লিখেছেন ড: মোহম্মদ মাহবুব চৌধুরী, মন্ট্রিয়ল থেকে
মাইজদির আইসক্রিম
এক্কেবারে ছোটকালে মাইজদিতে থাকতে গরমের দিনে আইসক্রিমওয়ালারা গাঢ় সবুজ রংয়ের কাঠের বাক্সের দুই দিকের আংটায় একটা গামছা শক্ত কইরা বাইন্ধা কাঁধে ঝুলাইয়া, একদিকে হেইলা বাক্সের ঢাকনা পিটাইতে পিটাইতে “আআইসস ক্রিইইইইম মালে আআইসস ক্রিইইইইম…চাইরানা….আডানা…একটাকার মালে আআইসস ক্রিইইইইম” বইলা ডাক পাড়তে পাড়তে পাড়ায় ঢুকতো। আমরা পোলাপাইনরা যে যেখানে থাকতাম আইসক্রিমওয়ালার ডাক শুইনা সামনে গিয়া ভিড় করতাম। এরা সম্ভবত মাইজদি বাজারের কাছে ‘মোহাম্মদী’ আইসক্রিম ফ্যাক্টরি থিকা বিভিন্ন দামের ৮০-৯০ পিস আইসক্রিম ঐ কাঠের বাক্সে ভইরা হাইটা হাইটা পাড়ায় বা স্কুলে আইসক্রিম বেচতে বাইর হইতেন। বেশীরভাগ সময় আইসক্রিমওয়ালারা মেইন রাস্তা থিকা বড় আব্বাদের বাসার সামনের পুকুরপাড়ের রাস্তা দিয়া ঢুকতো। এই রাস্তা ধইরা বড় বৌদিদের বাসা থিকা শুরু কইরা মাঝখানের বড় আব্বাদের বাসা সহ শেষ মাথায় বড় দর্জির বাড়ি পর্যন্ত স্কুল ঘরের মত সিরিয়ালে আট নয়টা বাসা আছিলো। এরপর রাস্তা শেষ। আইসক্রিমওয়ালাদের আরেকটা পথ আছিলো বড় আব্বাদের বাসার পিছন দিক দিয়া আমার নানার বাড়ির সামনের জনতা স’মিল ধইরা বোর্ড স্কুলে যাওনের ৯৮ কানুগাজি মসজিদ রোড। তবে এই রাস্তা দিয়া আইসক্রিমওয়ালাদের কমই দেখতাম। যাই হোক বড় আব্বার বাসার সামনের পুকুর আর বাসাগুলার মাঝখানের রাস্তাটার উপর দুপুর বেলা স্কুল থিকা ফিরা বা ছুটির দিনে দুপুর বেলা আমি, মিজান ভাইয়া, টুটুল মামা, কান্তা আন্টি, পাড়ার স্বপন মামা, ফারুক মামা, শামীম ভাই, সোহেল ভাই, শাকিল ভাই, বিলকিস খালাম্মা, শিল্পি যে যখন আসতে পারতো বয়স অনুযায়ী সবাই মিলা বউচি, কানামাছি, কুতকুত, চাঁড়া-মীর, বোম্বাস্টিং, সাতচাড়া, লাটিম সহ নানারকমের খেলা খেলতাম। পাশের পুকুরে বড় আব্বার বাসার ঠিক সামনের ঘাটলায় দুপুর বেলা এক লগে আমরা পোলারা সব পুকুরে নাইমা গোসল করতাম, সাঁতার কাটতাম। মেয়েদের জন্য আরেকটু সামনে বেড়া দিয়া ঘেরা আরেকটা ঘাটলা আছিলো, সেখানে আম্মারা, খালারা গোসল করতেন।
যাই হোক গরমের দিনে কোন আইসক্রিমওয়ালা ঐ রাস্তায় ঢুকলে আমরা সবাই সামনে গিয়া জড়ো হইতাম। আইসক্রিমওয়ালা তখন কাঁধের থিকা কাঠের বাক্সটা নামায়া জিগাইতো কার কী আইসক্রিম লাগবো। আমরা কী কী আইসক্রিম আছে দেখতে চাইলে সে কাঠের ঢাকনাটা তুইলা দেখাইতো কী কী আইসক্রিম আছে। এইকাঠের বক্সের ভিতরে মনে হয় স্টাইরোফোমের একটা মোটা লাইনিং থাকতো যার ভিতরে কয়েকটা লেয়ারে আইসক্রিমগুলা রাখা হইতো। পাঁচ পাইর আইসক্রিমগুলা আছিলো ললি আইসক্রিম (পপসিকল)- বাঁশের একটা খরখরা কাঠির মধ্যে লাগানো চারকোনা লম্বা সবুজ রংয়ের জাষ্ট বরফ! খালি রংটাই আছিল সুন্দর, স্বাদ-গন্ধ কিছুই আছিলনা। এই আইসক্রিমগুলা থাকতো সবার উপরে। তবে মাঝেমধ্যে পাড়ায় আসতে আসতে এগুলা মনে হয় শেষ হয়া যাইতো বা থাকলেও হালকা গইলা যাইতো। এগুলার নীচে প্লাষ্টিক দিয়ে ঢাকা থাকতো কটকটা লালচে গোলাপী রংয়ের দশ পাইয়ের ললি।এইটা একটু মিষ্টি আছিলো কিন্তু আমার ধারনা এইটায় হান্ড্রেড পারসেন্ট স্যাকারিন মিশানো থাকতো। এই লাল ললিটাই সম্ভবত সবচাইতে বেশী চলতো। কারন ঐসময় পকেটে পাঁচ, পাই, দশ পাই, চার আনা বা আট আনার বেশী পয়সা পোলাপাইনদের পকেটে থাকতোনা। পকেটে চাইর আনা থাকলে অনেক সময় এই রকম দুইটা লাল ললি পরপর খায়া ফালাইতাম! বাকী পাঁচ পয়সা দিয়া নিজের ইচ্ছা হইলে এবং আইসক্রিমওয়ালার বাক্সে থাকলে সবুজটা! এমনকী আইসক্রিম শেষ করার পর মাঝে মাঝে বাঁশের কাঠিতে লাইগা থাকা লাল বা সবুজ রংটাও চুইষা ফালাইতাম! এইটা করতে গিয়া অনেকসময় বাঁশের চিকন আঁশ জিহ্বায় আটকায়া যাইতো- ঐটারে টাইনা বাইর করাটা হইতো আরেকটা মুসিবত! মাঝে মাঝে এক্সপেরিমেন্ট কইরা ১০ পয়সার আইসক্রিমগুলোর উপর লবণ মরিচের গুঁড়া ছিটায়ে টেষ্ট চেন্জ করতাম। আইসক্রিমটা