লিখেছেন সুদীপ্ত সালাম
আমাদের দেশে ফটোগ্রাফিটা এখনো সবল নয়। এখনো আলোকচিত্রীর জন্য চাকরি সুলভ নয়, অনেকের কাছেই তা নিছকই শখ এবং অনেকের ধারণা আলোকচিত্র গুগল করলেই মেলে। আশার কথা হলো, দিন দিন আমরা উন্নতির শিখরের দিকে এগুচ্ছি। আমাদের ফটোগ্রাফি এখন তার বয়ঃসন্ধিকাল পার করছে।
এই উন্নতির শিখরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পেছনে কাজ করেছে—এখনো করছে কিছু প্রতিষ্ঠান এবং একক ব্যক্তি। প্রীত রেজা তাদের একজন। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে যেখানে ফটোগ্রাফিই অনেকটা অবহেলিত—সেখানে আলোকচিত্রী হিসেবে তারকা খ্যাতি অর্জন করেছেন তিনি।
বাণিজ্যিক আলোকচিত্রী হিসেবে তাঁর সফলতা জ্বলজ্বলে। তাঁর মতে, ‘শুধু আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার আশায় এই পথে পা বাড়ালে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। আগ্রহ, ভালোবাসা থাকলে, পরিশ্রম এবং সততার মাধ্যমে লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে।’
তবে আমাদের আলোচনা তাঁর খ্যাতি নিয়ে নয়—তাঁর অবদান নিয়ে। আলোকচিত্র নিয়ে নয়—আলোকচিত্রের অনুষ্ঠান নিয়ে। আমরা দেখলাম প্রীত রেজা শুধু একজন বাণিজ্যিক আলোকচিত্রী হিসেবেই সন্তুষ্ট থাকলেন না। ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা নিয়ে মঞ্চ কাঁপিয়ে বেড়ালেন না। তিনি এমন কিছু উদ্যোগ নিলেন, যা বাংলাদেশের ফটোগ্রাফির ইতিহাসে অতুলনীয়। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম শুধুমাত্র ফটোগ্রাফি নিয়ে একটি ধারাবাহিক টেলিভিশন অনুষ্ঠান শুরু করেন। তারপর আরেক মাইলফলক—রেডিওতে শুরু ফটোগ্রাফি নিয়ে দেশের প্রথম রেডিও অনুষ্ঠান। প্রীত রেজার খ্যাতি, ফটোগ্রাফি, বক্তৃতা, লেখালেখি ইত্যাদি বিষয় বাদ দিলেও, তিনি কমপক্ষে এই দুটি অবিস্মরণীয় উদ্যোগের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বলে আমার বিশ্বাস।
টিভির অনুষ্ঠানটির নাম ছিল ‘ডার্করুম’। এর পরিকল্পনা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনায় প্রীত রেজা। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়। এটিএন নিউজ কর্তৃপক্ষকে অভিবাদন জানাতে হয়। ফটোগ্রাফি নিয়ে একটি ধারাবাহিক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা চাট্টিখানি কথা নয়। শুরুর দিকে অনুষ্ঠানটির পৃষ্ঠপোষকতা করেছে ফুজিফিল্ম। তারাও সাধুবাদের দাবিদার। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই প্রথম দেশের আনাচে-কানাচে থাকা আলোকচিত্রীরা—বিশেষ করে তরুণ আলোকচিত্রীরা একযোগে একটি প্লাটফর্মে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ পেল। অনুষ্ঠানটিতে থাকত ফটোগ্রাফির কারিগরি বিষয়, দেশ-বিদেশের তথ্য, দর্শকদের পাঠানো আলোকচিত্রের রিভিউ, কুইজ প্রতিযোগিতা এবং সবশেষে আলাপচারিতা। শেষের অংশটির প্রতি দর্শকদের আগ্রহ ছিল বেশি। এই পর্বের মাধ্যমে আনা হতো দেশের একজন জ্যেষ্ঠ অথবা প্রতিশ্রুতিশীল আলোকচিত্রীকে। দীর্ঘ আলোচনায় উঠে আসতো অতিথি আলোকচিত্রীর সংগ্রাম, অভিজ্ঞতা ও চিন্তাভাবনা। তা থেকে অনেকেই খুঁজে পেতেন উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা। দুঃখের বিষয়, দেড় শ’রও বেশি পর্ব করার পর, জনপ্রিয় এই অনুষ্ঠানটি ২০১৮ সালের অক্টোবরের পর আর টিভির পর্দায় দেখা যায়নি। প্রীত রেজা অবশ্য আশাবাদী, আবার টিভির পর্দায় ভেসে উঠবে ‘ডার্করুম’। ফিরে আসা উচিত। কেননা, ‘ডার্করুম’ শুধু প্রথমই নয়—ফটোগ্রাফির একমাত্র টিভি অনুষ্ঠানও।
সগৌরবে চলছে ‘ডার্করুম’। এসময়ই—২০১৭ সালের জানুয়ারিতে এবিসি রেডিওতে শুরু হলো ফটোগ্রাফি নিয়ে দেশের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র রেডিও অনুষ্ঠান ‘ফটোটক উইদ প্রীত রেজা’। এখানেও পরিকল্পনা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনায় প্রীত। সঙ্গে আছেন আর জে নিতুল। পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই চলছে অনুষ্ঠানটি। প্রীত ও নিতুলের যুগলবন্দি অনুষ্ঠানটিকে করেছে প্রাণবন্ত। অনুষ্ঠানটিকে ফেসবুক লাইভের সঙ্গে যুক্ত করায় নবীন আলোকচিত্রীরা সরাসরি সংযুক্ত হতে পারছেন আলোচনায়। আশা করি, অনুষ্ঠানটি সহসা বন্ধ হবে না।
দেশের ফটোগ্রাফিতে অসামান্য ভূমিকা রাখা এই অনুষ্ঠান দুটি করার পেছনে কোন ভাবনা কাজ করেছে—এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রীত রেজার জবাব, ‘আমি নিজেকে চ্যালেঞ্জ দিই—আমি আসলে এই ফটোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রির জন্য কি করতে পারি? আমি নিজেকে একজন ফাইটার ভাবি।…আমাদের সব কিছু ঢাকাকেন্দ্রিক। সে জায়গা থেকে আমি ভাবছিলাম, চাঁদপুরের একটা ছেলে যদি নাসির আলী মামুনের সঙ্গে কথা বলতে পারে, শহিদুল আলমের সঙ্গে কথা বলতে পারে তাহলে কেমন হয়? আমি চেয়েছি স্বপ্নটাকে ছড়িয়ে দিতে। আমি চেয়েছি, কেউ আমাকে প্রশ্ন করুক, “আমি পঞ্চগড়ে ছবি তুলি, আমার ছবি সূর্যের আলোতে কালো হয়ে যায়, আমি কিভাবে ছবিটা করতে পারি?” আমি সেটার লাইভ উত্তর দিতে চেয়েছি।’
তিনি আমাকে আরো বলেছেন, তিনি আসলে ফটোগ্রাফিচর্চার ধারায় নিজের পদচিহ্ন রাখতে চান। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ইতিহাস তাকে হতাশ করবে না। এই অভাবনীয় অনুষ্ঠান দুটির জন্য হলেও ইতিহাসে তিনি টিকে থাকবেন।