মুহসিন আল জাবির
গত বছর হজের আগ মুহূর্তে একজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। গর্বের সঙ্গে বলছিলেন, এবার নাকি ৩০তম হজে যাচ্ছেন তিনি। লোকটিকে আগে থেকেই জানতাম। সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। ঘুষের টাকায় সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
এসব কালো মানুষের কালো টাকায় হজ করতে অবশ্য সৌদি সরকারের কোনো সমস্যা নেই। কালো টাকা দিয়ে হজ করলেও হাজী; আবার সাদা টাকা দিয়ে হজ করলেও হাজী। প্রতি বছর তিন-চারবার ওমরাহ করেন এমন মানুষের সংখ্যা আমাদের দেশে কম নয়। অনেকে ‘আলহাজ’ হওয়ার জন্যও বছরে বছরে হজ করেন। কেন যেন সব ইবাদতের চেয়ে হজ অনেক বেশি লোক দেখানো ইবাদতে পরিণত হয়ে গেছে। লোক দেখানো হজে লাভ হয় সৌদি সরকারের।
গরিব দেশের টাকা চলে যায় সৌদি বাদশাহর হেরেম পর্যন্ত। হজের টাকায় সৌদি রাজারা বহু রকম ফূর্তি করে, ক্যাসিনোতে জুয়ার আসর বসায়- এগুলো আজ প্রমাণিত সত্য। কাবা শরিফের চার পাশে যেসব বড় বড় হোটেল দেখা যায়- সেগুলোয় কী হয় আপনি ধারণাও করতে পারবেন না? ডিস-টিভি থেকে শুরু করে সব তো আছেই; নাচ-গানও হয় সেখানে। বানিয়ে বা বাড়িয়ে বলছি না- আমার হাজী বন্ধু এবং সৌদি প্রবাসী আত্মীয়দের মুখ থেকে শোনা কথা এগুলো।
আমাদের দেশে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা বড় বড় শিল্প-প্রতিষ্ঠানের মালিক। তাদের প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার শ্রমিক-মজুর কাজ করে। কিন্তু তারা শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি পরিশোধ করেন না। অধীনস্থদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তারাই আবার প্রতিবছর হজে যাচ্ছেন বেশ ঢাকঢোল পিটিয়েই।
অথচ বারবার নফল হজ না করে শ্রমিকের অধিকার আদায় করা বেশি জরুরি। দেশের অসহায় বঞ্চিত মানুষের সেবায় অর্থ বিনিয়োগ করা নফল হজের চেয়েও অনেক বেশি গুরুপূর্ণ ইবাদত। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘শেষ যুগে মানুষ বারবার হজ করবে। তারা প্রচুর সম্পদের মালিক হবে। কিন্তু দরিদ্র প্রতিবেশীর খারাপ অবস্থা নিয়ে তারা কিছুই ভাববে না।’ এখন তো সে অবস্থাই দেখতে পাচ্ছি। বেশিরভাগ বিত্তশালীই প্রতি বছর হজে যাচ্ছে। অথচ তার এলাকার মানুষ ক্ষুধার্ত, দরিদ্র ও অসহায় জীবনযাপন করছে। বারবার হজ না করে তার উচিত ছিল সমাজের অনাথ-অসহায়, ক্ষুধার্ত ও বিধবাদের সুব্যবস্থা করা। মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করা।
পুরো দুনিয়া আজ করোনায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। মধ্যবিত্তরা রাস্তায় বসে গেছে। নিুবিত্তরা করোনায় মারা যাওয়ার আগেই না খেয়ে মারা যাচ্ছে। এ সংকটময় সময়ে সমাজের বিত্তবানরা যেভাবে এগিয়ে আসার কথা ছিল সেভাবে তো আসতে দেখিনি।
প্রতি বছর এ দেশের লাখ লাখ মুসলমান নফল হজ ও ওমরা পালন না করে- তারা যদি হজের পরিমাণ অর্থটুকুও দারিদ্র্য বিমোচনে উদ্দেশ্যে খরচ করত অথবা কোনো মানব কল্যাণ ফান্ডে দান করত, তাহলে বাংলাদেশ ধনী ও উন্নত দেশ হিসেবে আরও আগেই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারত। পাকিস্তানের চিফ জাস্টিস মুফতি মুহাম্মদ তাকি উসমানি এক আলোচনায় বলেন, হজ জীবনে একবার ফরজ হয়। এ ফরজ আদায়ের পর দ্বিতীয়বার হজ করা ফরজ নয়, নফল। তাই প্রত্যেক বছর হজে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। বরং প্রত্যেক বছর গেলে ভিড় বেশি হয় এবং এতে অন্যদের কষ্ট হয়।’
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) প্রতি বছর হজ করতেন। একবার তিনি হজে যাচ্ছিলেন। পথে দেখতে পেলেন, একটি শিশু ময়লার স্তূপ থেকে একটা মরা মুরগি নিয়ে যাচ্ছে। তিনি শিশুটিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এই মরা মুরগিটি কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? শিশুটি বলল, তার ঘরে খাবার নেই। কয়েকদিন ধরে তারা এবং পুরো এলাকার মানুষ না খেয়ে কাটাচ্ছে। ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে তারা এখন মরা মুরগি খাবে বলে ঠিক করেছে।
এ কথা শুনে আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক সঙ্গে সঙ্গে তার কাফেলার সবার হজের খরচ দিয়ে ওই এলাকার লোকদের খাবারের ব্যবস্থা করে দিলেন। ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যারা হজের টাকা অসহায়দের দান করে দিয়েছিলেন। কয়দিন আগেও কাশ্মীরের খালেদা নামের এক নারী তার জমানো হজের টাকা করোনাক্রান্ত অসহায় মানুষের সাহায্যে দান করে দিয়েছেন। ফতোয়ার কিতাবে আছে, কেউ যদি হজের টাকা গরিব-অসহায়দের দান করে দেয়, এতে করে তার হজের সামর্থ্য শেষ হয়ে যায়, তাহলেও সে গুনাহগার হবে না। বরং দানের জন্য অশেষ সওয়াব পাবেন।
বছরে বছরে যারা হজ ওমরা করতে ছুটত, আজ তাদের দুয়ারে ভিন্ন এক হজ করার সুযোগ এসেছে। মানুষ না খেয়ে মরছে, চিকিৎসা না পেয়ে মরছে, কর্মের অভাবে যুবকরা আত্মহত্যা করছে- বিত্তবানরা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে অর্থ নিয়ে, পরিশ্রম নিয়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। এ মহামারীর কঠিন সময়ে আপনার চারপাশের মানুষজন কেমন আছে? আত্মীয়স্বজন-প্রতিবেশী কী খাচ্ছে? তাদের শিশুরা কেন কাঁদছে- এসব খোঁজ নেয়াও ফরজ ও ওয়াজিবে অন্তর্ভুক্ত।
এদের খোঁজ না নিলে আপনি রাসূল (সা.)-এর ঘোষণামতে পরিপূর্ণ ইমানদার হতে পারবেন না। হজ শব্দের অর্থ- ইচ্ছা করা, সংকল্প করা। আপনার এবারের ইচ্ছা হোক অনাহারির মুখে খাবার তুলে দেয়া; এবারের সংকল্প হোক অভাবীর মুখে হাসি ফুটানো! আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক : মুফতি, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, গবেষক এবং ইসলামী ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত কোরআন বিশ্বকোষ-সিরাত বিশ্বকোষসহ বহু ধর্মীয় গ্রন্থপ্রণেতা