চোষা শুরু করলে বরফের গায়ে লবণের দানা পড়া অংশে ছিদ্র হয়া যাইতো, ফলে চোষার সময় বাতাস সহ আইসক্রিমের পানিও একটু বেশি মাত্রায় চইলা আসতো! যাই হোক দশ পাইর এই লাল ললিটা খায়া একেকজনের ঠোঁট, মুখ, জিহ্বা মোটামুটি নেক্সট এক দেড় ঘন্টা লাল হয়া থাকতো। মাঝেমাঝে পানি দিয়া কুলি কইরা রং তাড়াইতাম কিন্তু মনে কোন দু:খ থাকতোনা! আইসক্রিম খাইতে পারছি এইটাই বড় কথা! চার আনা দামের আইসক্রিমটা ছিল একটু হালকা হলুদ রংয়ের। নিচের দিকে দুই একটা চিকন সুতার মত নারকেলের টুকরা থাকতো বইলা আজকের বিচারে এইটারে ‘কোকোনাট’ ফ্লেবারের আইসক্রিম বলা যায়। এই চার আনার আইসক্রিমের স্বাদ দশ পাইর আইসক্রিমটার চাইতে একটু বেটার আছিলো যদিও এটাও ছিল মোটামুটি শক্ত বরফের একটা চাক যারে চুইসা চুইসা জিহ্বা ধরায়া গলাইতে হইতো! এই ললিতেও যথারীতি স্যাকারিন ভরা থাকতো কিন্তু নারকেলের কারনে তিতকুনি ভাবটা একটু কম লাগতো । তবুও দিনে এইরকম একটা পাচ পাই, দশ পাই বা চার আনা দামের ‘গরীবের ললি’ খাইতে পারলে নিজেরে একটু ‘কামিয়াব’ মনে হইতো! যাই হোক চার আনার এই আইসক্রিম এর সাথে অথবা নীচের লেয়ারে ট্র্যান্সপারেন্ট প্লাস্টিকে মোড়া একটু হালকা কমলা রংয়ের, আট আনা দামের আইসক্রিম রাখা হইতো। এই আইসক্রিমটা অন্যান্য শক্ত বরফের মত ললির চাইতে একটু নরম লাগতো এবং মুখে দিলে সহজে গইলা গিয়া বরফের মিহি গুড়া টের পাওয়া যাইতো।মজাও অনেক বেশী লাগতো। সামান্য দুধের টাচ পাওয়া যাইতো বইলা স্যাকারিনের তিতা স্বাদটা আর অতটা বুঝা যাইতোনা। ঈদ-চাঁদ না থাকলে বা সামনে বড়রা কেউ না থাকলে শুধু নিজের কোমরের জোরে এর চাইতে বেশী দাম দিয়া আইসক্রিম খাওয়ার সুযোগ মিলতোনা। তাই কোনদিন একটা আট আনা দামের আইসক্রিম খাইতে পারলেই দিনটারে ‘স্বার্থক’ মনে হইতো। মনে আছে কাবা খালাম্মার বিয়ের পরপর আমার খালু হাফিজ মামা অফিস থিকা দুপুর বেলা যখন বাসায় ফিরতেন তখন মাঝেমাঝে এমন ‘দৈবযোগ’ হইতো যে মামা রিকসা থিকা জনতা স’মিলের সামনে নাইমা নানুর বাসার দিকে আসতেছেন, একই টাইমে একটা আইসক্রিমওয়ালাও ডাক পাড়তে পাড়তে ঐ রাস্তা দিয়া যাইতেসে আর আমিও ঐসময়ে হঠাৎ কইরা উনাদের সামনে হাজির হইলাম-এক্কেবারে ‘খাপে খাপ মন্তাইজ্জার বাপ’! সেই মহাক্ষনে আমারে দেইখা মামা একটু আহ্লাদ কইরা জিগাইতেন ‘কিরে আইসক্রিম খাবি নি’? আমিও চান্দ হাতে পাইয়া নগদে প্রস্তাবটা লুইফা নিয়া, লাজ-শরমের ধার না ধাইরা কইতাম ‘ হ মামা, খামু’।মামাও জিগাইতেন ‘কোনটা খাবি?’ আমিও উনার প্রশ্রয়ে সাহস পাইয়া কোন দিকে না তাকায়া কইতাম ‘আট আনা দামের আইসক্রিম’! নগদে আইসক্রিমওয়ালা ঢাকনা খুইলা আইসক্রিমটা হাতে দিলে আমিও দাঁত কেলায়া একটা হাসি দিয়া আইসক্রিমটা কামড়াইতে কামড়াইতে মামার লগে বাসায় ঢুকতাম। হাফিজ মামা, আইসক্রিমওয়ালা, আর আমার সাথে জনতা স’মিলের চিপায় এই ‘দৈব-সমাবেশ’ এরপরে আরো বেশ কয়েকবার হইছিলো! মামার কাছে আরো অনেক কিছুর মত এই আইসক্রিমগুলা খাওয়ানোর জন্যও অনেক কৃতজ্ঞ! যাই হোক ঐ আইসক্রিমের বাক্সের টপ র্যাংক আইসক্রিম ছিল এক টাকার মালাই আইসক্রিম যেইটা কিনা বক্সের একেবারে নিচের লেয়ারে বরফের সাথে রাখা হইতো। এই আইসক্রিমটা ছিল ধবধবে সাদা-একটা প্রিন্টেড সাদা কাগজের মোড়কে মোড়ানো থাকতো। অনেক নরম ছিল আইসক্রিমটা-মুখে দিলেই গইলা গিয়া বরফের কুচি আর মালাইয়ের স্বাদ টের পাইতাম! সেইসময় এরকম একটা আইসক্রিম খাইতে পারা ছিল হাতে স্বর্গ পাওয়ার মত সৌভাগ্য! এই আইসক্রিমেও মনে হয় স্যাকারিন মিশানো থাকতো কিন্তু কে কেয়ার করে ঐসব তখন! আইসক্রিমওয়ালার বাক্সে এক টাকার আইসক্রিম খুব বেশী থাকতোনা কারন এইটা কিনা খাওয়ার মত হ্যাডমওয়ালা কাষ্টোমার থাকতো কম আর আমাদের মত গুঁড়া পোলাপাইনদের তো এক্কেবারেই থাকতোনা।তাই কালেভদ্রে আব্বা-আম্মা, খালা-খালু বা বড় কেউ সাথে থাকলে উনাদের বদান্যতায় মাসে দুই মাসে একবার খাওয়া হইতো!
