আমলনামায় এন্তার অভিযোগ

দুর্নীতির মহাসাগর স্বাস্থ্য বিভাগ। স্বাস্থ্য খাতে এমন লাগামহীন দুর্নীতি ও জালিয়াতির নেপথ্যে রয়েছে সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত পুরো সিন্ডিকেটই পদত্যাগকারী মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের অনুসারী। তার অনুসারীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলায় চিকিৎসকদের বদলি এবং ওএসডি করা হতো। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের প্রশ্রয়ও দিতেন তিনি। এখন তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছে দুদক। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অভিমত, দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্য বিভাগে দুর্নীতির যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, তা ভাঙতে হলে পুরো খাতটি ঢেলে সাজাতে হবে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সরিয়ে যোগ্য ও সৎ কর্মকর্তাদের সমন্বয় ঘটাতে হবে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যর্থতা, কেনাকাটায় কেলেঙ্কারি, জেকেজি হেল্‌থ কেয়ারের ভুয়া রিপোর্ট, রিজেন্ট হাসপাতাল কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে তার নেতৃত্বাধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। এর আগে গত বছর দেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও তার আগে চিকুনগুনিয়া রোগ প্রতিরোধেও তার নেতৃত্বাধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ব্যর্থতার কাতারে ছিল বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন।
প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের হাতেই জিম্মি হয়ে আছে পুরো স্বাস্থ্য খাত। আর এই সিন্ডিকেটের নেপথ্য নায়ক এই খাতের মাফিয়া ডন হিসেবে পরিচিত মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। দীর্ঘদিন পর্দার আড়ালে থেকে নাড়ছেন নিজের গড়া সিন্ডিকেটের কলকাঠি। গত মাসে মিঠু সিন্ডিকেটের বিষয়ে মুখ খোলেন নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী। সরকারের কাছে ‘মিঠু সিন্ডিকেট’ ভেঙে দেয়ারও দাবি জানান তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ ২০১৬ সালের ১লা সেপ্টেম্বর মহাপরিচালক পদে নিয়োগ পান এবং ২০১৯ সালের ১৫ই এপ্রিল তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। এর আগে ২০১৯ সালের ২৭শে মার্চ আবার দু’বছরের জন্য নিয়োগ পান। সেই হিসাবে আগামী বছরের ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করার কথা তার। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের রোগী শনাক্তকরণ পরীক্ষা একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর-এ সীমাবদ্ধ রাখা, করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা না রাখা, সিএমএসডি’র মাস্ক ক্রয়ে দুর্নীতি, যাচাই-বাছাই না করে রিজেন্ট হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসার অনুমোদন, ভুয়া করোনা সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান জেকেজি হেল্‌থ কেয়ারের সঙ্গে চুক্তি ও করোনার প্রকোপ এক-দুই বছর থাকতে পারে এমন বক্তব্য দিয়ে সমলোচনার মুখে পড়েন। এসব অভিযোগ মাথায় নিয়ে তীব্র বিতর্কের মধ্যেই তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে।
পদত্যাগ করলেও দায় এড়াতে পারেন না: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু এই পদত্যাগের ফলে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ থেকে তিনি দায়মুক্তি পাবেন না বলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্মকর্তারা মনে করেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত চলমান রয়েছে। বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে তার সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কাজেই তিনি পদত্যাগ করলেও এখান থেকে তার দায়মুক্তি ঘটবে না। বরং দুদক তদন্তের স্বার্থে তাকে তলব করা বা যেকোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। দুর্নীতির খোঁজে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অভিযানও চালিয়েছে দুদক। ১৯শে জুলাই অভিযানে দুদক কর্মকর্তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ বিভিন্ন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। চার সদস্যের অনুসন্ধানী দল আরো তদন্তের স্বার্থে ফাইলপত্র চাইলে মহাপরিচালক পরের দিন প্রতিনিধি দিয়ে দুদকে ফাইল পাঠান।
সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যর্থতা: অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ তিন মাস আগে ২৯শে মার্চ বলেন, সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মনে করে গরম আবহাওয়া ও আর্দ্রতার কারণে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বেশি হবে না। পরবর্তী সময়ে দেশে করোনার সংক্রমণ ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে। আইইডিসিআর একটি রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান হলেও করোনা সংক্রমণের শুরুতে এই প্রতিষ্ঠানটিকে একমাত্র রোগ নির্ণয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দেশে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ব্যাপক সমালোচনার মুখে ও করোনার রোগী বাড়তে থাকায় মার্চের শেষদিকে পিসিআর ল্যাবরেটরি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আইইডিসিআরকে রোগ নির্ণয় ও ব্রিফিংয়ের কাজে ব্যস্ত রাখায় করোনার সংক্রমণ নিয়ে কোনো গবেষণা কার্যক্রম করা সম্ভব হয়নি। শুরু থেকে ডিজি নমুনা পরীক্ষার দায়িত্ব আইইডিসিআর’র ওপর ছেড়ে রেখেছিলেন। অথচ বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা, প্রেস ব্রিফিং আইইডিসিআর’র কাজের মধ্যে পড়ে না। আইইডিসিআর’র মূল কাজ রোগতাত্ত্বিক গবেষণা, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংসহ সার্বিক বিষয় মনিটরিং এবং সে অনুযায়ী করণীয় সম্পর্কে সরকারকে পরামর্শ দেয়া। তার ওই সিদ্ধান্তটি ছিল ভুল। কারণ একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানের হাতে নমুনা পরীক্ষা থাকায় আক্রান্ত সবাইকে পরীক্ষার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। এতে সংক্রমণের প্রকৃত অবস্থা কী তা অজানা রয়ে গেছে। আর একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে তিনি সারা দেশের মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন।
