বাবার গৃহে আমি ছিলাম খুবই আদুরে মেয়ে । আমার কোনো চাওয়াই অপূর্ণ থাকত না । পাঁচ ভাইয়ের একটি মাত্র বোন বলে আমার স্নেহ – ভালোবাসা ও আদর – যত্নেও কোনো ত্রুটি হতো না।
❑ সবাই আমার প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখত । আমার সকল আবদার পরিবারের সকলে বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিত । আর আমার চেতনার পুরােটা জুড়েই ছিল পড়ালেখা । লেখাপড়া ছাড়া অন্য কোনো দিকে মনোযোগ দিতে আমি মোটেও রাজি হতাম না । আর এতে আমার সাফল্যও ছিল বেশ ঈর্ষণীয় । তাই সকলের কৌতূহলী দৃষ্টি আমাকে অনুক্ষণ ঘিরে রাখত এবং সবাই আমাকে একটু কাছে পেতে উদগ্রীব থাকত । আমার সময়গুলো বরাবরের মতো বেশ ভালোই কাটছিল । সময়ের পরিক্রমায় আমি মাধ্যমিক স্তরে উত্তীর্ণ হলাম ।
❑ একদিন মায়ের দেওয়া একটি সংবাদে প্রথম বারের মতো কাঁপুনি ধরল আমার হৃদয়ে । তিনি বললেন , অমুক তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে । তখন আমি কিছুটা আশ্চর্য ও অহংকার – মাখা স্বরে বললাম , পরিবারের লোকেরা কি আমাকে নিয়ে তামাশা করছে !? এই যে প্রস্তাব আসা শুরু হলো — এর পর থেকে এত ঘন ঘন প্রস্তাব আসতে লাগল যে , আমার অন্য বান্ধবীদের সবার মিলেও বোধহয় এত প্রস্তাব আসত না । একবার তো এক বান্ধবীকে গোপনে বলেই ফেললাম , মনে হচ্ছে আমাদের শহরের সব যুবকই আমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে , কেউ আর বাকি থাকবে না ।
❑ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণ করা পর্যন্ত প্রস্তাব আসার এই ধারা অব্যাহত থাকল । তবে এ ক্ষেত্রে প্রস্তাবের ধরনে কিছুটা পরিবর্তন এল । আমি সর্বদা একই প্রশ্ন করতাম , ছেলের যোগ্যতা কী ? তার মধ্যে কী কী গুণ আছে ? আমি তোমাদের কাছ থেকে কিছুই লুকাব না । বিভিন্ন গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তরুণেরা , বিচিত্র সব পেশার যুবকেরা এবং সম্রান্ত পরিবারের ছেলেরা আমার পরিবারের কাছে সম্বন্ধ পাঠাত । বরং আমি তাে এই পর্যন্ত বলব ,
একবার ‘
❑ আব্দুল্লাহ নামের অসাধারণ এক যুবক বিয়ের প্রস্তাব দেয় , যে জ্ঞানে – গুণে এতটা সমৃদ্ধ ছিল যে , আর দশজন পুরুষ মিলেও তার কাছে ঘেঁষতে পারবে না । তবুও আমি তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলাম । কারণ , আমি সুন্দরী , আমি মেধাবী — আমার একটা অবস্থান আছে । পড়ালেখার পাট চুকিয়ে যখন কর্মজীবনে পা রাখলাম , সম্বন্ধ আসর ধারা । আরও বেড়ে গেল। তবে এতে কিছুটা পরিবর্তন দেখা গেল । যারা প্রস্তাব নিয়ে আসছে তাদের বয়স খানিকটা বেশি — ত্রিশের আশেপাশে ! যদিও আমার অন্তরে বিপদঘণ্টা বেজেই চলছিল , কিন্তু আজকের আগে কখনােই তা আমি শুনতে পাইনি ।