এই আইসক্রিমওয়ালারাই আবার মাইজদি পিটিআই স্কুলে ক্লাস শুরুর আগে বা টিফিনের টাইমে স্কুলের মাঠে আইসক্রিমের বাক্স নিয়া দাঁড়ায়া থাকতো। আমরা আম্মার কাছ থিকা ঐসময় স্কুলে আসার সময় এক টাকা নাইলে সর্বোচ্চ দুই টাকা পাইতাম। এই এক বা দুই টাকা দিয়া বরই বা সিজনাল ফল, আঁচার, চানাচুর খাওনের পর আইসক্রিমের পিছনে সর্বোচ্চ চার বা আট আনা খরচ করার সুযোগ থাকতো।এক টাকার আইসক্রিম খাওয়ার লাক্জারি করতে পারতাম না! ঐখান থিকা যদি অল্প কিছু বাচতো ঐটা জমায়া পাড়ায় আইসক্রিম কিনা খাইতাম। এই আইসক্রিমওয়ালারা ছিল আবার সিজনাল ব্যবসায়ী-সিজন চেন্জের সংগে সংগে এদের ব্যবসাও বদলাইতো। যেমন শীতের সিজনে এদের অনেকরেই আবার আইসক্রিমের বদলে বাসাবাড়ি, স্কুলে বা স্টেডিয়ামে বাদাম-বুট, কটকটি বেচতে দেখছি। কটকটিওয়ালারা নগদ পয়সা ছাড়াও বাসার পুরানা বই, পেপার বা বোতল এর বিনিময়ে কটকটি বিক্রি করতো।একজন কালোমতন হালকা দাঁড়িওয়ালা আইসক্রিমওয়ালা-কাম-বাদামওয়ালা-কাম-কটকটিওয়ালার মুখ এখনো মনে আছে! জানিনা উনি এখনো বাঁইচা আছেন কিনা! ৮৪ এর শেষে আমরা একেবারে ঢাকা চইলা আসলে মাইজদি জীবনের নিত্যদিনের এই মানুষগুলার সাথেও সম্পর্কের একধরনের ছেদ হয়!
পুরান ঢাকার আইসক্রিম
(১) সনি–লুসি–টমটম আইসক্রিম
ঢাকায় আইসা ৮৫ সালে আহমেদ বাওয়ানী বাওয়ানী স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরেই ঢাকার আইসক্রিমের সাথে পরিচয়। স্কুলের গেইটে রিকশার মত তিন চাক্কার আইসক্রিম ভ্যানে কইরা সনি, লুসি, টমটম সহ আরো কয়েকটা কোম্পানীর আইসক্রিম বিক্রি হইতো। এই ভ্যানগুলার পুরাটা অংশ জুইড়া থাকতো একটা চারকোনা মেটালের বক্স যার ভিতরটা ললি, ভ্যানিলা, কাপ, চকবার সহ নানারকমের আইসক্রিম দিয়া ভরা থাকতো। বক্সের গায়ে বড় কইরা আইসক্রিম কোম্পানীর নাম লিখা থাকতো। আইসক্রিমওয়ালারা এই বক্সের উপর দিকে চারকোনা একটা লিড বা ক্যাপ স্লাইড কইরা ভিতর থিকা কাস্টোমারের ডিমান্ড অনুযায়ী আইসক্রিম বাইর কইরা আনতেন। ভ্যানের সামনের দিকে রিকশার মত একটা সিটের উপর বইসা প্যাডেল মাইরা আইসক্রিমওয়ালারা ক্লাস শুরুর আগে, টিফিন টাইমে এবং ছুটির পরে ভ্যান নিয়া স্কুলের গেইটে দাঁড়ায়া থাকতো। ঢাকায় আমাদের প্রথম বাসা ছিল আরমানিটোলা মাঠের কোনায় আহমদ বাওয়ানী স্কুল আর নিউ গভ: গার্লস স্কুলের উল্টাদিকের একটা ছয়তলা বিল্ডিংয়ের দোতলায় যেখান থিকা দুইটা স্কুলের গেইটই সরাসরি দেখা যাইতো। আমার ক্লাস মর্নিং শিফটে ছিল বইলা সকাল ১১ টার পর বাসায় আইসা সারাদিন ধইরা এইসব আইসক্রিম ভ্যানগুলারে আসতে যাইতে দেখতাম। মাইজদিতে তো আইসক্রিমের এতটা ব্যাপক বেচাকিনি দেখি নাই তাই হঠাৎ কইরা ভ্যান এ কইরা নানান রকমের আইসক্রিমের বেচাকিনা দেইখা একটু তব্দা খায়া গেসিলাম! যাই হোক এই আইসক্রিম কোম্পানীগুলা এক টাকা দিয়া সবুজ রংয়ের লেমন