লিখেছেন সুমন কুমার দাশ
কৈ মাছ তেলে ভাজা
খাইতে লাগে বড়ো মজা
আবার, বাইলা মাছে করিলে ভর্তা
সঙ্গে লাগে ধইন্যা পাতা ॥
ইলিশ মাছ রানলে পরে
গন্ধ ছড়ায় পাকের ঘরে
আইড় মাছ রান্ধিলে মায়ে
কখন খাইব ঘুরায় মাথা ॥
বাঘমাছ রানলে, পাতে
সাতকড়া দিতে হয় তাতে
গজার মাছের কুটি বিরান
কী কইব তার স্বাদের কথা ॥
পাবদা মাছ বুনিলে পরে
জামাই খায় তার পেটটি ভরে
পুঁটি ভাজা দেখলে সবার
জলে ভরে জিহ্বার পাতা ॥
ডায়াবেটিসের রোগী যারা
তেলাল মাছ খায় না তারা
ওয়াহিদ সেই স্বাদ পারে না নিতে
ডায়াবেটিসে দিছে জাতা ॥
(সিলেটি গান, শেখ ওয়াহিদুর রহমান)
কনকনে শীতের রাত। দুইটা বা আড়াইটা হবে। শীতল বাতাস সঙ্গী করে আমরা দুজন পাশাপাশি হেঁটে চলছিলাম। নাক-মুখ-চোখে কুয়াশার ঝাপটা লাগছিল। ঠান্ডায় হাত জমে এসেছে। শীত এতটাই বেশি, মুখ দিয়ে ‘রা’ শব্দ বের করার ইচ্ছে হয়নি। কাঁপতে-কাঁপতে আধা কিলোমিটার হেঁটে কোনওরকমে মশরাফিয়া রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। আতপ চালের ধোঁয়া-ওড়া গরম ভাত, ডিম ভাজা, মসুরি ডাল আর সাতকড়ার কুচি দিয়ে রান্নাকরা পাতলা ট্যাংরা মাছের গরম ঝোল-গোগ্রাসে খেলাম দুজন। পাতে ছিল কাঁচা পেঁয়াজ আর শুকনো মরিচের ভাজা। সিলেটের টিলায় চাষ করা লেবুর পাশাপাশি সালাদ হিসেবে ফালি ফালি করে কাটা মুলার কয়েকটা টুকরোও ছিল। হোটেল-বয় হয়তো অন্য সময়ের তুলনায় ওইদিন একটু বেশি ‘টিপস’ পাওয়ার প্রত্যাশায় নিজের জন্য বৈয়ামে সংরক্ষণ করে রাখা গাওয়া-ঘি থেকে এক চামচ পাতে ঢেলে দিয়েছিলেন। ডিমভাজা আর পাতলা ডালের সঙ্গে ঘি, উপাদেয় ছিল সে খাবার! আর সাতকড়া দিয়ে ট্যাংরা মাছের ঝোল তো ছিল আরও সুস্বাদু। চেটেপুটে নিমেষে সে রাতে সাফ করে দিয়েছিলাম খাবারের প্লেট।
দুই দশকেরও বেশি সময় আগের সেই শীতরাতের খাবারের কথা এখনও ভুলিনি। স্বাদ যেন জিভে লেগে আছে! এর আগে-পরে উননব্বই বছর বয়েসি মশরাফিয়া রেস্টুরেন্টে অনেকবারই তো খেলাম। কিন্তু সেদিনকার খাবারের স্বাদ আর দৃশ্য ভুলতে পারি কই? এই মশরাফিয়াতেই সুস্বাদু ও জিভে জল আনা পাতলা ঝোলের মুরগির সালুন, গুঁড়ো মরিচ দিয়ে তৈরি করা আলু ভর্তা, আস্ত আলুসমেত খাসির রেজালা, সরষেবাটা ইলিশ, রুই-কাতলা-মলা-শিং-শোল-ট্যাংরা-চাপিলা-বড়ো বাইম-তারা বাইম-গুলশা-পুটা-ঘনিয়া মাছের তরকারি, কাঁচা মরিচ দিয়ে কেঁচকি মাছের চচ্চড়ি, সামুদ্রিক চিংড়ির তরকারি, পুঁটি মাছের কড়কড়ে ভাজা আর ভোনা খিচুরি ও বিরিয়ানি খেয়েছি। কিন্তু মশরাফিয়ার খাবারের প্রসঙ্গ উঠলেই কেন তবে সেই রাতের খাবারের কথাই আমার বেশি মনে পড়ে?