❑ সময় তার গতিতে বয়ে চলছে । এরই মধ্যে এমন একটি প্রস্তাব এল , যা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয় । জানো , সেটা কী ? এমন এক লােক প্রস্তাব নিয়ে আসে , যে তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে এবং তার একটি সন্তান আছে । এরূপ প্রস্তাব পেয়ে প্রথমে বড় একটা ধাক্কা খেলাম । পরক্ষণেই বললাম , বেচারি ! আমার অবস্থা জানে না , আমি কে ? তার জন্য আমার এক ধরনের করুণা হলাে ।
❑ দিন যায় , সপ্তাহ গড়ায় , মাস ফুরায় , এদিকে আমার বয়সও বাড়তে থাকে । কিন্তু সেদিকে আমার কোনাে খেয়াল নেই । আমি আমার কাজে নিমগ্ন । বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে একদিকে আমার দৈহিক লাবণ্য ও কমনীয়তা কমতে থাকে ; অপরদিকে ক্রমশ বড় হতে থাকে আমার কাজের চাপ ও দায়িত্বের পরিধি , চিন্তা – ভাবনায়ও আসতে থাকে বড় ধরনের পরিবর্তন । আমি সকলের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে থাকি আর আব্দুল্লাহর মতাে এক তরুণের প্রস্তাব পাওয়ার আশায় অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষার প্রহর গুনি ।
❑ কিন্তু আমার আশায় গুড়ে বালি ! প্রবাদ আছে , পাখি উড়ে গেছে । তার খাবার নিয়ে । আব্দুল্লাহ এখন চার সন্তানের বাবা আর আমি বেচারা এখনও কুমারী বুড়ি আমি আমি গেল আমার বয়স এখন ত্রিশ ছুঁইছুঁই । আশঙ্কাগুলো ঘনীভূত হয়ে আসছে ক্রমশ ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে উঠছে জীবন ! এই তো আমার বান্ধবী ফাতিমা , সে এখন চার সন্তানের মা । অপর বান্ধবীর কোলজুড়ে চাদের মতো ফুটফুটে দুটি মেয়ে । আরেক বান্ধবী স্বামীকে নিয়ে কী যে সুখে দিন । কাটাচ্ছে ! অথচ , তাদের আর্থিক অবস্থা নিতান্তই সাধারণ । আর আমি ….!
❑ আমি নির্ঝঞ্ঝাট আরামে দিনাতিপাত করছি । আসলে আমি আত্মপ্রবঞ্চনায় ভুগছি ; নিজের সাথে মিথ্যে বলছি । সত্যিই কি আমি সুখে আছি ? বিশাল জনতার ভিড়ে এক অদ্ভুত নির্জনতা আমায় ছেকে ধরেছে । আমার বয়সের সকল মেয়েই তো একাধিক সন্তানের মা — তারা আদরের সন্তানদের সাথে হাসাহাসি করছে , মধুর স্বরে তাদের সম্বোধন করছে । এদিকে আমার চারপাশে বিচিত্র সব ফিতনা ও পরীক্ষা এসে ভিড় জমাচ্ছে , আমাকে গ্রাস করে ফেলার উপক্রম করছে । কিন্তু আল্লাহ তাআলা আমাকে অশ্লীল ও নির্লজ্জ কাজ থেকে হিফাজত করেছেন । হয়তো এটি আমার মা বাবার দুআ ও সু’নজরের বরকতে হয়েছে ।
একদিন আমি অফিস থেকে ফিরলাম । এরই মধ্যে আমার তীক্ষ মেধা ও কঠিন অধ্যবসায় কর্মক্ষেত্রে আমাকে পৌঁছে দিয়েছে সাফল্যের সর্বোচ্চ স্তরে । কিন্তু এই সফলতা আমার কাছে অর্থহীন মনে হয় । আমি কাজ থেকে বাসায় ফিরে দেখি , মা আমার উদ্দেশে একটি চিরকুট লিখে আমার বালিশের ওপর রেখে দিয়েছেন । তাতে লেখা , “ মেয়ে আমার , অমুক তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে । সে ভালো চাকুরি করে আর তার বয়সও কম । আশা করি , তুমি সায় দেবে যদিও তার অন্য এক স্ত্রী ও ছয়জন সন্তান রয়েছে । দিন কিন্তু চলে যাচ্ছে । বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করে আমাকে জানাও ।