আর কমলা রংয়ের অরেন্জ ললি আইসক্রিম, ভ্যানিলা, কমলা, ব্যানানা ফ্লেভারের হালকা দুধ-আইসক্রিম, ২ টাকায় আরেকটু বেটার কোয়ালিটির দুধ-আইসক্রিম, ২-৫ টাকা দামের মধ্যে বিভিন্ন রকমের চকবার আর ৫ টাকা দিয়া দই এর ফ্লেবারের কাপ আইসক্রিম বিক্রি করতো। এই বাওয়ানী স্কুলের সামনে থিকাই ফুপাতো ভাই বাবুল ভাই প্রথম আমারে ১ টাকা দিয়া সনি কোম্পানীর একটা ধবধবা সাদা দুধ-আইসক্রিম কিনা দেন (আব্বা-চাচার নয়াবাজারের স্টোরে উনি তখন চাকুরী করতেন এবং নানাকারনে দিনে তখন কয়েকবার আমাদের বাসায় আসতেন)। এই এক টাকা দামের সনি আইসক্রিমই ছিল ঢাকায় খাওয়া আমার ফার্ষ্ট আইসক্রিম যা ঐ মুহুর্তে মাইজদির রং মাখা ললির তুলনায় ‘অসাধারন’ মনে হইছিল। একটা আইসক্রিম শেষ কইরা আরেকটা খাওনের ইচ্ছা হইলে বাবুল ভাই আম্মা, মিজান ভাইয়া, রুমী এবং আমার জন্য আরো ৪ টা আইসক্রিম কিনা দেন। ঐগুলা বাসায় নিয়া আমরা সবাই একসাথে খাই। এরপর প্রায়ই আম্মা, বাবুল ভাই, তোফায়েল ভাই বা নুরু কাকারে ধইরা প্রায়ই লুসি, টমটম কোম্পানীর আইসক্রিম বাসায় আইনা খাইতাম। সেই আমলে এক টাকা দামের আইসক্রিমই নিয়মিত খাওয়া হইতো। এই এক টাকা দামের আইসক্রিমের মধ্যে ‘লুসি’ কোম্পানীর হালকা কমলা ফ্লেভারের দুধ-আইসক্রিমটাই আমার সবচাইতে বেশী ভাল্লাগতো। টমটমের ললিগুলো বিশেষ কইরা সবুজ রংয়ের লেমন ফ্লেভারের ললিটা গরমের দিনে খেলাধুলার পরে ঘামানো শরীরে খাইতে অনেক রিফ্রেশিং লাগতো। সনি আইসক্রিমের এক টাকা দামের সাদা দুধ-আইসক্রিমটাও খারাপ লাগতোনা। ২ টাকায় সামান্য ভালো ফ্লেভারের দুধ আইসক্রিম বা সস্তা চকবার পাওয়া যাইতো। এর মধ্যে আমি টমটম কোম্পানীর সস্তা চকবারটাই বেশী পছন্দ করতাম। চকবারের কোয়ালিটি ও স্বাদ দাম বাড়ানোর সাথে সাথে আরেকটু ভালো হইতো। কিন্তু হাতে টিফিনের পাওয়া সর্বসাকুল্যে ২-৪ টাকার মধ্যে চটপটি, চানাচুর-মুরি মাখানি, হজমি বা চকলেট-চুইংগামের বাজেট থাকায় দামী চকবার খাওয়ার খুব বেশী সুযোগ হইতোনা। তবে পকেটে কোনভাবে ১০ টাকার মত জমলে ফার্ষ্ট চয়েস হিসেবে একটা ‘কাপ’ আইসক্রিম খায়া ফালাইতাম। আরমানীটোলা এলাকার এই আইসক্রিম ভ্যানগুলা পুরান ঢাকার অন্য এলাকায় বা নতুন ঢাকার দিকে দেখা যাইতোনা। পরে খিয়াল কইরা দেখছি ঐ সমস্তএলাকায়ও এলাকাকেন্দ্রিক বিভিন্ন কোম্পানীর আইসক্রীম ভ্যান এ কইরা বেচা হইতো!
বাসায় নতুন ফ্রিজ কিনার পর উত্তেজনায় প্রথম প্রথম ঘরে বইসা আমি, মিজান ভাই, রুমী আইসক্রিম বানানোর ট্রাই করতাম। গুঁড়া দুধ আর চিনি পানিতে মিশায়া বরফের দুইটা ট্রেতে ঢাইলা ডিপ-ফ্রীজে রাইখা দিতাম। কয়েক ঘন্টা পর ট্রে দুইটা বাইর কইরা জইমা যাওয়া আইসকিউব মুখে নিয়া পুরা আইসক্রিমের ফিলিংস নিতাম। মাঝেমাঝে দুধ-চিনির সাথে হালকা আম বা কলা মিশায়া স্বাদ চেন্জেরও ট্রাই করতাম।গরমের দিনে কী যে মজা লাগতো ঐ আইস কিউবগুলা!
