মুস্তাফা আকেওল: মুসলিমরা যে আল্লাহর ইবাদত করেন তিনি কি ইহুদি এবং খ্রিষ্টানদের সৃষ্টিকর্তার চাইতে ভিন্ন কেউ? নাকি তিনি কিছু ইসলাম বিরোধী লেখক যেমনটি যুক্তি দিয়ে থাকেন সেরকম কোনো বিস্ময়কর ‘চন্দ্র দেবতা’ যা আরব প্যাগনিজম থেকে এসেছে?
আল্লাহর দূত মুহাম্মদ(সা.) সম্পর্কেইবা তারা কি বলে থাকেন? তিনি এমন কোনো নবী ছিলেন যিনি তরবারির মাধ্যমে তার নতুন ধর্মকে মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন? যা এখনো কিছু মুসলিম সন্ত্রাসীদের অনুপ্রেরণার উৎস?
উপরোল্লিখিত প্রশ্ন সমূহের উত্তর পেতে হলে পাঠকদেরকে দুটো বই অধ্যয়ন করতে হবে যা তাদেরকে একই সাথে ইসলামের ইতিহাস এবং তত্ত্বের গভীরতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ম বিভাগের অধ্যাপক পুলিৎজার বিজয়ী বই ‘God: A Biography’ এর লেখক জ্যাক মাইলসের ‘God in the Qur’an’ নামক বইটি অধ্যয়ন করা দরকার।
পবিত্র কুরআন সম্পর্কে জানার জন্য অবশ্য পাঠ্য একটি বই যাতে তিনি বিশ্বে প্রচলিত তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা করেছেন যারা ঠিক একই সৃষ্টিকর্তার আরাধনা করে।
শুরুতেই একজনকে কোনো দ্বিধা ছাড়াই এ কথা বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ তায়ালা-ই হলেন বাইবেল বর্ণিত ‘ইয়াহওহ’। জ্যাক মাইলসের মতে, পবিত্র কোরআনের ‘স্বর্গীয় বক্তা’-‘ইহুদি এবং খ্রিষ্টানরা যার আরাধনা করত তিনি নিজেকে একই স্রষ্টা এবং তাদের স্বর্গীয় বই সমূহের মূল বলে দাবী করেছেন।’
উদাহরণ হিসেবে নবী ইব্রাহীম যাকে খ্রিষ্টানরা আব্রাহম বলে জানে তার গল্পের কথা ধরা যাক, যার কথা বাইবেল এবং পবিত্র কোরআনের সাথে মিলে যায়। জ্যাক মাইলস নবী ইব্রাহীম (আ.) এর বিষয়সমূহ পবিত্র কুরআন এবং বাইবেলে বর্ণিত প্রেক্ষাপট থেকে পরীক্ষা করে দেখেছেন।
বাইবেলে নবী ইব্রাহীম(আ.) কে উপস্থাপন করা হয়েছে একটি মহান জাতির পিতা হিসেবে যারা পরবর্তীতে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং একটি পবিত্র ভূমির উত্তরাধিকারী হয়।
বাইবেলে ‘ইয়াহওহ’ নবী ইব্রাহীম(আ.) কে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তোমার উত্তরাধিকারদের জন্য আমি এই দেশ উপহার দিয়েছি, যার বিস্তৃত মিশরের নদী থেকে একটি মহান নদী অবধি।’
অন্যদিকে পবিত্র কুরআনে নবী ইব্রাহীম(আ.) কে একেশ্বরবাদী ধর্মে অন্যতম অনুসরণকারী হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে যিনি মূর্তি পূজার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। তার প্রধান লক্ষ্য ছিল মূর্তি ধ্বংসের মাধ্যমে মূর্তি পূজার বিলুপ্তি সাধন করা।
আর পবিত্র কুরআন এবং বাইবেলে নবী মুসা (আ.) এর গল্প অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বলা হয়েছে এবং এ দুটো গ্রন্থেই তার সম্পর্কে প্রায় মিলে যাওয়া বক্তব্য দেয়া হয়েছে।
বাইবেল অনুযায়ী, নবী মুসা (আ.) এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ফারাওয়ের অপশাসনের হাত থেকে বনী ইসরাইলের লোকজনদের মুক্ত করা। পবিত্র কুরআনে ও ঠিক একই কথা বলা হয়েছে।
