম্পিউটারটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে আবারও সে নিজে ফলাফল দেখে এবং সেবারই কম্পিউটারের পর্দায় একই কথা ভেসে উঠে। এই লাল কালির কথাগুলো যেন বিদ্রুপ করে জানিয়ে দেয়, তুমি এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশ করার যোগ্য নও। যখন ফলাফল দিয়েছে তখন তার বাবা-মা দুজনেই তাদের অফিসে ব্যস্ত। মা ফলাফলের খবর শুনে রওয়ানা দিলেও বাবা আটকে যায় মিটিংয়ের কারণে। এদিকে ছেলে তার বন্ধুর সাথে আলাপ করতে করতে বহুতল বাসভবনের বারান্দায় চলে আসে একসময়। তার বারবারই মনে হতে থাকে, সবাই এখন তাকে কী বলবে? আর তখনই সে নিয়ে নেয় এক জীবন সংহারী সিদ্ধান্ত। বারান্দা থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে।
এরপর তাকে দ্রুতই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, করা হয় অপারেশন। ডাক্তার জানান, এমন অবস্থা থেকেও মানুষকে তিনি বেঁচে ফিরতে দেখেছেন, কিন্তু তাদের ছেলের ঘটনা উল্টো। সে নিজেই বাঁচতে চাইছে না। তার মধ্যে বাঁচার কোনো ইচ্ছেই নেই। তখন ছেলের মধ্যে কীভাবে বাঁচার ইচ্ছে ফিরিয়ে আনা যায় সেটা নিয়ে ভাবতে থাকেন আন্নি। তখনই তার মনে বেজে ওঠে তার বন্ধুকে বলা ছেলের শেষ বাক্যটা যে, তাকে সারাজীবন লুজার ট্যাগ নিয়ে বাঁচতে হবে।
তখনই মায়ের মাথায় আসে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা। তারা যে হোস্টেলে থাকত সেটা ছিল সবচেয়ে খারাপ হল। তাই তাদেরকেও সারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই লুজার বলেই ডাকত। পুরোনো এক ফটো অ্যালবাম খুঁজে পায় সে। তারপর সে ছেলের আইসিইউতে ঢুকে সেই অ্যালবাম খুলে বলতে শুরু করে তাদের গল্প, লুজারদের গল্প।
গল্পগুলো শোনার পর তার ছেলের জ্ঞান ফিরে আসলেও অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না, কারণ সে গল্পগুলোকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না। তখন মা চিন্তা করে, যদি তার হোস্টেল জীবনের সব বন্ধুকে হাজির করতে পারে, তাহলে তার ছেলে হয়তো গল্পগুলোকে বিশ্বাস করবে। এরপর একে একে সব বন্ধু হাজির হয়ে যায়। চলতে থাকে তাদের গল্প বলা।
এই গল্পগুলো সবারই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের গল্প, বিশেষ করে যারা হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছে। নানা হাস্যরসে ছবির গল্প এগিয়ে যেতে থাকে। তাদের হোস্টেলকে লুজার বলার অন্যতম কারণ তারা সবসময়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সবার শেষে আসত। তাই আন্নি এবং তার বন্ধুরা মিলে পণ করে, তারা যতদিন চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে না ততদিন তাদের সবচেয়ে পছন্দের কাজ করবে না। এতে করে তারা ফলও পায় হাতেনাতে। শেষ দিনে ফলাফল এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায় যে প্রতিযোগিতার প্রতিবারের চ্যাম্পিয়ন হোস্টেল থ্রির সাথে তাদের তিন ম্যাচ বাকি থাকে। আর সেই তিনটিতেই তাদের জিততে হবে। শুধু তাহলেই কেবল তাদের পক্ষে চ্যাম্পিয়ন হওয়া সম্ভব।