(২) ‘কোন’ আইসক্রিম
আমাদের সময়ে ‘কোন’ আইসক্রিম খাইতে পারা ছিল একটা প্রেষ্টিজের ব্যাপার। ভ্যানের আইসক্রিমওয়ালারা এই ‘কোন’ আইসক্রিম তখনো বিক্রি করতোনা। শহরের হাতেগোনা কয়েকটা দোকানে তখন ‘কোন’ আইসক্রিম পাওয়া যাইতো। আমাদের বাসা থিকা একটু দুরে আরমানিটোলা স্কুলের সামনে ‘কুল কর্নার’ নামে একটা দোকান ছিল যেখানে ৫ টাকায় মেশিনের ‘কোন’ আইসক্রিম পাওয়া যাইতো। এইখানে বিস্কুটের একটা ‘কোন’ কে ডাইরেক্ট মেশিন থিকা প্যাঁচায়ে প্যাঁচায়ে আইসক্রিম দিয়া ভইরা এক্কেবারে ফ্রেশ ফ্রেশ সার্ভ করা হইতো। দেয়ার আগে একটা পাতলা কাগজ দিয়া বিস্কুটের ‘কোন’ টারে প্যাঁচায়া দিতো যাতে উপর থিকা গইলা পড়া আইসক্রিমে বিস্কুটটা চুপসায়া না যায়। ‘কোন’ এর উপর ‘আইসক্রিম’ টা খাইয়া শেষ করতে একটু সময় লাগতো। আইসক্রিমটা জিহ্বা দিয়া মুখের ভিতর টাইনা নিয়া খাইতে খাইতে শেষ দিকে বিস্কুটসহ কামড় দিতাম। এই পার্টটাই ছিল ‘কোন’ আইসক্রিম খাওয়ার বেষ্ট পার্ট। এরপর দুই-চাইরটা কামড়ে বিস্কুটসহ আইসক্রিমের শেষ অংশটা খায়া তৃপ্তির একটা ঢেকুর তুলতাম! আইসক্রীমের প্রতি আমার টান তখন বা এখন কোনকালেই ক্রেজি টাইপের না থাকলেও ‘কুল কর্নার’ এর ‘কোন’ আইসক্রিমটা আমি মজা কইরাই খাইতাম! ৮৫-৮৬’র দিকে আরমানীটোলার এই ‘কুল কর্নার’ এর বাইরে সোবহানবাগের ‘স্নো-হোয়াইট’ থিকাও এক-দুইবার ‘কোন’ আইসক্রিম খাইসিলাম। জিগাতলার মোড়েও একটা ‘কোন’ আইসক্রিমের দোকান ছিল। ৮৫ সালের দিকে মিজান ভাইয়া ধানমন্ডিতে ক্যাডেট কলেজে ভর্তির কোচিং শেষ কইরা বাসায় ফিরার সময় আম্মা নাকি উনারে ঐখান থিকা প্রতিদিন ৫ টাকা দিয়া একটা ‘কোন’ আইসক্রিম কিনা দিতেন! এগুলার বাইরে ঢাকা শহরে আরো কয়েকটা ‘কোন’ আইসক্রিমের দোকান ছিল কিন্তু ওগুলাতে যাওয়া হয় নাই কখনো!
দোকানের এই স্ট্যান্ডার্ড ‘কোন’ আইসক্রিমের বাইরেও আমাদের পুরান ঢাকায় হাতে ঠেলা চার চাকার ছোট একটা ভ্যানে কইরা একধরনের সস্তা ‘কোন’ আইসক্রিম বিক্রি হইতো। অর্ডার করলে এই ‘কোন’ আইসক্রিমওয়ালা ভ্যান এর মধ্যে বস্তার ভিতরে রাখা বরফের চাকের উপর বসানো বড় মগের মত একটা টিনের মধ্যে রাখা সস্তা ক্রীম দিয়া পাতলা শেলের ছোট সাইজের একটা ‘কোন’ কে ভইরা ১ বা ২ টাকায় এই ‘গরীবের কোন আইসক্রীম’ টা বিক্রি করতেন। দাম কম হইলেও এর টেস্ট অত খারাপ আছিলোনা। আমরা পোলাপাইনরাও এই সস্তা ‘কোন’ খাইয়া দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাইতাম!
(৩) কুলফি
বাজারে তখনো আজকের মত ফ্যাক্টরিতে বানানো ‘কুলফি’ আসে নাই। কিন্তু পুরান ঢাকা আমাদেরকে ঐটার স্বাদ থিকাও বঞ্চিত করে নাই। উপরের সস্তা ‘কোন’ আইসক্রিম ভ্যানের মত মাঝে মাঝে চাকাওয়ালা ছোট ভ্যান এ কইরা আমাদের লোকাল কুলফিওয়ালারা দুপুরের দিকে ঘরে বানানো চিকন সরু কুলফি লয়া বাইর হইতেন। পাতলা-চিকন-লম্বা বেশ কয়েকটা সারিবদ্ধ টিনে র ডাইসে জমানো কুলফিগুলা উল্টা কইরা রাখা হইতো- উপর থিকা বাঁশের কাঠিগুলান চোখে পড়তো। আমরা অর্ডার করলে কুলফিওয়ালা কুলফি সহ টিনে র একটা ডাইস তুইলা বিশেষ কসরতে কাঠি সহ কুলফিটা খুইলা আমাদের হাতে ধরায়া দিতেন। কুলফিগুলো একেবারে চিকনা-পাতলা লম্বা চাইরকোনা শেইপের হইতো যা কাঠির গোড়া থিকা মাথার দিকে আরো চিকন হয়া উঠতো। এইরকম বাসায় বানানো কুলফির পুরা অংশ জুইড়াই থাকতো কাঠিটা-আসল কুলফি পাইতাম কমই! কিন্তু তারপরেও যা থাকতো সেইটা মুখে দিলে অমৃতের মত লাগতো আর ধীরে ধীরে গলতো বইলা একটা টাইম নিয়া খাইতে পারতাম। ৮৭-৮৮ সালের দিকে এগুলার একেকটার দাম আছিল আট আনা বা এক টাকা যা কিনা ৯০ দশকের শেষের দিকে গিয়া দাঁড়ায় এক বা দুই টাকা। জীবনে অনেক মজার কুলফি এর পরেও খাইছি বা এখনো খাই কিন্তু পুরান ঢাকার ঐ ভ্যানে বেচা কুলফির তুলনা নাই। জানিনা ফ্যাক্টরির কুলফির প্রভাবে ঐ হাতে বানানো কুলফি এখনো পুরান ঢাকার রাস্তাঘাটে চোখে পড়ে কিনা বা পড়লেও স্বাদ সেরকম আছে কিনা!
