দেশের মানুষ খাবার পায়না, চিকিৎসা পায়না আর কানাডার বেগমপাড়ায় চলছে আমাদের মৌজ মাস্তির আয়েশি জীবন

ফারজানা ইসলাম লিনু

তলা বিহীন ঝুড়ির তালি টেকসই করা যায়না সেই শুরু থেকেই। বছর বছর তালি দিয়েও কাজ হয়না। দক্ষ কারিগর ও মজবুত বাঁশ বেতের অভাবে নতুন ঝুড়িও বানাতে পারিনা। তাই যত্ন করে ধরে রাখতে হয় তলাবিহীন ঝুড়িটাকে। উন্মুক্ত ঝুড়ির তলা নেই, মুখে ঢাকনা নেই। ঝুড়ির ভেতরের জিনিস নিতে তস্করেরা সদা তৎপর। দেশের কষ্টার্জিত টাকা বিদেশে পাচার করে সম্পদের পাহাড় গড়া বিনাশ্রমের নব্য ধনীদের জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

দেশের মানুষ খাবার পায়না, চিকিৎসা পায়না আর কানাডার বেগমপাড়ায় চলছে আমাদের মৌজ মাস্তির আয়েশি জীবন। সুইস ব্যাংকেও জায়গা হচ্ছেনা টাকা। এনবিআরের আয়কর বিবরণীতে এমপি শহিদের ব্যংক আমানত ছাড়া দেশে কোন সম্পদ নেই। অথচ এই লোক পঞ্চাশ কোটি টাকা খরচ করে সস্ত্রীক এমপি হয়েছে।

দেশের প্রধানমন্ত্রী, এনবিআরের চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট অনেকেই হুমকি, আশ্বাস দিয়েছেন সুইস ব্যাংকে অবৈধ ভাবে এযাবৎকালের গচ্ছিত সবার টাকা ফিরিয়ে আনা হবে, পাচারও বন্ধ করা হবে। আমরা আশায় থাকি। কিন্তু কবে হবে?

মাত্র কয়েকমাসের করোনায় স্থবির, অচল, বিপর্যস্ত দেশের অর্থনীতি। মধ্যবিত্ত নেমেছে রাস্তায়, নিম্নবিত্ত গলা ছেড়ে গায়… “সাগরে পেতেছি শয্যা শিশিরে কি ভয়”। আর উচ্চবিত্ত করোনা থেকে বাঁচতে ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে করে চলে যায় বিদেশে। অভাগাদের করোনা শনাক্তেও যে কত ঝক্কি, আর চিকিৎসাতো নাই বললেই চলে। পনেরো দিনে সাড়ে সাত লাখ টাকার চিকিৎসা বিল দিতে পারবে কজন বাংলাদেশি? তার চেয়ে করোনায় মৃত্যুই শ্রেয়।

জেকেজি আর রিজেন্টের কাহিনীতো টক অব দ্যা মিডিয়া। করোনা টেস্টের নাম করে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার নজির একমাত্র বাংলাদেশেই থাকতে পারে। টকশোতে এসে বুঝদারি কথা বলা লোকটা কত বড় বাটপার করোনা না আসলে হয়তো জানা হতোনা। জেনেই বা কি হবে? যেই লাউ সেই কদুকে নিয়ে কয়েকদিন ধুন্ধুমার লিখালিখি চলবে। তারপর একদিন জানা যাবে জামাই আদরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সে আছে বেশ। ক্যাসিনো, শেয়ারবাজার, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভোল্ট চোরদের কিছুই হয়নি এ পর্যন্ত। ডাক্তার সাবরিনা নামের ডাইনি ও মোহাম্মদ শাহেদ ওরফে শাহেদ করিম নামের বুনো ষাঁড়েরও কিছু হবে না যথারীতি।

করোনার সাথে অকালের বন্যায় নাকাল দেশ। এই বন্যা নাকি আরো দীর্ঘস্থায়ী হবে। একে একে ডুববে দেশের আরো কত অংশ। জলমগ্ন এলাকাগুলোতে বানবাসী মানুষের হাহাকার, করোনা ছাড় দিলেও মরবো এবার ক্ষুধা আর বন্যায়। লাখ লাখ মানুষের ঠাঁই হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্রে। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে আরো এক ধাপ পেরুলো দেশ।

কুরবানিকে সামনে রেখে গৃহস্থ সারা বছর যতনে বড় করেছে গবাদি পশু। বন্যায় ডুবছে ভিটেবাড়ি। নিজেরই মাথা গুজার জায়গা নাই, গরু বাছুর রাখবে কোথায়?

