আনিকা তাহসিন হাফসা
লাইট অফ করে দরজা-জানালা বন্ধ করে একটা হরর মুভি দেখছিলাম। ভয়ে, উত্তেজনায় চোখ বড় বড় করে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এমন সময় আম্মু এসে কানের কাছে একটা চিল্লানি দিলো, ‘পেয়েছি! পেয়েছি!’
শকটা কাটিয়ে উঠতে মিনিট দুয়েক সময় লাগলো। তড়িঘড়ি করে লাইটটা অন করে আম্মুর দিকে রাগী রাগী গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী এমন কোহিনূর পেয়েছ? এভাবে কেউ চিৎকার করে!’
আম্মু চোখ চকচক করে বলল, ‘তোর ভাইয়ের জন্য একটা মেয়ে পেয়েছি। মেয়ে তো একেবারে মডেল!’
আমি হাই তুলতে তুলতে বিছানায় এসে বসলাম। শুধু শুধু আমার এতগুলো মিনিট আম্মু নষ্ট করলো!
আমার কোনও রকম আগ্রহ না দেখে আম্মু বলল, ‘তোর কাছে যে জন্য এসেছি সেইটা শোন…’
একটা চিরকুট আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘এই যে মেয়ের ফেসবুক ইন্সটা, আরও কী কী যেন একাউন্টের নাম। একটু চেক কর তো! খোঁজ-খবর নে। শুনলাম মেয়ের নাকি অনেক ফলোয়ার! কী সব টিকটিক না কী যেন করে…আমি আরো ভাবি সে তো আর টিকটিকি না যে টিকটিক করবে!’
বিরক্ত মুখে কাগজটা হাতে নিয়ে বললাম, ‘টিকটিক না আম্মু। ওটা টিকটক। আচ্ছা, তুমি যাও এখন। আমি পরে চেক করব। এখন মুভি দেখছি।’
আম্মু হতাশ ভঙ্গিতে ঘর থেকে চলে গেল।
অত:পর আমি মুভি দেখা শেষ করে হবু ভাবীর ফেসবুক, টিকটক, ইন্সটাগ্রাম চেক করতে লাগলাম।
মা ভুল শোনেনি। মেয়ে তো আসলেই সেলিব্রিটি! মেয়ের দেখি সব জায়গায় হাজার হাজার ফলোয়ার। আবার সবখানেই বায়োতে লেখা ‘গড়ফবষ ধঃ ঋধপবনড়ড়শ, ধপঃৎবংং ধহফ ফধহপবৎ ধঃ ঃরশঃড়শ’। কী অদ্ভুত! তার কণ্ঠে কিছু টিকটক ভিডিও দেখে বড় একটা শক খেলাম। এ যে দেখি ঠিকমতো বাংলাই বলতে পারে না! ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে, তাও আবার নাঁকি সুরে ঢং করে!
দুদিন পর যখন আমরা তাকে দেখতে গেলাম, সামনাসামনি অবস্থা আরও ভয়াবহ। মুখে গাদাগাদা মেক আপ, ভ্রু আর্ট করা, চোখে লেন্স, চুল রিবাউন্ডিং। তার ওপর সালাম থেকে শুরু করে সব কথা ঢং করে বলে!
মাকে ব্যাপারটা বলতেই মা একটা ঝামটা দিয়ে বলল, ‘আজকালকার মেয়ে কি না, একটু ওভাবে তো কথা বলবেই!’
ভাইয়ারও এক দেখাতে মেয়ে পছন্দ হয়ে গেল। খুশিতে গদগদ হয়ে আমাকে বলছিল, ‘জানিস অনু, মেয়ে আমাকে ফেসবুকে রিকুয়েষ্ট দিয়েছে! ইন্সটায় ফলো দিয়েছে! এরপর আমার সব ছবিতে লাভ দিয়েছে। উফ, আমার কী যে খুশি লাগছে!’
ভাইয়ার কথা শুনে একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললাম। এখানে আমি আর কী বলি!
মাস দেড়েক হলো বাসার সবাই কোয়ারেন্টাইনে। ভাইয়া-ভাবী তিন মাস আগেই বিয়ে করে আলাদা ফ্ল্যাটে থাকে। গত দেড় মাসে ভাইয়ার সঙ্গে আমাদের প্রায়ই ভিডিও কলে কথা হয়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, গত দেড় মাসে একবারও ভাবী আমাদের সামনে আসেনি! মা তো এই ব্যাপারটা নিয়ে বাসায় হুলস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলেছে। চিৎকার করে আর বলে, এ কেমন বেয়াদব মেয়েকে ঘরে আনলাম। আসলেই সবই ওর পলিটিক্স!
আমিও ব্যাপারটা ভাইয়াকে বললে সেও কেন যেন ইগনোর করে বা কথা ঘুরিয়ে ফেলে।
অত:পর একদিন ভাইয়া আমাকে কল দিয়ে কাতর স্বরে বলল, ‘তোর ভাবী কেমন যেন করছে রে!’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কী করছে?’
‘কী যে হয়েছে ওর! বারবার বলছে মরে যাব। বেঁচে থেকে কী হবে!’
‘ভাইয়া, তুমি একটু ভাবীর কাছে ফোনটা দাও। আমি দেখছি ব্যাপার কী?’
ভাবী ফোনটা হাতে নিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, ‘শোনো, এই জীবন আমি আর রাখব না! এত্ত চাপ আমি নিতে পারছি না! এত্ত চাপ!’
আমি শান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘এত চাপ যদি বিভিন্ন কোম্পানির সামান্য প্লাস্টিকের পাইপ নিতে পারে, তুমি কেন পারবে না! ভাবী, এখন ভালোয় ভালোয় বলো কী হয়েছে?’
‘আমাদের শহর লকডাউন হওয়ার কারণে এখানে সব বন্ধ। শহরের সব পার্লারও! একটা পার্লারও খোলা নেই! গত দেড় মাস ধরে আমি পার্লারে যাই না। কতদিন হয়ে গেল ভ্রু প্লাগ, হেয়ার স্পা, ফেসিয়াল কিছুই করা হয় না! এখন নিজেই নিজেকে আয়নায় দেখতে পারি না। তোমার ভাইয়াও আমার থেকে দূরে দূরে থাকে। ফেসবুক, ইন্সটা, টিকটকে আমার ফলোয়াররা আমার ছবি আর ভিডিও দেখে গালাগালি শুরু করেছে। কেউ কেউ আবার বলছে আমার আইডি হ্যাকড হয়েছে! এ আমি না, অন্য কেউ!’
কোনো মতে হাসি আটকে ভাবীকে বললাম, ‘কেঁদো না, ভাইয়াকে ফোনটা দাও।’
ভাইয়া ফোন হাতে নিতেই বললাম, ‘ভাইয়া, ভিডিও কল দাও এক্ষুনি!’
আমার কথামত ভিডিও কল দিতেই চোখে পড়ল, এলোমেলো অবস্থায় এক অদ্ভুত চেহারার নারী মেঝেতে বসে আছে! কোথায় আমার সেই অপ্সরী মডেল ভাবী?
ভাবীকে দেখামাত্রই হো হো করে হেসে ফেলি! ভাবীর ভ্রুগুলো বড় হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে আছে, চেহারার রঙ পাল্টে গেছে, চোখের নিচে কালি পড়েছে, চুল কেমন যেন ঝাড়ুর শলার মত হয়ে গেছে! তাড়াহুড়ো করে একটা স্ক্রিনশট তুলে আম্মুকে দেখিয়ে বললাম, ‘এই দেখো তোমার মডেল বউমা!’ মা অপলক দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলেন।