ভালোবেসে পারিবারিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধুকে বিয়ে করেছিলেন শবনব আফরোজ (৩২)। স্বামী ইরফান হোসেন (৩৮) পেশায় সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে তার জানাশোনা খুব বেশি। বিয়ের পর শবনব ও ইরফানের সংসার সুখের ছিল। প্রকৌশলী স্বামীকে নিয়ে শবনমও খুব সুখী ছিলেন। কিন্তু তাদের সুখের সংসার বেশি দীর্ঘায়িত হয়নি। সংসার জীবনের দুই বছরের মাথায় তাদের সংসারে অশান্তি শুরু হয়। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে প্রায়ই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকতো।
বিষয়টি চার দেয়ালের ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকেনি। দুই পরিবারের অনেকেই জেনে যায়। তাদের কলহ চূড়ান্ত রুপ নিলে দুই পরিবারের সিদ্ধান্তেই তারা ডিভোর্স নেন। তারপর ভালোবাসার মানুষ ইরফানের সব স্মৃতি মুছে শবনব পরিবারের পছন্দমতো আরেকটি ছেলেকে বিয়ে করেন। বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি ইরফান। শবনমের বিয়ের পরপরই সে ক্ষোভে ফুঁসে উঠে। শুরু করে সাইবার ব্ল্যাকমেইলিং। প্রেম থেকে শুরু করে সংসার জীবনের একান্ত ছবি দিয়ে ইরফান তার সাবেক স্ত্রী শবনমকে হয়রানি শুরু করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের আগের করা মেসেজের স্ক্রিনশট দিয়েও হয়রানি করে। এছাড়া শবনমের ফেসবুক আইডি ও ই-মেইলের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণও তার কাছে নেয়। ব্ল্যাকমেইলিংয়ের কৌশল হিসেবে ইরফান শবনমের বর্তমান স্বামীর কাছেও এসব পাঠায়। এক পর্যায়ে নতুন স্বামীর সঙ্গেও শবনমের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। উপায়ন্তর না পেয়ে শবনম প্রথমে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। পরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি ও ক্রাইম ডিভিশনে অভিযোগ করেন। বর্তমানে ডিএমপি’র সাইবার ইউনিট অভিযোগের তদন্ত করছে।
ভুক্তভোগী শবনম বলেন, সম্পর্ক থাকাকালীন সময়েই ইরফান আমার ফেসবুক ও ই-মেইলের পাসওয়ার্ড তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায়। এখন তার আমার ছবি দিয়ে শুধু যে হয়রানি করছে তা নয়। আমার বর্তমান স্বামীর সঙ্গে আমার কথাবার্তার সমস্ত তথ্য সে জেনে যাচ্ছে। ই-মেইলের নিয়ন্ত্রণ দিয়ে গুগল ড্রাইভ থেকে আমাদের সমস্ত ছবি তার কাছে নিয়ে যাচ্ছে। এসব নিয়ে বর্তমান স্বামীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। সংসার ভাঙার দ্বারপ্রান্তে।
শুধু শবনমের বেলায়ই এমন হচ্ছে তা নয়। সামপ্রতিক সময়ে সাবেক স্বামী ও প্রেমিক কর্তৃক এমন ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হচ্ছেন শত শত নারী। এভাবে কত নারীর সংসার ভেঙে গেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। ডিএমপি’র সাইবার অপরাধ ও নিরাপত্তা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, করোনাকালীন সময়ে সাইবার অপরাধ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে লকডাউনে বেশিরভাগ মানুষ ঘরবন্দি ছিল। এ সময়টা ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রতি বেশি ঝোঁক ছিল মানুষের। এমন সুযোগেই অনেকে নানা রকম প্রতারণা ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মতো অপরাধ করেছে। সাইবার অপরাধীদের টার্গেট ছিল প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে কম ধারণা আছে এমন নারী ও পুরুষরা। আইডি হ্যাক করে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে তারা প্রতারণা করেছে মানুষের সঙ্গে। এর বাইরে ডিভোর্সি স্বামী, সাবেক প্রেমিকরা সম্পর্ক থাকাকালীন ব্যক্তিগত ছবি ভিডিও দিয়ে হয়রানি করছে।
সাইবার ক্রাইম সূত্র বলছে, করোনাকালীন সময়ে তারা ভুক্তভোগীদের সরাসরি এসে অভিযোগ দিতে নিরুৎসাহিত করেন। মোবাইলে, হ্যালো সিটি, সাইবারের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজের মেসেঞ্জার, ই-মেইলে ভুক্তভোগীর অভিযোগ শুনে তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন। বিশেষ প্রয়োজন হলে ভুক্তভোগীকে অফিসে এনে কথা বলেন। তারপরেও অভিযোগের সংখ্যা অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর থেকে বর্তমানে দিনে গড়ে ১০০ অভিযোগ আসছে।