পবিত্র কুরআন অনুযায়ী নবী মুসা(আ.) ফারাওয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন কিন্তু তার প্রধান সমস্যা ছিল ফারাও এবং তার অনুসারীগণ কিছু মিথ্যা সৃষ্টিকর্তার আরাধনা করত।
বাইবেল অনুযায়ী, ‘ইয়াহওহ’ ‘ফারাও কে পরাজিত করতে চেয়েছেন’ মাইলেস দেখতে পান যে, শুধুমাত্র মিশরের সৃষ্টিকর্তা হওয়ার কোনো ইচ্ছা বাইবেলের ‘‘ইয়াহওহে’ এর ছিল না। আর অন্যদিকে পবিত্র কুরআন অনুযায়ী আল্লাহ চেয়েছিলেন ফারাও তার উপর ইমান আনুক এবং পুরো মিশর একেশ্বরবাদের আরাধনা করুক।
যদিও এসব ঐশী বাণীর মধ্যে কিছুটা ফারাক বিদ্যমান কিন্তু মাইলস তুলনা করে দেখেছেন যে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইহুদিরা যে একেশ্বরবাদের উন্নয়ন ঘটিয়েছে তা ইসলাম থেকে ধার করা যা একটি বিশ্ব ধর্মে পরিণত হয়েছে।
আর খ্রিষ্টান ধর্ম সম্পর্কে কি বলা যায়? খ্রিষ্টান ধর্ম একেশ্বরবাদে কিছু নতুনত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে আর তা হচ্ছে- একজন স্বর্গীয় খ্রিষ্ট এবং ত্রয়াত্মক একটি বিষয় যা একের মধ্যে তিন বা ট্রিনিটি নামেও পরিচিত। আর এ বিষয়টি একই সাথে ইসলাম এবং ইহুদি ধর্ম উভয়ের নিকটেই অগ্রহণযোগ্য।
পবিত্র কুরআন এবং খ্রিষ্টানদের নিউ টেস্টামেন্ট পরীক্ষা করে জ্যাক মাইলস দেখতে পেয়েছেন যে, যদিও ইসলাম খ্রিষ্টানদের ট্রিনিটি ধারণা বাতিল করে দেয় কিন্তু ধর্মটি যিশু খ্রিস্ট এবং তার মাতা ম্যারি বা মরিয়মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করে।
জ্যাক মাইলসের ‘God in the Qur’an’ বইটিতে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে আর তা হচ্ছে বাইবেলে ‘ইয়াহওহ’ কে দেখানো হয়েছে ‘বিতর্কের ঊর্ধ্বে এবং বিপর্যয় সৃষ্টিকারী নয় এমন’ হিসেবে আর অন্যদিকে পবিত্র কুরআনে আল্লাহর বিষয়টি উঠে এসেছে ‘অত্যন্ত সহানুভূতিসম্পন্ন’ হিসেবে।
এরকম কিছু অতি সূক্ষ্ম তারতম্য প্রত্যক্ষ করে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী জ্যাক মাইলস তার বইটি রচনার ক্ষেত্র উদার থেকেছেন। বইটির শুরুতেই তিনি নিজের খ্রিষ্টান পরিচয় দিয়েছেন যাতে করে তার মুসলিম পাঠকেরা পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন করে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।
আর শেষে তিনি তার ধর্ম বিশ্বাসে ফিরে এসেছেন এবং আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, ‘বাইবেল আমার গ্রন্থ আর পবিত্র কুরআন তাদের।’
তিনি মনে করেন অমুসলিমরা ‘তাদের প্রতিবেশী মুসলিমদের বিশ্বাস করতে পারেন এবং মুসলিমদের এমন কেউ একজন মনে করতে পারেন যারা কোনো অযৌক্তিক ধর্ম অনুসরণ করেন না।’
যেসকল অমুসলিম পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন করেছেন বা করবেন তারা সেখানে ইব্রাহীম(আ.), মুসা(আ.), যিশু বা ঈসা(আ.) সম্পর্কে অবগত হবেন কিন্তু তারা যে বিষয়টি সবচেয়ে আশা করবেন তা হচ্ছে পবিত্র কুরআনে নবী মুহাম্মদ(সা.) সম্পর্কে অনেক কিছুই বলা থাকবে। যদিও পবিত্র কুরআনে নবী মুহাম্মদ(সা.) কে উদ্দেশ্য করে অনেক কিছুই বলা আছে কিন্তু তার নিজের সম্পর্কে কোনো আলোচনাই করা হয় নি।