যে মশরাফিয়া রেস্টুরেন্টের গল্প এতক্ষণ বলছি, এর অবস্থান সিলেট শহরের বন্দরবাজার এলাকায়। ১৯৩০ সালে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার পাঠানপাড়া এলাকার (বর্তমানে এটি সিলেট মহানগরের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত) আশরাফ আলীর হাত ধরে রেস্টুরেন্টটির ব্যবসায়িক যাত্রা শুরু হয়েছিল। শুরুর দিকে এটি বেকারি-জাতীয় দোকান ছিল। সেখানে মিষ্টি, দই, বাখরখানি, বুন্দিয়া, কেক ও পাউরুটি জাতীয় খাবার বিক্রি করা হতো। তখনকার সময়ে বন্দরবাজার ছিল সিলেট শহরের হাতে-গোনা দু-একটি বাণিজ্যিক এলাকার একটি। শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত সুরমা নদীকে কেন্দ্র করেই তখন সিলেটের বাণিজ্যিক সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছিল। এ অবস্থায় নদীর তীরে বেশকিছু দোকানপাট তৈরি হয়েছিল। নদী-বন্দরকেন্দ্রিক সে এলাকাই একসময় বন্দরবাজার নামে পরিচিতি পায়। এখানে ‘মশরাফিয়া’ নামের বেকারি দোকানটি চালু হয়েছিল মূলত বন্দরকেন্দ্রিক আগত ব্যবসায়ী আর ক্রেতাদের কথা মাথায় রেখেই। পরে, যখন বেকারি দোকানটির ব্যবসা থরথর করে বাড়তে থাকে, তখন আশরাফ আলীর ছেলে হাজি আবদুল আজিজ চান মিয়া এটিকে রেস্টুরেন্টে রূপ দেন। সেটা ১৯৫০ সালের কথা। এরপর থেকে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টাই ভাত আর পরোটাসহ নানা ধরনের খাবার বিক্রি হতে থাকে। উননব্বই বছরের ব্যবধানে শহর সিলেটের আকাশ-পাতাল পরিবর্তন ঘটলেও মশরাফিয়া এখনও স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। শহরের সব হোটেল-বাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, কেবল নির্ঘুম থাকে শতবর্ষী ছুঁই-ছুঁই মশরাফিয়া! তাই রাতবিরাতে এখানে পেটের ক্ষুধা মেটাতে ভিড় জমান খাদ্যরসিকেরা।
চান মিয়ার যখন পড়তি বয়স, তখন তাঁর ছেলে তারেক আহমদ ১৯৮০ সালের দিকে রেস্টুরেন্টটি পরিচালনার দায়িত্ব নেন। এর পাঁচ বছর পর চান মিয়া মারা যান। ২০০৬ সালে তারেক আহমদও মারা যান। পরে তাঁর ছেলেরা দোকানটি পরিচালনায় যুক্ত হন। ২০০৯ সালের ২৬ জুলাই থেকে রেস্টুরেন্টটি তাঁরা সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার কালীগঞ্জ বাজারের শাহীন আহমদের কাছে ভাড়া দেন। এরপর থেকে শাহীনই মশরাফিয়া নামের এই খাবারের রেস্টুরেন্টটি পরিচালনা করে আসছেন। তবে রেস্টুরেন্টের মালিকানায় ঠিকই আশরাফ আলীর উত্তরাধিকারীরা রয়েছেন। বর্তমান মালিকানায় তারেক আহমদের ছেলেরা ছাড়াও তাঁদের মামা লন্ডনপ্রবাসী মালেক আহমেদও রয়েছেন। অনেক আগে সিলেট শহরের স্থায়ী বাসিন্দা—এমন কজন প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তাঁরা জানিয়েছেন, মূলত রেস্টুরেন্টটির কোনও নাম ছিল না। তাই সবাই বেকারি দোকানটির প্রতিষ্ঠাতা আশরাফ আলীর নামে মানুষজন বলতেন ‘আশরাফের দোকান’। সেই ‘আশরাফ’ লোকমুখে একসময় ‘মোশারফের দোকান’ হয়ে যায়। এরপর লোকমুখে বিবর্তিত হয়েই রেস্টুরেন্টের নাম হয় ‘মশরাফিয়া’।