রাজধানীর নতুন বাজার এলাকার সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে সাকিব আহমেদ নামের এক শিক্ষার্থীর ৪ বছর ধরে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ২৬ বছর বয়সী সাকিব একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হতে সদ্য বিবিএ শেষ করেছে। সপ্তম শ্রেণীর ওই শিক্ষার্থীর পরিবারের সদস্যরা সাকিবের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্কের বিষয়ে জানলে সাকিবকে ডেকে এনে মেয়েটির সঙ্গে সম্পর্কের ইতি টানতে বলেন। তখন ছেলেটি মেয়ের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখবেনা বলে বিষয়টি মীমাংসা করে চলে আসে। কিন্তু এরপরেও ছেলেটি মেয়েটির পিছু ছাড়েনি। মেয়েটি তার সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলে, সে তার কাছে থাকা মেয়েটির কিছু আপত্তিকর ছবি সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। হুমকিতে কাজ না হওয়ায় সে কয়েকটি ছবি ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। পরে বাধ্য হয়ে মেয়েটির পরিবার ডিএমপি’র সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে। উক্ত অভিযোগের ভিত্তিতে ডিএমপি’র সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের সাব ইন্সপেক্টর আজহারুল ইসলাম হিমেল সাকিবকে শনাক্ত করেন। পরে সিনিয়র এসি ধ্রুব জ্যোতির্ময় গোপ-এর নেতৃত্বে একটি দল সাকিবকে রাজধানীর নতুন বাজার এলাকা থেকে আটক করে। আটকের পর সাকিব তার অপরাধের কথা স্বীকার করে। সাইবার টিম পরে সাকিবের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়। একইভাবে কলেজছাত্রী সুরাইয়ার সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয় মিরপুরের জিন্স ব্যবসায়ী রফিউল করিমের। পরিচয়ের পর দু’জনেই প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়। বিভিন্নস্থানে দু’জনের সাক্ষাৎ হওয়ার সময় রফিউল করিম মেয়েটির সঙ্গে কিছু সাধারণ ছবি তুলে রাখে। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় মেয়েটি প্রেমের সম্পর্কের ইতি টানে। কিন্তু মেয়েটি প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখার কারণে ছেলেটি নিজের সংরক্ষণে রাখা ছবিগুলো এডিট করে পর্নোগ্রাফি ছবি যোগ করে ফেইক ফেসবুক আইডি খুলে পোস্ট করে এবং মেয়ের পরিবার, বন্ধু, বান্ধবী, আত্মীয়-স্বজনদের ম্যাসেঞ্জারে প্রেরণ করে। পরে মেয়েটির পরিবার ডিএমপি’র সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে। উক্ত অভিযোগের ভিত্তিতে ডিএমপি’র সাইবার টিম রফিউলকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনে। গত সপ্তাহে ডিএমপি’র সাইবার টিম আরেক দুষ্কৃতকারীকে গ্রেপ্তার করেছে। সে প্রবাসে কর্মরত একজন সাবেক উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী’র সোশ্যাল মিডিয়া হ্যাক করে কিছু ব্যক্তিগত মিডিয়া চুরি করে নিয়েছিল। এই সব কন্টেন্ট দিয়ে তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে। নিরুপায় হয়ে ভিকটিম ডিএমপি’র সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছিলেন।
ডিএমপি’র সাইবার অপরাধ ও নিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ধ্রুব জ্যোতির্ময় গোপ মানবজমিনকে বলেন, বর্তমানে নারীদের সাবেক স্বামী ও প্রেমিক কর্তৃক হয়রানির ঘটনা বেশি ঘটছে। সম্পর্ক শেষ হওয়ার পর একান্ত মূহুর্তের ছবি দিয়ে তারা ব্ল্যাকমেইল করছে। এতে করে নারীরা যেমন হয়রানির শিকার হচ্ছেন অন্যদিকে অনেকের সংসার ভেঙে যাচ্ছে। গত কয়েকমাস ধরে এ ধরনের অভিযোগই আমরা বেশি পাচ্ছি। আবার কিছুক্ষেত্রে কৌশলে ফেসবুক ও ই-মেইলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতারণা করছে অপরাধীরা। তিনি বলেন, ডিএমপিতে অন্যান্য অপরাধের মামলা যেখানে অনেক কমে গেছে সেখানে সাইবার অপরাধের অভিযোগ আমরা বেশি পাচ্ছি। সামপ্রতিক সময়ে আমরা দিনে শতাধিক অভিযোগ পাচ্ছি। এসব অভিযোগের তদন্ত করে আমরা অনেককে শাস্তির আওতায় এনেছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, নিজের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড কখনো কারো সঙ্গে শেয়ার করা যাবে না। অপরিচিত পিসিতে আইডি ওপেন করে ব্যবহার শেষে অবশ্যই লগআউট হতে হবে। কোনোভাবেই পাসওয়ার্ড সেইভ করা যাবে না। পাশাপাশি এ ধরনের হয়রানির শিকার হলে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জানাতে হবে।
এদিকে, ডিএমপি’র সাইবার ক্রাইম ও নিরাপত্তা ডিভিশনের বাইরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার টিম, র্যাবের সাইবার টিমের কাছে এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগ আসছে।