আর একারণেই পরবর্তীতে মুহাম্মদ(সা.) এর জীবনী যা সিরাত নামেও পরিচিত তা নিয়ে অনেক বই রচিত হয়েছে। আর মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক জুয়ান কোলে লিখেছেন- ‘Muhammad: Prophet of Peace Amid the Clash of Empires’ নামের একটি সিরাত।
জুয়ান কোলের বইটিতে প্রথমেই সপ্তম শতাব্দীর শুরুর দিকে অন্ধকার আরবে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের কথা বলা হয়েছে। ইসলাম ধর্ম এমন একটি সময়ে এসেছে যখন কনস্টান্টিনোপল কেন্দ্রিক খ্রিষ্টান বাইজানটাইন সম্রাজ্যের সাথে বর্তমান ইরানের জোরোসট্রিয়ান সাসানিয়ানদের সংঘর্ষ চলছিল।
জোয়ান কোলে পবিত্র কোরআনের সুরা ‘রোম’ দিয়ে শুরু করেছেন। এই সুরা অনুযায়ী ‘বাইজানটাইন গণ নিকটবর্তী একটি ভূমিতে পরাজিত হয়েছিল।’ কিন্তু তাদের বিজয় অতি সন্নিকটে এরকম ভবিষ্যৎ বানী ও করা হয়েছে।
আর পবিত্র কোরআনের এই বিখ্যাত ভবিষ্যৎ বানীর ফলে সে সময়কার মুসলিম গণ একেশ্বরবাদী খ্রিষ্টানদের প্রতি কিছুটা হলেও নমনীয় ছিল যারা প্যাগান ধর্মের অনুসারীদের শত্রু বলে মনে করে।
জুয়ান কোলের দ্বিতীয় যুক্তিটি আরো গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে পশ্চিমা বিশ্বে নবী মুহাম্মদ(সা.) কে দেখা হয় একটি সশস্ত্র যোদ্ধা হিসেবে সেখান তিনি নবী মুহাম্মদ(সা.) কে চিত্রায়িত করেছেন একজন শান্তি স্থাপন কারী রূপে যিনি শুধুমাত্র তার একেশ্বরবাদ কে মুক্ত ভাবে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন এবং তিনি একই সাথে একটি ‘বহু সংস্কৃতির’ মধ্যে ঐক্য আনতে চেষ্টা করেছিলেন।
ইসলাম প্রচারের প্রথম বর্ষে নবী মুহাম্মদ(সা.) এর যে মিশন ছিল এবং তার মক্কার শোষিত সংখ্যালঘুদের নেতৃত্ব দেয়া জুয়ান কোলের যুক্তিতে সমর্থন দেয়। মদিনায় অবস্থান কালে মুহাম্মদ(সা.) তরবারি ধারণ করতে হয়েছিল এবং অনেক যুদ্ধে জড়াতে হয়েছিল যা তার মক্কার জীবনকে জটিল করে দেয়।
জুয়ান কোলে এই সমস্যার সমাধান দিয়েছেন এভাবে যে, নবী মুহাম্মদ(সা.) এর জীবনের সমস্ত যুদ্ধ আক্রমণাত্মক ছিল না বরং এগুলো ছিল আত্মরক্ষা মূলক।
জুয়ান কোলের সদুদ্দেশ্যে কৃত অনুমান পরিষ্কার ভাবে ইসলামোফোবিয়া প্রতি কিছু চ্যালেন্জ্ঞ ছুড়ে দেয় যা কখনো প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি এও বলেছেন যে, ইসলামের শান্তি এবং সহনশীলতার মূল নীতি যা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে তা থেকে বর্তমানের অনেক মুসলিম সরে এসেছে।
আর এসব কিছু ছাপিয়ে জুয়ান কোলের বইটিতে নবী মুহাম্মদ(সা.) এর জীবনের এমন কিছু দিক উঠে এসেছে যা অনেক অমুসলিম পাঠক এমনকি অনেক মুসলিম পাঠক নতুন ভাবে আবিষ্কার করবেন।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের ‘Cato Institute’ এর সিনিয়র গবেষক ‘Islam Without Extremes’ এবং ‘The Islamic Jesus’ নামের বই দুটোর লেখক মুস্তাফা আকেওলের কলাম থেকে।