❑ আমি চিরকুটটা গভীর মনোযোগে পড়লাম এবং রাগে ফেটে পড়লাম । আমি মাথার চুলের দিকে তাকালাম । মাঝে মাঝে সাদা হয়ে ওঠা চুলগুলাে লুকাতে এরই মধ্যে আমি কলপ লাগাতে শুরু করেছি । ভাবতে ভাবতে কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি । শেষ পর্যন্ত এমন একজন লােকও আমাকে প্রস্তাব দিল !? আমার ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেল । রেগেমেগে সেই সন্ধ্যায় আমি বাবার কাছে গেলাম । তাকে বললাম , কীভাবে আপনারা এমন একজন মানুষের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন যার ছয়টা সন্তান আছে ? আমার পিতার উত্তরটি আমার অন্তরে ধারালো ছুরির মতাে বিদ্ধ হলাো ।
❑ কয়েক মাসে আমাদের কাছে এমন বিবাহিতরা ছাড়া, অন্য কেউ প্রস্তাব নিয়ে আসেনি । আমার ভয় হয় কিছুদিন পর হয়তো এমন সময় আসবে , যখন প্রস্তাব আসাই বন্ধ হয়ে যাবে । মেয়ে আমার , মুরব্বিরা একটা কথা বলতেন , মেয়েরা গাোলাপের মতাে ছিড়তে দেরি করলে এর পাপড়িগুলাে ক্রমশ শুকিয়ে আসে । আমার মনে হয় , তুমিও এই পর্যায়ে পৌছে গেছ।
মেয়ে , তোমার কাছে তো শত শত প্রস্তাব এসেছিল , তুমি একটা একটা করে সবগুলোকেই প্রত্যাখ্যান করেছ । ও বেশি লম্বা , সে বেশি খাটো , ওর এই দোষ , অমুকের এই সমস্যা ! আর এখন … ? এমন সময় এসেছে , তুমি আর কাউকেই পাচ্ছ না … !
পরের দিন মাগরিবের পর আমি মা – বাবার সাথে কিছুক্ষণ বসলাম । লক্ষ করলাম , তারা আমার দিকে স্নেহ ও ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন । আমি একজন বয়স্ক কুমারী মেয়ে — যে বিয়ের ট্রেন ফেল করেছে । অথচ , ট্রেন তার চোখের সামনে দিয়েই তার সমবয়স্ক বান্ধবীদের নিয়ে চলে গেছে । ভাবতে ভাবতে আমি কেঁদে ফেললাম । আব্বুকে বললাম , ইস ! আপনি যদি বিষয়টি সামাল দিতেন ! তিনি বললেন , কীভাবে ? আমি বললাম , আপনি যদি আমার হাত ধরে আপনার পছন্দের পাত্রের হাতে আমাকে তুলে দিতেন ! আপনি কি আব্দুল্লাহকে পছন্দ করতেন না , তার প্রশংসা কি আপনি করতেন না ? আপনি কি আপনার খালাতো ভাইকে পছন্দ করতেন । , তার প্রশংসা করতেন না ?
❑ আব্বু , আপনি যদি তখন এমনটি করতেন , আমি এখন আপনাকে তিরস্কার করতাম না । হায় , আপনি যদি এর জন্য আমাকে প্রহার করতেন !! বলতে বলতে আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম । এখন আর কোনাে যুবকই আমার কাছে প্রস্তাব নিয়ে আসে না । না লম্বা , না খাটো ; না ধনী , না দরিদ্র — কেউ আসে না । কল্পনার কোনাে রাজপুত্র কিংবা স্বপ্নের কোনাে নায়ক । কারও দেখা মিলে না । অর্থহীন প্রতীক্ষার বিদঘুটে আফসোসগুলো ঘনীভূত হচ্ছে ক্রমশ । হৃদয়জুড়ে অনুতাপের হাহাকার । জীবনের এই তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলাে তুলে ধরলাম আমার মতাে বোনদের কল্যাণের জন্য । আমি চাই না , আমার মতাে করুণ পরিণতি আর কোনাে বোনের হােক …।
সুত্র : ইয়া আবি ! জাওয়্যিজনি।