(৪) লটারি আইসক্রিম
আমাদের বাসার সামনের আরমানিটোলা মাঠে বা আরমানিটোলা স্কুলের মাঠে ৮৭ সালের দিকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় হরতাল হইলে সারাদিন ধইরাই নানারকম ক্রিকেট আর ফুটবল ম্যাচ হইতো। খেলাধুলা পছন্দ করতাম বইলা আমিও এই মাঠগুলাতে গিয়া খেলতাম বা খেলা দেখতাম।কোনদিন মাঠগুলাতে মাইজদির মত একটা কাঠের বাক্সে কইরা আইসক্রিমওয়ালারা আইসক্রিম বিক্রী করতে আসতো। এইধরনের বাক্সে কইরা মুলত আট আনা ও এক টাকার হালকা দুধ বা নারকেল মিশানো সস্তা গুড়ের বা চিনির আইসক্রিম বিক্রি হইতো! আইসক্রিমের বিক্রী বাড়াইতে এরা আবার একধরনের লটারীর ব্যবস্থা করতো। আইসক্রিম কিনার সময় ইচ্ছা করলেই এই লটারীতে অংশ নিতে পারতো। কাঠের ঢাকনার উপরে ঘড়ির মত ১২ টা ঘর কইরা বেশীর ভাগ ঘরে ১ আর মাঝে মাঝে অন্যান্য ঘরে ২, ৩ এই সংখ্যাগুলা খোদাই করা থাকতো। কাষ্টোমারের কাছে একটা নির্দিষ্ট আইসক্রিমের দাম নেয়ার পর মাঝখানের কাঠের কাঁটাটা ঘুরায়া দেখা হইতো সেইটা কোন ঘরে গিয়া থামে। ১ এ থামলে যে দামের আইসক্রিমের টাকা দেয়া হইছিল তার ১ টা, ২ এ থামলে ২ টা আর ৩ এ থামলে ৩ টা এরকম কইরা আইসক্রিম দেয়া হইতো। আমিও অনেকবার এক আইসক্রিমের টাকা দিয়া ২ টা বা ৩ টা আইসক্রিম পাইসিলাম। এই আইসক্রিমগুলা ভ্যানে বিক্রি করা আইসক্রিমের মত অত কোয়ালিটিসম্পন্ন না হইলেও খাইতে কিন্তু মজা লাগতো। বিশেষ কইরা ঠা ঠা রোইদের মধ্যে ঘামে গরমে নাংগা হইয়া খাইতে অমৃতের মত লাগতো। দাম কম ছিল বইলা অল্প টাকায় বেশ কয়েকটাও কিনা খাওয়া যাইতো। আর লটারীতে জিতলেতো বোনাস!
নতুন ঢাকার আইসক্রিম:
(১) পোলার–ইগলু আইসক্রিম
৮৮ সালের দিকে ঢাকা নিউমার্কেটের কাছে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে ভর্তি হইলে ঐখানেও স্থানীয় আইসক্রিমওয়ালা মামুরা ভ্যান নিয়া গতানুগতিক ললি, দুধ- আইসক্রিম বা চকবার বিক্রি করতেন যা সাধারনত ১-৫ টাকার মধ্যেই পাওয়া যাইতো। এগুলোর কোয়ালিটি পুরান ঢাকায় ভ্যান এ বিক্রি করা আইসক্রীমের চাইতে মোটেও ভালো ছিলনা। তবে পুরান ঢাকায় পড়ার সময় এই একি টাইপের আইসক্রিম এত বেশী খাওয়া হইসিল যে ততদিনে এগুলার প্রতি আগ্রহও কইমা গেছিলো।তারপরও মাঝেমাঝে দুপুর বেলায় টিফিনের সময় বন্ধু-বান্ধবের সাথে লেমন ফ্লেভারের ললি খাইতাম। তবে ঢাকার এই গতানুগতিক আইসক্রিমে একটা বড় চেন্জ আসে ৮৯ সালে। দুইটা নতুন জিনিসের সংযোজন হয়। একটা হইলো গিয়া চিকন প্লাষ্টিকের ভিতর দিয়া কাঠি ছাড়া ললি (পপসিকল) যেইটা কমলা ও লেমন দুই ফ্লেভারেই পাওয়া যাইতো। এইটারে মনে হয় আমরা ‘ড্রিংকা’ বলতাম যা ১ টাকায় পাওয়া যাইতো। স্কুলের মাঠে টিফি ন টাইমে ফুটবল খেলার মাঝখানেই পোলাপাইনরা স্কুল গেইটে দাঁড়ানো আইসক্রিমওয়ালা মামুর কাছ থিকা দৌড়ায়া গিয়া একটা ‘ড্রিংকা’ কিনা কোনার প্লাষ্টিক ছিঁড়া চোষা শুরু কইরা আবার খেলতে নাইমা যাইতো। তাড়াতাড়ি চুইসা মোটামুটি সমস্ত কালার আর মিষ্টি পার্টটি শেষ কইরা ফালাইলে প্লাস্টিকটা ছিঁড়া সাদা বরফের কিছুটা মুখে গালে মাথায় দিয়া শরীলটারে ঠান্ডা করতো আর বাকীটা মুখে গিলা ফালাইয়া গলা ভিজাইতো!