করোনা এক-দুই বছর থাকবে: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গত ১৮ই জুন করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো তথ্য নিয়ে হাজির হন। তিনি ওইদিনের স্বাস্থ্য বুলেটিনে বলেন, করোনা পরিস্থিতি এক, দুই বা তিন মাসে শেষ হচ্ছে না; এটি এক থেকে দুই বছর বা তার চেয়েও বেশিদিন স্থায়ী হতে পারে। তার এ বক্তব্যের পর দেশজুড়ে আতঙ্ক তৈরি হয়। ডিজি’র ওই বক্তব্য সরকারকেও বিব্রত করে। তবে ডিজি একদিন পর তার বক্তব্যের জন্য ক্ষমাও চেয়েছেন। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর অভিযোগ তুলে তাকে অপসারণের দাবি করেন। তার এই বক্তব্যের পরদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মহাপরিচালককে দায়িত্বজ্ঞানহীন আখ্যা দিয়ে তাকে এ ধরনের বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান।
কেনাকাটায় অনিয়ম: করোনার রোগীর চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নকল এন-৯৫ মাস্ক কিনার পর ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। এরপরও মাস্ক, গ্লাভস, পিপিইসহ বিভিন্ন সুরক্ষাসামগ্রী কেনাকাটা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় গত ২২শে মে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) পরিচালককে সরিয়ে দেয়া হয়। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায়ে গত ৪ঠা জুন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে বদলি করা হয়। সরানো হয় মন্ত্রণালয়ের  মিডিয়া সেলের প্রধান ও অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খানকেও।
স্বাস্থ্যকর্মীদের হোটেলে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা: করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালকে করোনা ডেডিকেটেড করা হয়। এরপর আরো কিছু হাসপাতালকে করোনার জন্য নির্ধারণ করা হয়। এসব হাসপাতালে দায়িত্ব পালনকারী চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাপনা নিয়ে চরম অব্যবস্থাপনা ছিল। পরবর্তী করোনার চিকিৎসা পালনকারী চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ঠিক করা হয়।
জেকেজি হেল্‌থ কেয়ার দুর্নীতি: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের আগ্রহে শুরুতেই বিতর্কিত এবং অভিজ্ঞতাহীন জেকেজি হেল্‌থ কেয়ারকে করোনার নমুনা সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হয়। ওই নমুনা সংগ্রহের সুযোগ পেয়ে প্রতিষ্ঠানটি ১৫ হাজার ২৬০টি ভুয়া সনদ দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এই অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জেকেজি’র অনুমোদন দেয়ার আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ওই প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম সরজমিন পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। অথচ করোনা সংক্রমণের পর থেকে তিনি কোনো হাসপাতাল পরিদর্শনে যাননি।
রিজেন্ট হাসপাতাল কেলেঙ্কারি: করোনা রোগীর চিকিৎসা প্রদানে রিজেন্ট হাসপাতাল গত ২১শে মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে চুক্তি করে। এর পর প্রতিষ্ঠান করোনার নমুনা পরীক্ষা না করে অর্থ আদায় ও রোগীর কাছ থেকে চিকিৎসা প্রদানের বিল নিয়ে সরকারের কাছ থেকে টাকা আদায়ের মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি আত্মসাৎ করে। হাসপাতালটির লাইসেন্স নবায়ন না থাকা সত্ত্বেও চুক্তি করে। রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক শাহেদ করিম গ্রেপ্তারের পর ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়। রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা নিয়ে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে গত ১১ই জুলাই একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাতে বলা হয়, মার্চে যখন কোনো হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তি নিচ্ছিল না, তখন রিজেন্ট হাসপাতাল কোভিড ডেডিকেটেড হিসেবে চুক্তি করার আগ্রহ প্রকাশ করে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সে সময় রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের এই বক্তব্য প্রকাশের একদিন পর ১২ই জুলাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’ বলতে মহাপরিচালক কী বোঝাতে চেয়েছেন, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয় তার কাছে। তিনি এর ব্যাখা দেন। কিন্তু বিষয়টি বিব্রত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে।
এদিকে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বিক্রয় ও সংগ্রহ শাখা থেকে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ২০১৭ সালের ১৯শে জুন প্রশসানিক শাস্তি হিসেবে বদলি করা হয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা মনির উজ্জামান চৌধুরীকে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলাও রয়েছে। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অসাধু সিন্ডিকেটটি বড় অঙ্কের বাণিজ্যের মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি চক্রের সঙ্গে হাত করে তাকে ফিরে এনে আবার চেয়ারে বসাতে তৎপর রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এতে হাত ছিল অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদের।
স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি নিয়ে তীব্র বিতর্কের মধ্যে ডিজি’র পদত্যাগকে কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে-টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতির সিন্ডিকেট তো একদিনে গড়ে ওঠেনি। জবাবদিহি না থাকায় বছরের পর বছর ধরে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তার পদত্যাগের মধ্যদিয়ে একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। বহু অনুসন্ধান করতে হবে। সুষ্ঠু তদন্ত করে যারা জড়িত তাদেরকে জবাবদিহিতায় নিয়ে আসতে হবে। তদন্ত না হলে দুর্নীতি, দুর্নীতির জায়গাই থেকে যাবে। তার পদত্যাগেই যেন শেষ না হয়। শুধু একজনে দুর্নীতি করেনি। বহুজনে যোগসাজশে দুর্নীতি করেছে। এখানে কেনাকাটায় বেসরকারিখাতও জড়িত। যারা ক্ষমতাবান। তারা এর সঙ্গে জড়িত।

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