মশরাফিয়ার অন্যতম স্বত্বাধিকারী তারেক আহমদের ছেলে নাদিম নেওয়াজ আহমেদের সঙ্গে আমার পরিচয় বেশ আগেই। তবে সেটা জাস্ট ‘হায়-হ্যালো’ পর্যায়ের। ১৯৯৯ সালে যখন উচ্চশিক্ষার্থে সিলেটে পাকাপোক্তভাবে আবাস গাঁড়ি, তখন প্রায়ই বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে রাতবিরেতে মশরাফিয়াতে ছুটে যেতাম। তখন তাঁর সঙ্গে দেখা হতো, টুকটাক আলাপও হতো। নিয়মিত খাবারের সুবাদে মুখচেনা পরিচয় ছিল তাঁর বাবা তারেক আহমদেরও সঙ্গে। শিক্ষার্থী হওয়ায় তিনি আমাদের স্নেহ করতেন, প্রায়ই খাবারের বিল কম রাখতেন। তবে মশরাফিয়াতে আমার প্রথম খাবারের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ ১৯৯৬ সালে। সেবার বাবার গুরুতর অসুস্থতার কারণে সিলেট আসা। কিছুদিন চিকিৎসার পর বাবা যখন সুস্থ হয়ে উঠলেন, মানে কয়েকদিন পরই আমরা বাড়ি ফিরব, এর আগে বাবাই আমাকে মশরাফিয়াতে নিয়ে গেলেন। সেখানে চিতল মাছের ঝোল দিয়ে বাবার সঙ্গে আয়েশ করে ভাত খেয়েছিলাম। এরপর থেকে কতশতবার যে মশরাফিয়ার ভাত-পরোটা-বিরিয়ানি পেটে পড়েছে, তার নির্দিষ্ট কোনও হিসাব-কিতাব নেই!
মশরাফিয়াতে দিনের বেলা খেতে খুব কমই গিয়েছি। যতবার গিয়েছি, তা রাতের বেলাতেই। হাতে-গোনা দু-চারদিন হয়তো এর ব্যতিক্রম। রাতে যাওয়ার সুনির্দিষ্ট কিছু কারণও রয়েছে। উনিশ শ নিরানব্বই, দুই হাজার, দুই হাজার এক সালের কথা। তখন ছাত্র ছিলাম। থাকতাম চালিবন্দর এলাকার উমেশচন্দ্র-নির্মলাবালা ছাত্রাবাসে। যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা প্রয়াত নিকুঞ্জবিহারী গোস্বামী। এটি ‘চালিবন্দর ছাত্রাবাস’ নামেও সিলেটে ব্যাপকভাবে পরিচিত। নিকুঞ্জবিহারীর প্রয়াণের পর এটি পরিচালনা করতেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেত্রী সুহাসিনী দাস (এখন প্রয়াত)। আমরা যখন ছাত্রাবাসের আবাসিক, তখন সুহাসিনী দিদিমাই এর পরিচালক ছিলেন। সে ছাত্রাবাসে মোরগের মাংস রান্না হতো না, এটাই নাকি প্রথা। অথচ আমাদের যত আগ্রহ সেই মোরগের মাংস ঘিরেই। তাই কালেভদ্রে বাড়িতে গেলে, কেবল তখনই মোরগের মাংসের স্বাদ পেতাম! কিন্তু তাতে কি আর আমাদের সয়? তাই উজাগরি রাত কাটিয়ে প্রায়ই আমরা তিনটা-চারটার দিকে মশরাফিয়াতে ছুটে যেতাম কেবল মোরগের মাংস দিয়ে গরম ভাত