এইসময়ের আরেকটা বড় সংযোজন হইলো লিজেন্ডারি পোলার আইসক্রিম! ৮০ দশকের গোড়ার দিক থিকা ৮৭-৮৮ সাল পর্যন্ত ঢাকায় ভালো কোয়ালিটির আইসক্রিম বলতে মানুষ ‘ইগলু’ আইসক্রিমরেই বুঝতো। তেজগাঁও শিল্প এলাকা দিয়ে বনানীতে খালার বাসায় যাওয়ার সময় ফ্যাক্টরিটা চোখে পড়তো। ফ্যাক্টরির গেইটে মনে হয় আইসক্রীম বিক্রিও হইতো। কিন্তু কোন কারনে এই ইগলু আইসক্রিম ঢাকা শহরের সবখানে পাওয়া যাইতোনা। কিছু নির্দিষ্ট দোকানে ইগলু আইসক্রিমের বড় বড় বক্স বা কাপ আইসক্রিম পাওয়া যাইতো। আর ঢাকার শিশুপার্কের গেইটে অন্যান্য কোম্পানীর আইসক্রিমের ভ্যানেও ইগলুর কাপ আইসক্রিমটা পাওয়া যাইতো। আমরাও শিশুপার্কে গেলে এই আইসক্রিমটা খাওনের সুযোগ মিস করতাম না। এধরনের বিশেষ কয়েকটা জায়গা ছাড়া এই ইগলু আইসক্রিম খাওয়ার সুযোগ হইতোনা।কিন্তু ৮৯ সালের দিকে পোলার আইসক্রিম আইসা ঢাকায়, বলা যায় গোটা বাংলাদেশেই আইসক্রিমের কনসেপ্টটা চেন্জ কইরা ফালাইলো। এই প্রথম ফ্যাক্টরিজাত একটু ভালো কোয়ালিটির আইসক্রিম, নানা ভ্যারাইটি, উন্নতমানের মসৃন কাঠিসহ (খরখরে বাঁশের কাঠি না) সুন্দর প্যাকেজিং ও ডিজাইন নিয়ে ব্যাপকভাবে দেশের মানুষের কাছে আসলো। এই আইসক্রিম স্বাদ, কোয়ালিটি, ভ্যারাইটি দিয়া মোটামুটি বাজারের সমস্ত প্রচলিত আইসক্রিমের ভাত মাইরা দিলো! শহরের মোটামুটি সব এলাকার দোকানে পোলারের ভ্যানিলা, স্ট্রবেরি, চকলেট ফ্লেভারের ফ্যামিলি সাইজের বক্স, কাপ, চকবার আর ললি আইসক্রিম পাওয়া যাইতো। ফ্যামিলিপ্যাক গুলা ২৫-৩০ টাকা দিয়া কিনা সবাই মিলা বাসায় খাইতাম আবার কারো বাসায় দাওয়াত খাইতে যাওয়ার সময় নিয়াও যাইতাম। যাই হোক, দোকানের পাশাপাশি পোলার কোম্পানী ভ্যানে কইরাও ঢাকার, বিশেষ কইরা নতুন ঢাকার স্কুলে স্কুলে আইসক্রিম বিক্রির ব্যবস্থা নিছিলো! এরকম একটা পোলার আইসক্রিমের ভ্যান ৮৯ সালের দিকে আমাদের গভ: ল্যাবরেটরি স্কুলেও আসতো। আমাদের স্কুলে পোলারের ললি, বিশেষ কইরা কোলা ফ্লেভারটা অসম্ভবরকম জনপ্রিয় হইসিল। এই ললির কালার পুরা জমাট বাধা কোকের মত আর খাইতেও কোকের মত লাগতো! ‘কোলা’ ছাড়াও আমি পোলারের রাস্পবেরি, লেমন সব ফ্লেভারের ললিই পছন্দ করতাম। এই ললিগুলার দাম ছিল তিন টাকা যা তখনকার দিনে আমাদের পকেটমানির তুলনায় একটু বেশী হলেও ক্যামনে যেন ম্যানেজ কইরা মোটামুটি রেগুলারই খাওয়া হইতো। চকবার বা কাপ আইসক্রিমের দাম ছিল পাঁচ টাকা- খাইতেও অনেক মজা ছিল! ক্লাসের অনেক পোলাপাইনের টাকার অভাব আছিলনা- ৫০ বা ১০০ টাকার কড়কড়ে নোট দিয়া আইসক্রিমওয়ালার থিকা এই কোলা, চকবার আর কাপ সবধরনের আইসক্রিমই কিনা খাইতো। কিন্তু মধ্যবিত্ত ঘরের আমরা যারা টিফিনে ৫-১০ টাকা কইরা আনতাম তাদের পক্ষে সবসময় কাপ আর চকবার কিনা খাওয়া সম্ভব হইতোনা, বড়জোর একটা ‘কোলা’ ফ্লেভারের ললি কিনা খাইতাম। আমার কাছে পোলারের ললির মধ্যে ‘কোলা’ আর ‘রাস্পবেরি’ ফ্লেভার, চকবার আর কাপ আইসক্রিমের মধ্যে স্ট্রবেরি আর ম্যাংগো ফ্লেভারটা সবচাইতে বেশী ভাল্লাগতো! কাপের মধ্যে ব্যানানা আর চকলেট ফ্লেভারটাও অত খারাপ লাগতোনা।
এই প্রসংগে স্কুল লাইফের পোলার আইসক্রিম নিয়া একটা ঘটনা না বইলা পারতেছিনা। আমাদের ক্লাসের এক বন্ধু, দেশের এক বড় ব্যবসায়ীর ছেলে (নামটা কইতেসিনা সবাই চিনবেন বইলা), মাঝেমাঝেই দুপুর বেলা টিফি নের পর স্কুল থিকা অসুস্থতার উসিলা দেখায়া চইলা যাইতে চাইতো। কিন্তু দরখাস্ত না লিখলেতো স্কুল ছুটি অ্যালাউ করতোনা! তো আমাদের আলালের ঘরের দুলাল বন্ধুটা নিজের দরখাস্তটাও নিজে লিখতে চাইতোনা। প্রায় আমারে ধরতো দরখাস্তটা লিখা দিতে। আমার এগুলা করা কোন ব্যাপার আছিলনা। তবে ওরে একটা শর্ত দিতাম ‘হ, আমি লিখা দিমু তবে বিনিময়ে একটা কোলা আইসক্রীম খাওয়াইতে হইবো’। ও রাজি হইলে আমিও ৫ মিনিটে একটা দরখাস্ত লিখা দিতাম। আমার লিখা এই দরখাস্ত ও স্যারদের দেখায়া টি টি কলেজের গেইট দিয়া স্কুল থিকা বাইর হওনের সময় পোলার আইসক্রিম মামুর থিকা আমারে একটা ‘কোলা’ আইসক্রিম কিনা দিত! আমিও খুশীমনে ঐটা খাইতে খাইতে স্কুল কম্পাউন্ডে ঢুইকা যাইতাম! আমাদের মধ্যে এই ‘দরখাস্ত লিখা-কোলা আইসক্রীম খাওয়ানো’ সংক্রান্ত ‘আন্ত:সম্পর্ক’টা বন্ধুটার ক্লাস এইটে স্কুল ছাইড়া চিরতরে চইলা যাওনের আগ পর্যন্ত অটূট আছিলো!
