ঢাকা থেকে নেগেটিভ সনদ নিয়ে যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছানোর পর পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ যাত্রী পাওয়ায় ঢাকার সাথে ফ্লাইট চলাচল বন্ধের তালিকায় যোগ হয়েছে ইতালি। এর আগে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীনও ঢাকার সাথে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলো একই কারণে।
এর মধ্যে বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা র্যাব তদন্ত করে ঢাকার রিজেন্ট হাসপাতাল থেকে করোনাভাইরাস পরীক্ষার হাজার হাজার ভুয়া রিপোর্ট দেয়ার প্রমাণ পেয়েছে। এমনকি নমুনা না নিয়ে কিংবা নমুনা নিয়ে ফেলে রেখে টাকার বিনিময়ে মনগড়া রিপোর্ট দেয়ার প্রমাণ পেয়েছে র্যাব, যে খবর মুহূর্তেই ছড়িয়েছে সারাবিশ্বে।
বিমান ও পর্যটন সংক্রান্ত ম্যাগাজিন দ্য বাংলাদেশ মনিটরের সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলম বলছেন, বাংলাদেশের সাথে যোগাযোগ আছে এমন প্রতিটি দেশ ও এয়ারলাইন্স তীক্ষè নজর রাখছে করোনা টেস্ট নিয়ে ঢাকায় কী হচ্ছে তার দিকে। জনাব আলম বলেন, দ্রæত এমন কোনো ব্যবস্থা চালু করতে হবে যাতে বিদেশগামীরা করোনা পরীক্ষা করে সঠিক রিপোর্ট নিয়ে বিমানবন্দরে যেতে পারেন।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘না হলে বড় চাপে পড়তে পারে বাংলাদেশ। কারণ বিমানবন্দরে চার মাসেও কার্যকর স্ক্রীনিং ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। আবার টেস্ট নিয়েও দুর্নীতি বা অনিয়ম চলতে থাকলে এভিয়েশনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞায় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হতে পারে’।
আটই মার্চ বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুর পরই বিদেশ থেকে আসা বাংলাদেশিদের কোয়ারেন্টিন করা নিয়ে শোরগোল দেখা দিয়েছিল যা খবর হয়েছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। এমনকি ইতালি থেকে আসা একটি দলকে কোয়ারেন্টিনের জন্য হজ ক্যাম্পে নিয়েও রাখা যায়নি তাদের অসহযোগিতার কারণে। পরে ইতালি প্রবাসীদের অনেকের এবং তারা যাদের সংস্পর্শে এসেছিলেন তাদের অনেকে করোনায় আক্রান্ত হবার খবর এসেছে। এরপর ঢাকায় দুটি প্রতিষ্ঠানের ভুয়া করোনা রিপোর্ট দেবার খবর আবার আলোচনার ঝড় তুলেছে।
এর মধ্যে গত ছয় মাসেও করোনা স্ক্রিনিংয়ের কার্যকর কোনো পন্থা দাঁড় করানো যায়নি ঢাকা বিমানবন্দরে। পাশাপাশি ঢাকা থেকে নেগেটিভ সনদ দেখিয়ে বিমান যাত্রার পর বিদেশে গিয়ে যাত্রীর করোনাভাইরাস পজিটিভ ধরা পড়ার ঘটনায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে। ইতালিতে এমন যাত্রী পাওয়ার পর সেখানকার কর্তৃপক্ষ ও গণমাধ্যম এমন বাংলাদেশি যাত্রীদের নাম দিয়েছে ‘ভাইরাস বোমা।
দ্রুত সমস্যা অর্থাৎ নমুনা পরীক্ষা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নিতে না পারলে আরও অনেক দেশ বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক কূটনীতিক নাসিম ফেরদৌস বলছেন, বাংলাদেশ হয়তো বিচ্ছিন্ন হবে না। তবে করোনার ভুয়া সার্টিফিকেট ইস্যুকে শক্ত হাতে ডিল করতে হবে বাংলাদেশকে।
‘এটা শুধু বাইরের দেশের ব্যাপার না। নিজেদের জন্যও বড় ব্যাপার। এখন যারা যোগাযোগ বন্ধ করছে সেটা সাময়িক। করোনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক বড় দেশই এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। তবে এটা ঠিক যে, যেসব অভিবাসী ফিরে এসেছিল তাদের ফিরে যাওয়ার ওপর প্রভাব পড়বে’।
অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক রুকসানা কিবরিয়া বলছেন, পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন না হলেও করোনাভাইরাসকে ঘিরে যেসব অনিয়ম হচ্ছে তাতে চাপের মুখে পড়বে বাংলাদেশ। ‘তাই দ্রæত রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। বিমানবন্দরে আগে থেকেই সমস্যা। এখন করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে সুযোগ নেবার লোক তৈরি হয়েছে। সরকারকে এগুলো ঠেকাতে হবে শক্ত হাতে। আন্তর্জাতিক নিয়ম কানুন সঠিকভাবে পালন না করলে দেশ বিপদে পড়বে’।
তিনি বলেন, টেস্টিং নিয়ে যে গলদ তা দূর করার বিকল্প নেই। কারণ, আর কোনো দেশই এমন ঝুঁকি নেবে না। তাই দেশের ভাবমর্যাদা ফিরিয়ে আনা ও সম্ভাব্য সঙ্কট থেকে বাঁচতে রাজনৈতিক উদ্যোগ নিয়ে অনিয়ম দূর করতেই হবে।
এভিয়েশন বিষয়ক বিশ্লেষক কাজী ওয়াহিদুল আলম বলছেন, অনেক দেশই করোনার খারাপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এখন সংক্রমণ কমিয়ে আনার দিকে। তারা কোনোভাবেই চাইবেনা অন্য দেশ থেকে করোনা রোগী গিয়ে তাদের বিপাকে ফেলুক। বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলো এসব নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। তারা আমেরিকা, ব্রিটেনকেও ছেড়ে কথা বলছে না। তাই বাংলাদেশের আরও সতর্ক হবার বিকল্প নেই। পাশাপাশি সারাবিশ্বেই এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি সঙ্কটে। তারাও চাইবে না ঢাকায় এসে তারা বিপদে পড়ুক। তাই করোনা টেস্ট হতে হবে প্রশ্নমুক্ত ও বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য। নাহলে বড় ধরনের এমবার্গো (নিষেধাজ্ঞার)’র সামনেও পড়তে হতে পারে’।
তিনি বলেন, সরকার ২/৩ টি জায়গা নির্ধারণ করতে পারে বিদেশগামীদের নমুনা পরীক্ষার জন্য। পরীক্ষার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সেই রিপোর্ট যাত্রীর পাশাপাশি ইমিগ্রেশন ও বিমান সংস্থার হাতে চলে যাওয়া উচিত। এটি করলে চলমান ভাবমর্যাদা সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
বিমান যোগাযোগ : ২১ মার্চ থেকে যা ঘটলো
গত ২১ মার্চ থেকে চীন ছাড়া বাকী সব গন্তব্যে ঢাকা থেকে ফ্লাইট বন্ধ করা হয় করোনা পরিস্থিতির জের ধরে। পরে আবার ভাড়া করা বা বিশেষ বিমান চালু হলেও নতুন করে সেটিও বন্ধ করেছে জাপান, কোরিয়া ও ইতালি। দশই জুন জাপানে বিমানের একটি ফ্লাইটে যাওয়া যাত্রীর শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া যাওয়ার পর জাপান বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এগারই জুন চীনের চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইন্সে এবং একই দিনে দক্ষিণ কোরিয়ায় ঢাকা থেকে যাওয়া একটি বিশেষ ফ্লাইটের যাত্রীর শরীরের করোনা ধরা পড়ে। আরব আমিরাত বিমান বাংলাদেশকে ফ্লাইট চালুর অনুমতি দিয়ে পরে আবার তা স্থগিত করেছে। তবে গত ১৫ জুন থেকে যুক্তরাজ্য ও কাতারের সঙ্গে বিমান চলাচলের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে।
যদিও ইতালিতে ৬ জুলাই ২১ জন যাত্রীর শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়ার পর তুমুল শোরগোল শুরু হয়। ইতোমধ্যেই এক সপ্তাহের জন্য ফ্লাইট নিষিদ্ধ করেছে ইতালি। এসময় কোনো চার্টার্ড বিমানও বাংলাদেশ থেকে যেতে পারবে না। এরপর তুরস্ক কর্তৃপক্ষ ১৫ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশের সাথে সব ফ্লাইট যোগাযোগ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে টেস্ট নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের খবরে আরও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে, এর মাশুল হিসেবে বিশ্ব থেকে ক্রমশ বাংলাদেশ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে কি না। সূত্র : বিবিসি বাংলা।