কিংবা পরোটা খাবারের লোভে। রাতে ছাত্রাবাসের মূল গেট তালাবদ্ধ থাকত। তাই আমরা পাঁচ থেকে ছয় হাত উঁচু দেয়াল টপকে ছাত্রাবাসের বাইরে বেরোতাম। এত উঁচু দেয়াল টপকানোও কম কষ্টের ছিল না। একজন নিচে দাঁড়িয়ে অন্যজনকে পাছায় দুই হাত দিয়ে ঠেলা দিয়ে দেয়াল টপকাতে সহায়তা করত। সবাই দেয়াল টপকানোর পর যে শেষপর্যন্ত দেয়ালের অপরপ্রান্তে থাকতেন, তাকে খুব কষ্ট আর কসরত করে দেয়াল টপকাতে হতো। এভাবে দেয়াল টপকানোর পর আমরা হেঁটে হেঁটে মশরাফিয়াতে যেতাম।
চালিবন্দর থেকে বন্দরবাজারের দূরত্ব অন্তত আধাকিলোমিটার। গভীর রাতে রিকশা খুব একটা পাওয়া যেত না। জনমানবহীন রিকশা-শূন্য সড়ক ধরে আমরা গল্পগুজব করতে করতে এগুতাম। চালিবন্দরের পরেই ছিল সোবহানীঘাট এলাকা। এ সড়ক ধরেই ঢাকাগামী বাস চলাচল করত। তাই সেখান দিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা ট্রাক আর যাত্রীবাহী বাস প্রায়ই চোখে পড়ত। হঠাৎ হঠাৎ টুটাং শব্দ করে দু-একজন রিকশাচালক প্যাডেল মেরে যেতেন, ডাকলেও তাঁরা শুনতেন না (হয়তো অলুক্ষণে কোনও আশঙ্কায় এত রাতে যাত্রী বহন করতে রাজি হতেন না!)। সোবহানীঘাট পার হওয়ার পর ছিল ধোপাদিঘিরপাড় এলাকা। এ এলাকাটি তুলনামূলকভাবে কিছুটা নির্জন, নিস্তব্ধ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পার হয়ে যে জায়গায় পৌরবিপণি অবস্থিত, তার ঠিক বিপরীতের একটু আগে, অর্থাৎ, ওসমানী উদ্যানের ঠিক কোনায়, সেখানে দাঁড়ানো থাকতেন কয়েকজন দেহজীবী নারী। আমাদের দেখে প্রায়ই তাঁরা এগোতেন, পরে যখন তাঁদের ধারণা হয়ে যেত যে—আমরা তাঁদের খুঁজে আসিনি, তাঁরা মুহূর্তেই সরে পড়তেন! এই জায়গা হেঁটে পার হওয়ার মিনিটখানেক পরই আমাদের কাঙ্ক্ষিত মশরাফিয়া রেস্টুরেন্ট। সেখানেই চলত গভীর রাতে পেটপুরে খাওয়াদাওয়া।
মশরাফিয়া প্রসঙ্গ এলেই মনে পড়ে দিলু বাবুর্চির কথা। সম্ভবত কুমিল্লা কিংবা চাঁদপুরের দিকে তাঁর বাড়ি ছিল। এর বেশি তথ্য আর মনে পড়ে না। ধারণা করি, সে সময়টাতে (উনিশ শ নিরানব্বই-দুইহাজার সাল) তাঁর বয়স ছিল চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মতো। খাবার সার্ভ করা তাঁর দায়িত্বে পড়ে না, তবে যেহেতু প্রায়ই আমরা ভররাতে যেতাম, তখন মশরাফিয়ার চিরচেনা গিজগিজ দৃশ্য থাকত না। দিলুভাইও তখন অনেকটা ফ্রি থাকতেন। আমাদের দেখেই এগিয়ে আসতেন, সেদিনকার ভালো মেন্যুটার নাম তিনি বলতেন। আমরা কেউ কেউ মোরগের মাংস খেতাম, আবার দিলু ভাইয়ের সাজেস্ট করা মেন্যু দিয়েও খেতাম। আমাদের অতি আপন করে নেওয়া সেই দিলু বাবুর্চি এখন কোথায়, কী অবস্থায় রয়েছেন, তা আর জানা নেই। তবে তাঁর হাতে রান্না করা মোরগ ঝোলের স্বাদ এখনও জিভে লেগে আছে। রসুনের কোয়া আর আস্ত পেঁয়াজ সেদ্ধ থাকত সেই মোরগের মাংসে। অনন্য ছিল সেই স্বাদ।