তো পোলার আইসক্রিমের এই জয়জয়কার অবস্থা দিখা ৯০ দশকের মাঝামাঝি থিকা ‘ইগলু’ আবার রিভাইটালাইজ্ড হয়া পোলারের মত স্ট্রাটেজি নিয়া কোয়ালিটি, ভ্যারাইটি, সুন্দর প্যাকেজিং ও ডিজাইন নিয়া ব্যাপকভাবে দেশের মার্কেটে আবির্ভূত হইলো। দোকানে দোকানে ইগলু আইসক্রিম পৌঁছায়া দিলো। শহর এলাকায় ভ্যানে কইরা স্কুল, কলেজ আর ভার্সিটিতে ইগলুর ভ্যান দ্যাখা যাইতো! এরকম একজন ইগলু আইসক্রিম ভ্যানওয়ালা মামুর কাছ থিকা আমিও ৯৭-০২ সালের দিকে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার সময় কার্জন হল চত্বরে নানান রকমের আইসক্রিম কিনা খাইতাম। জানিনা উনি এখনও কার্জন হলে ইগলুর ভ্যান নিয়া দাঁড়ায়ে থাকেন কিনা!
(২) আইসক্রিম পার্লার
আমাদের ছোটকালে ঢাকা শহরে দোকানে বইসা বিভিন্ন ভ্যারাইটির আইসক্রিম খাওয়ার মত দোকানের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। ৮০-৯০ এর দশকে ঢাকা শহরে দুইটা দোকানের কথা মনে পড়ে যেখানে ফ্যামিলি নিয়ে বইসা আইসক্রিম খাওয়া যাইতো।একটা ছিল ঢাকা নিউমার্কেটের ভিতরে, আরেকটা ছিল নিউমার্কেটের উল্টাদিকে চাঁদনী চক মার্কেটের দোতালায়-ফ্ল্যামিংগো। ‘ডলসিভিটা’ নামে মীরপুর রোডের উপর পুরাতন ম্যাকডোনাল্ডস চাইনিজের ওদিকে আরেকটা ভালো আইসক্রিম পার্লারের কথা এখনো মনে পড়ে! এই দোকানগুলাতে পিস্তাচিও, ম্যাংগো, অরেন্জ, ব্যানানা, ভ্যানিলা, চকলেট সহ নানা ভ্যারাইটির আইসক্রিম স্কুপে কইরা নিয়া বাটিতে সার্ভ করা হইতো। কিন্তু দাম অনেক বেশী পড়তো বইলা একা একা খাওনের সাহস করতামনা। দুইটা স্কুপের এক একটা বাটির দাম পড়তো সেই আমলেই ২৫-৪০ টাকা! নিউমার্কেটের ভিতরের দোকানটাতে আমার এক খালার বিয়ের পাত্র দেখতে গিয়ে ফ্যামিলির সাথে প্রথম খাইতে যাই। চাঁদনী চকের উপরে ‘ফ্ল্যামিংগো’ তে ৯০ এর দশকে কলেজ-ভার্সিটি লাইফে বন্ধুবান্ধব নিয়া বেশ কয়েকবার যাই। ঐখানকার ‘পিস্তাচিও’ আইসক্রিমটা ছিল আমার অল টাইম ফেভারিট!
২০০০ এর পরপরই আইসক্রিমের প্রতি ধীরে ধীরে আগ্রহ কইমা যায় এবং আর কিছুদিন পরই পিএইচডির লাইগা দেশের ছাড়ার পর দেশের আইসক্রিমের আর খোজ খবর রাখা হয় নাই। এখনতো শুনছি নানা ব্র্যান্ডের নানা ভ্যারাইটির আইসক্রিম দেশের মোটামুটি সবখানেই পাওয়া যায়। ঢাকাসহ অন্যান্য শহরেও বড়বড় আইসক্রিম পার্লার খোলা হইছে যেখানে অনেক হাই কোয়ালিটির ও বিভিন্ন রকমের মজাদার আইসক্রিম নাকি পাওয়া যায়! বিদেশে বইসা আমারো নানা উপলক্ষে অনেক মজার মজার আইসক্রিম খাওয়া হয়। কিন্তু সত্যি কথা কি ছোটবেলার মত বাক্সে-ভ্যানে বিক্রি করা আইসক্রিম, ললি, কুল কর্নারের কোন, আর একটু বড় বেলায় পোলার-ইগলুর বা ফ্ল্যামিংগোর পিস্তাচিওর মত আইসক্রিম খাওয়ার আর উত্তেজনা পাইনা! তবুও সব আইসক্রিম প্রেমিকদের প্রতি রইলো প্রানঢালা শুভেচ্ছা! আপনারা প্রানভরে উপভোগ করুন মজার মজার আইসক্রিম!
লেখক : ডঃ মোহম্মদ মাহবুব চৌধুরী কানাডার অটোয়াস্থ কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয় হতে রসায়নে পিএইচডি সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী-NXP Semiconductor Inc. এ External Quality Engineer হিসেবে কর্মরত আছেন। এর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর রসায়ন বিভাগ হতে বিএসসি (সম্মান) এবং এমএসসি সম্পন্ন করে প্রায় তিন বছর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে শিক্ষকতা করেন।