কোভিড ১৯ এর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বন্ধ করতে হচ্ছে কুরবানির হাট। কিন্তু কুরবানির গরু ছাগল কেনাবেচার সাথে জড়িত লোকগুলোর কথা ভাবলে আসলেই দিশেহারা লাগে। এই পরিস্থিতিতে হাট চালু রাখাও হবে এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। করোনার শুরুতে সরকার ও বিত্তবানরা অকৃপনভাবে এগিয়ে এসেছিলেন কর্মহীন ও বিত্তহীনদের সহায়তায়। সরকার একা আর কত দিয়ে যাবে? তাও সরকারি সহায়তা এখনো অব্যাহত আছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। আর বেশিরভাগ বিত্তবানদের বিত্তও তলানিতে। নিজেদের ভাত কাপড় নিয়েই তারা শঙ্কিত আর দান খয়রাত করবে কি?

আমাদের জোড়াতালির ঝুড়িতে জমা করা সম্পদ যদি আজ জমা থাকতো তাহলে কষ্টেসৃষ্টে চলে যেতো আমাদের করোনা কাল। আজ ক্ষুধা, বন্যা আর করোনায় দিশেহারা আমাদের মধ্যম আয়ের দেশ। সম্পদের জ্ঞান ও গরিমা আমাদের টক শো পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। তাইতো অমন অসৎ লোকগুলো নিশুতি রাতে আসে আমাদের আশার কথা শুনাতে। কত আর চলবে আমাদের অরণ্যে রোদন! করোনাও যদি বদলাতে পারেনি আমাদের আর বদলাবো না আমরা। নাসিরুদ্দিন হোজ্জার একটা গল্প দিয়েই শেষ করছি আমার অরণ্যে রোদন।

হোজ্জা শহরে দর্জির কাজ করে। তাও রাজ খলিফা (দর্জি)। প্রতিবার রাজার আচকান বানিয়ে বেঁচে যাওয়া কাপড় সে রেখে দেয় নিজের কাছে। কিছুদিন পর জোড়াতালি দিয়ে হুবুহু একটা রাজপোশাক বানায় নিজের জন্য। খবরটা রাজার কানে যায়। ফাক্কড় হোজ্জার কাছে সদুত্তর মেলেনা কোনদিনই। তর্কে সে রাজা, উজির, নাজিরকেও হারিয়ে দেয়। তাই রাজা হোজ্জার সাথে কুতর্কে না গিয়ে সভাসদদের নিয়ে বসলেন। সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হলো রাজপরিবারের কাপড় বানানোর কালে হোজ্জাকে বন্দি রাখা হবে রাজবাড়ির অতিথিশালায়।

যথারীতি কাপড়, সেলাইমেশিন, সুঁইসুতা, কুন্দন, জরি, পাথর দিয়ে হোজ্জাকে রাখা হলো অতিথি ঘরে। হোজ্জা গভীর মনোযোগে রাজপোশাক বানাতে ব্যস্ত। করিৎকর্মা জামাইয়ের দেখা না হোজ্জা বউ বিরহে কাতর। হোজ্জাকে খুঁজতে খুঁজতে চলে আসে রাজবাড়ি। রাজার অনুমতি সাপেক্ষে হোজ্জা বউকে নিয়ে যাওয়া হয় হোজ্জার বন্দীশালার সামনে। চুরির আশংকায় জানালা একটু ফাঁক করে হোজ্জার সাথে সাক্ষাতের একটু সুযোগ করে দেয়া হয়।

বউকে দেখে তো হোজ্জা রেগেমেগে আগুন। আমার রাজকাজে ব্যাঘাত ঘটাতে এসেছো পুড়ামুখী, বলেই পায়ের নাগরা খুলে বউয়ের দিকে ছুঁড়ে মারে। হতভাগিনী বউ জোড়াবিহীন নাগরা হাতে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে। রাজপোশাক বানানো শেষ হলে হোজ্জাকে ঝেড়েঝুড়ে বিদায় দেয়া হয় রাজবাড়ি থেকে। রাজামশাই ভীষণ খুশি, এইবার ব্যাটাকে জব্ধ করা গেলো আচ্ছামতো।

কিছুদিন পর হোজ্জাকে নতুন রাজ পোশাকে বাজারে ঘুরতে দেখে কোতোয়াল ধরে নিয়ে আসে রাজার সামনে। রাজাতো অবাক। এতো নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে হোজ্জা এই কাপড় চুরি করলো কেমনে? গর্দান যাবার ভয়ে হোজ্জা হাত কচলে রাজাকে বললো, হুজুর যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বই মিত্যা বলিবো না। কাটা,কাপড়গুলো তুলে রেখেছিলাম নাগরার ভেতর। রাগ করে বউকে ঢিঁল মারতে গিয়ে কাপড় সমেত নাগরা চলে যায় আমার বাড়িতে। বাকি ইতিহাসতো আপনার জানা। এইটুকু শুনে রাজার সাথে পুরো পারিষদ তব্দা।

লেখক: শিক্ষক ও কথাশিল্পী

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