মোরগের মাংস ছাড়াও নানা ধরনের তরকারি মিলত তখন মশরাফিয়াতে। এখনও অবশ্য মেলে কিছু কিছু। সেই সময়ে ছোটো ইছামাছ দিয়ে রান্না করা কচুশাক, আস্ত বাচা মাছের ভাজা এবং সাতকরা (এক ধরনের সুগন্ধযুক্ত তিতা সবজি) দিয়ে প্রস্তুতকৃত ছোটো মাছ, ডাল কিংবা খাসির মাংস ছিল আমার পছন্দের তালিকার শীর্ষে। এর বাইরে মাঝেমধ্যে পাওয়া যেত বাইল্লাকড়া, রানিমাছ আর মহাশোলের ঝোল (এখন এ তিনটি মাছই বিলুপ্তির পথে)। সরষে তেল দিয়ে বানানো টাকি ভর্তাও ছিল এ রেস্টুরেন্টের পরিচিত এক মেন্যু। বাচা মাছের কড়কড়ে ভাজার সঙ্গে মুলার টুকরো ক্যাঁচক্যাঁচ করে খেতাম আমরা, অপূর্ব সেই স্বাদের অনুভূতি এখনও জিভে পানি এনে দেয়।
মশরাফিয়ায় আরও একটি খাবারের কথা খুব মনে পড়ে। তখন প্রায়ই সিলেটের কুশিয়ারা নদীতে জেলেদের জালে বাঘমাছ ধরা পড়ত, সে মাছ জেলেরা নিকারির মাধ্যমে শহরের লালবাজার মৎস্যব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতেন। লালবাজারের মৎস্যব্যবসায়ীরা চড়া দামে কেজি দরে তা বিক্রি করতেন। তবে এর আগে শহরজুড়ে মাইকিং হতো। মাইকিংয়ের ভাষা ছিল এ-রকম—‘সম্মানিত সিলেটবাসী। অদ্য … টায় লালবাজারে এক বিরাট বাঘমাছ কাটা হবে। প্রতি কেজির দাম … টাকা। যাঁরা মাছ কিনতে চান, তাঁরা আগে-আগেই চলে আসেন।’ অনেকেই বাসা-বাড়িতে সে মাছ এক থেকে দুই কেজি কিনে নিতেন। কয়েকটি ভাতের রেস্তোরাঁও এ মাছ কিনত। এভাবেই ২০ থেকে ৩০ কেজি ওজনের বাঘমাছ অনেকে সাধ্য-অনুযায়ী কেজি হিসেবে কিনে নিতেন। মশরাফিয়াতেও মাঝেমধ্যে এ মাছ কিনে নিয়ে আসা হতো আগ্রহী কাস্টমারদের জন্য। দু-একবার এই বাঘমাছ খেয়েছিও মশরাফিয়াতে।
সিলেটের মানুষ সিদল-শুঁটকি একটু বেশিই খান। মশরাফিয়ায়ও একসময় মুখি দিয়ে সিদল আর শীতের নানা প্রজাতির সবজি দিয়ে সিদল-শুঁটকি রান্না করা হতো। এ ধরনের রেসিপিকে বলা হতো ‘শুঁটকির সিরা’। এখন আর এ-পদের রান্না এখানে হয় না। তবে আগের মতো বাটা শুকনো মরিচের সিদল-ভর্তা ঠিকই হয়। এই তো কিছুদিন আগে মশরাফিয়াতে ঢাকা থেকে আসা কয়েকজন অতিথিকে নিয়ে গিয়েছিলাম। তখন ছিল বিকেল বেলা। ভিড়বাট্টা তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম। রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার রুহুল আমিনের সঙ্গে কথা বলি। তিনি স্মৃতির জাঁবর কাটেন, ‘একটা সময় মশরাফিয়ার দই ছাড়া সিলেটের বিয়ে-শাদি পরিপূর্ণতা পেত না! তখন মশরাফিয়া আর হাতে-গোনা কয়েকটা মিষ্টির দোকান ছাড়া কেউ দই তৈরি করত না। প্রতিদিন গড়ে ২০০ কেজি