অন্যান্য ছবিতে দেখানো হয় বিভিন্ন ক্লাইমেক্সের মাধ্যমে শেষ দৃশ্যে নায়ক, নায়িকা বা তাদের বন্ধুরা জয়লাভ করে। কিন্তু এখানে দেখানো হয় তার ব্যতিক্রম। এখানে দেখানো হয় আন্নি এবং তাদের বন্ধুদের শত চেষ্টা সত্ত্বেও শেষ প্রতিযোগিতা বাস্কেটবলে তারা হোস্টেল থ্রির কাছে হেরে যায়, সেই সাথে হাতছাড়া হয়ে যায় তাদের জেনারেল চ্যাম্পিয়নশিপ।
এই গল্প শোনার পর অন্নির ছেলে বলে, নিশ্চয়ই তখন তোমাদের মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল। তখন আন্নি এবং তার বন্ধুরা এক এক করে বলেন, “না“, কারণ এরপর তাদেরকে আর কেউ লুজার বলতো না, সবাই বলতো ফাইটার। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় শেষ অপারেশনের জন্য। একেবারে শেষ দৃশ্যে দেখানো হয়, আন্নির ছেলে এক কলেজে ভর্তি হয়ে হোস্টেলে যাচ্ছে। সেখানে একজন সিনিয়র তাকে জিজ্ঞেস করছে, “কী রে ফ্রেশি, জীবনে লেখাপড়া ছাড়া কি আর কিছু করেছিস?“
এই ছবিতে একইসাথে অনেকগুলো বিষয় উঠে এসেছে হাস্যরসের মাধ্যমে। এখনকার যুগে ছেলেমেয়েরা ঠিক কতটা চাপের মধ্যে বড় হয়? এন্ট্রান্স পরীক্ষার জন্য দশ লক্ষ পরীক্ষার্থী বসলেও সুযোগ পায় মাত্র দশ হাজার। সবাই সেই দশ হাজারের সফলতার গল্প বলে, কিন্তু বাকি অকৃতকার্য নয় লক্ষ নব্বই হাজারের গল্প কেউ বলে না। পাশাপাশি বাবা-মা যদি তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে টপার হন, তাহলে বাচ্চার উপর চাপ আরো বেড়ে যায় পরীক্ষার ভালো ফল করার জন্য। একটি বাচ্চাকে ভালোভাবে বড় করে তোলার জন্য বাবা-মা দুজনেরই স্নেহের প্রয়োজন। বাবা-মা আলাদা থাকলে সন্তান একদিকে যেমন তাদের আদর-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়, তেমনই দুঃখের সময়গুলো তৎক্ষণাৎ তাদের সাথে শেয়ারও করতে পারে না। আর তখনই তারা একেকটা জীবন সংহারী পদক্ষেপ নেয়।
‘ছিচোরে‘ ছবিতে একইসাথে বিনোদনের সকল উপকরণ থাকলেও যে বিষয়ে ফোকাস করা হয়েছে সেটা হলো বর্তমান প্রতিযোগিতার বিশ্বে আমরা সবাই একেকজন প্রতিযোগী। আমাদের ইচ্ছে না থাকলেও আমাদের প্রাত্যহিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে যাচ্ছি। এর অন্যতম আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষা বা ভালো কাজ। সেটা নিশ্চিত করতে গিয়ে আমরা তাদের উপর যে চাপ প্রয়োগ করছি তাতে একদিকে যেমন তাদের আত্মবিশ্বাস নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে অন্যের সাথে নিজের তুলনায় তারা সবসময় হীনম্মন্যতায় ভুগছে।
যদি কোনোভাবে ভালো করেও ফেলে, তাহলেও কিন্তু চাকরির নিশ্চয়তা নেই। সেখানেও লেখাপড়ার মতো একইরকম প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। আর এটাই এখনকার জীবনযাত্রা। ওদিকে অভিভাবকেরা এমন ভাব করেন যেন সামান্য একটা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার মানে হচ্ছে সারা জীবনের জন্য অকৃতকার্য হওয়া। কিন্তু মানুষের জীবন অনেক বড়। একজন শিশুর শৈশবের সামান্য অকৃতকার্যতা ভবিষ্যতে তার জীবনে হয়তো কোনো প্রভাবই ফেলবে না। এমন উদাহরণ আমাদের চারপাশে ভুরিভুরি, তবুও অভিভাবকেরা শিক্ষা নেন না। তারা এমন ভাব করতে থাকেন যেন তাদের সন্তানের চেয়ে পরীক্ষার ভালো ফলটাই তাদের কাছে মুখ্য। আর এটা করতে গিয়েই আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, জীবন জীবনের মতোই চলতে থাকবে। আর সেই জীবনের ভাষা হচ্ছে বেঁচে থাকা।