ভোরের আলো ডেষ্ক: মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের নারী ও মানব পাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা আজম খান ওরফে ডন আজম। ভয়ঙ্কর এ ডনের অপরাধের হাতেখড়ি সিঁধেল চুরি দিয়ে। এরপর শিবির ক্যাডার ওসমান বাহিনীর হাত ধরে হয়ে ওঠেন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। বাংলাদেশ থেকে আমিরাত পর্যন্ত বিস্তৃত তার পাচার সিন্ডিকেট। হালে সম্পদের শেষ নেই তার। দুবাই শহরে রয়েছে তার চারটি বিলাসবহুল হোটেল। আছে বার আর ড্যান্স ক্লাব। দুর্ধর্ষ এ ডনের উত্থান হার মানিয়েছে হলিউড সিনেমার যে কোনো ডনের উত্থান কাহিনিকেও! সিআইডি ও চট্টগ্রাম পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে তার উত্থানের চমকপ্রদ তথ্য। আজম খান স্বীকার করেছেন তার অপরাধ। গতকাল ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আজম খানসহ দুজন।
সিআইডি সূত্র জানান, দুবাইতে নারী পাচারকারী চক্রের গডফাদার আজম খানের বিলাসবহুল হোটেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। দুবাইতে চার তারকাযুক্ত তিনটি ও তিন তারকাযুক্ত একটি হোটেলের অন্যতম মালিক এই আজম। হোটেলগুলো হচ্ছে- ফরচুন পার্ল হোটেল অ্যান্ড ড্যান্স ক্লাব, হোটেল রয়েল ফরচুন, হোটেল ফরচুন গ্র্যান্ড ও হোটেল সিটি টাওয়ার। অর্ধশতাধিক দালালের মাধ্যমে তিনি অপরাধ সাম্রাজ্য পরিচালনা করছেন। এ ছাড়া একাধিক ট্রাভেল এজেন্সি ও বিদেশি কিছু বিমান সংস্থা তার অপরাধকাজে সহযোগিতা করত। গত আট বছরে সহস্রাধিক নারী পাচারের গডফাদার আজম খান দুই হাতে টাকা কামিয়েছেন। তিনি টাকা পাচার করেছেন বলে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) জিসানুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ৬টি হত্যাসহ আজম খানের বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা রয়েছে। দুবাইতে বাংলাদেশ দূতাবাস পাসপোর্ট রেখে আজম খানকে দেশে পাঠায়। দেশে ফিরে আসার বিষয়টি পুলিশ অবহিত ছিল না। এ সুযোগে আজম খান নতুন পাসপোর্ট করে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছিলেন। চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হক বলেন, ‘আজম খানের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে পুলিশ। তার বিষয়ে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। পাওয়া তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, দরিদ্র পরিবারের সন্তান আজম খান ওরফে মোজাহের ওরফে ডন আজিমের সিঁধেল চুরি মাধ্যমে অপরাধের হাতেখড়ি। একসময় তার পরিচয় হয় দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার ওসমানের সঙ্গে। তার সংস্পর্শে এসে দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠেন আজম। ২০০৪ সালে ফটিকছড়ি উপজেলার নানুপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগ সভাপতি কামাল উদ্দিনকে হত্যার মাধ্যমে আলোচনায় আসেন আজম। এরপর করতে থাকেন একের পর এক অপরাধ। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ওসমানের প্রিয়ভাজনে পরিণত হন আজম। তাকে করা হয় ওসমান বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড। এরপর খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, প্রতারণা, সন্ত্রাস, ছিনতাই, লুট-ডাকাতিসহ নানা অপরাধে আরও বিস্তৃতি ঘটে আজমের। ২০১০ সালে ওসমান বাহিনীর প্রধান র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান আজম। কিছুদিন দেশের বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে থেকে চলে যান সংযুক্ত আরব আমিরাতে। আমিরাতে গিয়ে নারী পাচার ও সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পুলিশের ধারণা, আজমের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কয়েক হাজার নারী পাচার হয়েছে। আমিরাতে পাড়ি দেওয়ার পর আরও বিস্তার ঘটে তার সাম্রাজের। দীর্ঘ হতে থাকে প্রতারণা, জালিয়াতি ও অপহরণের তালিকা। জালিয়াতির মাধ্যমে আজম দুটি পাসপোর্ট গ্রহণ করেছেন রাজশাহী ও চট্টগ্রামের দুটি পৃথক ঠিকানা ব্যবহার করে। রাজশাহীর ঠিকানা ব্যবহার করে নেওয়া পাসপোর্টে নিজের নাম উল্লেখ করেন মোহাম্মদ আজিম উদ্দিন, পিতার নাম আবদুল আলম। ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে নেওয়া এ পাসপোর্ট নম্বর হচ্ছে R-0579469. এ পাসপোর্টে স্থায়ী ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে চট্টগ্রাম হাটহাজারী উপজেলার কাটিরহাট এলাকা। তার নেওয়া অন্য পাসপোর্টে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তার ফটিকছড়ির গ্রামের বাড়ি। এ পাসপোর্টে নিজের নাম উল্লেখ করেছেন মো. আজম। এ পাসপোর্ট নম্বর H-0165128. ফটিকছড়ি থানায় হওয়া একটি প্রতারণা মামলায় আজমকে তিন বছরের কারাদন্ড ও ২ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। ২০১৮ সালে লিয়াকত আলী নামে এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে ২০ কোটি টাকার চেক নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে আজমের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ব্যবসায়ী লিয়াকত আলী একটি প্রতারণা ও অপহরণ মামলা করেছেন।