দই বিক্রি হতো। গাইয়ের দুধ দিয়ে দই তৈরি হতো। স্বাদও ছিল দারুণ। এখন সেটা অতীত। এখন ১০ থেকে ১৫ কেজি দই চলে। তবে ভাতের ব্যবসা এখনও আগের মতোই। ২৪ ঘণ্টা রেস্টুরেন্ট খোলা থাকায় অনেকেই রাতের বেলা খাবারের জন্য এখানে বেশি ভিড় করেন। শহরের অধিকাংশ মানুষ যখন ঘুমের প্রস্তুতি নেন, রাত একটার পর থেকে যেন তখন নতুনভাবে জেগে ওঠে মশরাফিয়া।’
মশরাফিয়ায় সেদিন যে ছেলেটি আমাদের খাবার পরিবেশন করছিলেন, তাঁর কাছ থেকেই রেসিপি জেনে নিলাম। দেখলাম, প্রায় দুই দশকের ব্যবধানে অনেক রেসিপিই এখন আর নেই। অন্যান্য রেস্টুরেন্টে যেসব তরকারি বা খাবার পাওয়া যায়, মোটামুটি এখানেও তাই মেলে। গরুর মাংস কিংবা ভেরাইটিজ ছোটো মাছের তরকারি থাকলেও বিশেষ কোনও পদ নেই, যেমন—গরুর মাংস কিংবা ছোটো মাছের সঙ্গে সিলেটের ঐতিহ্যে রূপান্তরিত হওয়া সাতকড়া মেশানো তরকারি। নেই, সেই সময়কার বিশেষায়িত পদের খাবার নেই। তবে রুই, বোয়াল, ইলিশ, পাবদা, চিংড়ি, মোরগ, খাসি—সব ধরনের তরকারিই আছে। বিরিয়ানি ও খিচুরির পাশাপাশি তান্দুরি এবং নানও এখানে এখন জনপ্রিয় খাবার। অনেকেই এসব খাবার খেতে ছুটে আসেন। প্রতিদিন গড়ে চার শ থেকে পাঁচ শ কাস্টমার খাবারের জন্য এখানে আসেন বলে হোটেল বয়রা জানিয়েছেন। তবে কাস্টমারদের বেশিরভাগই আসেন রাতের বেলা, যখন শহরের একটিও খাবারের রেস্তোরাঁ খোলা থাকে না!
সেদিন ঢাকার অতিথিদের নিয়ে নানা পদের খাবার মশরাফিয়াতে খেলাম। মন্দ লাগেনি। কিন্তু যে দিলু বাবুর্চির স্বাদ জিভে লেগে আছে, তা যেন আর পাইনি! আহা, কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই মশরাফিয়াকে ঘিরে। ভাত বা পরোটা—সবকিছুই ছিল এখানে সহজলভ্য। ছাত্র-জমানায় পড়তে পড়তে ক্ষুধা লাগলেই আমরা রাতবিরেতে দলবেঁধে বন্ধুরা ছুটে যেতাম মশরাফিয়াতে।
রেস্টুরেন্টটিকে ঘিরে স্মৃতির তো আর শেষ নেই। তখন কলেজ পেরিয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মশরাফিয়াতে খাচ্ছিলাম বন্ধু মিজানুরের সঙ্গে। সেখানেই পাশের টেবিলে খাচ্ছিলেন তিনজন তরুণী। মিজানুরের সঙ্গে বারকয়েক ওই তিন তরুণীর মধ্যে একজনের চোখ চাওয়াচাওয়ি হয়। এরপর সেখানেই আলাপ। সেই আলাপের সূত্র ধরে তাদের প্রেম, ঘনিষ্ঠতা। তানিয়া নামের সেই মেয়েটি পড়ত সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রেম একসময় বিয়েতে গড়ায়। মিজানুর-তানিয়ারা এখন বিলেত-প্রবাসী। কিন্তু যতদিন ওরা দেশে ছিল, তাদের সেই পরিচয়ের দিনটি অর্থাৎ ১৭ জানুয়ারি আমরা নিয়ম করে রাতের বেলা মশরাফিয়াতে খেতাম। এ-রকম কতভাবে যে মশরাফিয়া জড়িয়ে গেছে আমার জীবনের সঙ্গে, তার কোনও সীমা-পরিসীমা নেই!
একরাতের একটি ঘটনা লিখে আপাতত এ লেখার ইতি টানি। রতনদা আর আমি। রতনদা আমার এক ব্যাচ আগের। আমি একাদশ শ্রেণিতে, রতনদা দ্বাদশে। রাত দুইটার দিকে ছাত্রাবাস থেকে বেরিয়েছি মশরাফিয়াতে খাব বলে। পরোটা আর ডিমভাজা নাকি ভাত-ডাল-ডিমভাজা, কোন পদ খাব—তা নিয়ে আলাপ করতে করতেই আমরা হাঁটছিলাম। যখন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কার্যালয় পেরিয়েছি, ঠিক উলটো দিকে যেখানটাতে দেহজীবী নারীরা দাঁড়িয়ে থাকতেন খদ্দেরের আশায়, ঠিক এর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন কয়েকজন পুলিশ। তখন সড়কের মাঝখানে এখনকার মতো রেলিং-দেওয়া ডিভাইডার (সড়ক বিভাজক) ছিল না। আমাদের দেখে কী মনে করে জানি পুলিশ সদস্যরা দ্রুত ছুটে এলেন। পুলিশের একজন সদস্য বললেন, ‘মাগিবাজি করতে আইছস?’ আচমকা পুলিশের এমন অভিব্যক্তিতে আমরা ঘাবড়ে গেলাম। বললাম, ‘আমরা মশরাফিয়াতে খেতে এসেছি। থাকি চালিবন্দর ছাত্রাবাসে।’ ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এই ছাত্রাবাসের নাম শহরের অনেকেই চেনেন। কিন্তু আমাদের জবাবে পুলিশ সদস্যরা ভাবলেশহীন, ছাত্রাবাসটি তাঁরা চিনলেন বলে মনে হলো না। এবার পুলিশের দুজন সদস্য একসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘উঠ! গাড়িতে উঠ!’ এখন তাহলে উপায়? আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলাম! ঘোর না-কাটতেই একজন পুলিশ সদস্য আমাদের আটক করে তাঁদের টহলের গাড়ি টেম্পুতে নিয়ে তুললেন। আমরা যতই তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করছি, তাঁরা যেন ততই কথা বলতে নারাজ। টেম্পুতে বসার কিছুক্ষণ পর দেখি, একজন নারীকেও টেম্পুতে তোলা হয়েছে। তাঁর শরীর থেকে সস্তা পারফিউমের গন্ধ ভেসে আসে। বুক ধকধক করতে থাকে অজানা আশঙ্কায়! ঘড়ির কাঁটার এক মিনিট সময় যেতে যেন অনন্তকাল ব্যয় হচ্ছে! এদিকে খিদের ঠেলায় পেট ছোঁ-ছোঁ করছে। খিদেটা চাড়া দিতেই মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়। পুলিশ সদস্যদের একজনকে ধুরুধুরু বুকে বলি, ‘আমরা ছাত্রমানুষ। পড়তে গিয়ে ক্ষুধা লাগলে প্রায়ই রাতের বেলা মশরাফিয়াতে খেতে যাই। আজও যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমাদের কেন কিংবা কী দোষে আটক করলেন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না! যদি আমাদের চলাফেরায় সন্দেহ হয়, তাহলে মশরাফিয়াতে চলুন। তাঁদের রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার থেকে শুরু করে হোটেলবয়রা তো কমবেশি সবাই আমাদের চেনে!’
আমার কথা শেষ হতে না-হতেই ওই নারী মুখ খোলেন। অনেকটা দৃঢ় কণ্ঠেই পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, ‘এঁদের আমিও চিনি। ওরা প্রায় রাতেই ওই রাস্তা দিয়ে যায়। অযথা তাঁদের আটকাইয়েন না।’ ওই নারীর কথায় মনে সাহস আসে, বল পাই। চোখ তুলে তাকাই তাঁর দিকে। পুরো মুখ ওড়না দিয়ে প্যাঁচানো। পাশের সড়কবাতির আলো আবছা-আবছা ওই নারীর মুখমণ্ডলে যেন ঢেউ খেলে যাচ্ছে বার বার। কেবল তাঁর দুই জোড়া চোখ দেখা যাচ্ছে। চোখের পাতা আর ভ্রুতে কালো কুটকুটে কাজল-আঁকা। ‘যা, ভাগ!’—পুলিশের এমন কথায় সম্বিত ফিরে আমাদের। ব্যস, লাগালাম দৌড়। না, মশরাফিয়ার দিকে নয়, ছাত্রাবাসের দিকে। মশরাফিয়ার কতশত স্মৃতির সঙ্গে ওই রাত আর অচেনা-অজানা নারীর স্মৃতিও জড়িয়ে আছে। কী বিপদ আর কেলেংকারি থেকেই—না সে রাতে ওই নারী আমাদের উদ্ধার করলেন! অথচ সেদিন তাঁকে কৃতজ্ঞতাও জানানো হলো না। এ ঋণ বোধ নিয়ে আজীবনই বয়ে বেড়াতে হবে আমাদের!