একটি পরিবারকে কানাডাতে পাঠানোর কথা বলে তাদের জাল ভিসা দিয়ে ৭০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি মানবপাচার চক্র। এই চক্রের সঙ্গে পল্টনের ইউআরবিআই ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজমসহ ভারত ও বাংলাদেশের একাধিক ব্যক্তি জড়িত বলে জানা গেছে। পরিবারটি টাকা ফেরত চাওয়ায় তাদের হত্যারও হুমকি দিয়েছে চক্রটি। এ ঘটনার দেড় বছর পর পল্টন থানায় মানবপাচার আইনে একটি মামলা হয়েছে। ইতোমধ্যে চক্রের তিন জনকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। বাকিরা পলাতক।
ভুক্তোভোগী পরিবারটি নারায়ণগঞ্জের। ওই পরিবারের তারেক হোসেন নামে একজন থাকেন কানাডায়। সেখানেই তার সঙ্গে নজরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির পরিচয় হয়। নজরুলের মাধ্যমে তারেক জানতে পারেন পরিবারকে কানাডা এনে দিতে পারবে পুরানা পল্টনের ট্রাভেল এজেন্সি ইউআরবিআই ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম। এরপর তারেক তার স্ত্রী, সন্তান এবং ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রী-মেয়েকে কানাডা নেওয়ার জন্য ওই ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে ২০১৯ সালের প্রথম দিকে যোগাযোগ করেন।
যেভাবে ফাঁদে পড়ে পরিবারটি
আনোয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি দুবাইয়ে ছিলাম। আমার মেজো ভাই তারেক কানাডায় থাকেন। সেখানে শরীয়তপুরের নজরুল নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তার মাধ্যমেই আমার ভাই ইউআরবিআই ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম এর প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেই সুবাদে আব্দুর রহমান আমার ভাইয়ের স্ত্রী ও তার মেয়ে এবং স্ত্রী-মেয়েসহ আমি এই পাঁচ জনকে ৭০ লাখ টাকার বিনিময়ে কানাডায় নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। তখন দুবাই থেকে আমার ভাই বাংলাদেশে এসে সবার কাগজপত্র ঠিক করতে বলেন। আমি দুবাই থেকে ২০১৯ সালের ২১ জানুয়ারি দেশে চলে আসি। ভাইয়ের কথা মতো আব্দুর রহমান ও মাহমদুদুল হাসানের সঙ্গে দেখা করি। তাদের কথা আশ্বস্ত হয়ে ৭০ লাখ টাকার চুক্তিতে পরিবারের পাঁচ সদস্য কানাডা যেতে রাজি হই।’
ভিসার পরে টাকা দেওয়ার টোপ
৭০ লাখ টাকার বেশিরভাগেই ভিসা হওয়ার পর দিলেই হবে– এমন চুক্তি করে প্রতারক চক্রটি। প্রথমে কিছু টাকা নেয়। বাকি টাকা পরে দিলে হবে বলেও জানায়। আনোয়ার বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী আব্দুর রহমানের ডাচ বাংলা ব্যাংকের দু’টি অ্যাকাউন্টে ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তিন লাখ টাকা জমা দেওয়া হয়। তখন তারা বাকি টাকা পরে দিলেই হবে বলে জানায়’।
ভারতে কানাডার দূতাবাসে সাক্ষাৎকারের আয়োজন
পরিবারটির কাছে বিশ্বাস পেতে তাদের সবাইকে দিল্লির কানাডা দূতাবাসে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে। মাহমুদুল হাসান ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আনোয়ার হোসেন, তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস প্রিয়ংকা (২৪), মেয়ে সামিয়া হোসেন (৮) এবং ভাবি তাহমিনা (৩৫) ও ভাতিজি সাহারা হোসেন (৯) কে বাংলাদেশ থেকে দিল্লিতে কানাডার দূতাবাসে সাক্ষাতের জন্য পাঠায়। দিল্লির বিমানবন্দর সংলগ্ন দ্য গ্রিস হোটেল তাদের রাখা হয়। হোটেলে হোসেন মোল্লা ওরফে রনি মোল্লা তাদের সব কিছু দেখভাল করেন। সে তাদের দূতাবাসে নিয়ে যায়। দূতাবাস থেকে তারা সাক্ষাৎকার শেষে বের হলে রনি কৌশলে তাদের কাছ থেকে পাসপোর্টে ডেলিভারির রিসিট নিয়ে যায়। পরিবারটিকে ওই হোটেলে একমাস রাখা হয়।
পাসপোর্টে ভিসা দেখিয়ে টাকা দাবি
কানাডার দূতাবাসে সাক্ষাৎকারের প্রায় ২৫ দিন পর রনি পাসপোর্টসহ হোটেলে আসে। সে তাদের জানায়, পাসপোর্টে কানাডার ভিসা লেগেছে। চুক্তি অনুযায়ী বাকি টাকা এখনই দিতে হবে, না হলে তাদের পাসপোর্ট দেবে না। তখন বিষয়টি তারেককে জানানো হয়। এরপর তিনি আব্দুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। আব্দুর রহমান বিভিন্ন ব্যাংকের কয়েকটি অ্যাকউন্ট নম্বর দেয়।
তাদের বড় ভাই ২০১৯ সালের ২০ মার্চ ইসলামী ব্যাংক, ডাচ বাংলা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া ও যমুনা ব্যাংকে ২২ লাখ, ২১ মার্চ ইসালামী ব্যাংকের দুটি অ্যাকাউন্টে ১৪ লাখ এবং ২৪ মার্চ একটি ইসলামী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে দেড় লাখ টাকা দেয়। পরিবারটি ভারত থাকা অবস্থায় মাত্র এক সপ্তাহেরও কমসময় তাদের অ্যাকাউন্টে সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা দেওয়া হয়। মোট সাড়ে ৪০ লাখ টাকা নেয়। এরপর সবার পাসপোর্ট ফেরত দেয়। তারা দেখতে পান, তাদের পাসপোর্টে কানাডার ভিসা লেগেছে। এরপর পরিবারটি ২৭ মার্চ দিল্লি থেকে ঢাকায় চলে আসেন।
আবার টাকা দাবি
শাহজালাল বিমান বন্দরে আসার পর মাহমুদুল হাসান। বিমানবন্দরে বসেই পরিবারটির কাছে বাকি টাকা দাবি করে সে। এসময় আনোয়ার হোসেনের পাসপোর্টটি কৌশলে নিয়ে নেয়। বাড়িতে গিয়ে টাকার ব্যবস্থা করা হবে বলে ট্রাভেল এজেন্সির লোকজনকে তারা বুজিয়ে নারায়ণগঞ্জের বাসায় চলে যান।
২০১৯ সালের ১ এপ্রিল ইউআরবিআই ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম অফিসে যায় আনোয়ার। অফিসে বসেই মাহমুদুল হাসানের কাছে সাড়ে ১৯ লাখ এবং টিকিট বাবদ আরও একলাখ মোট ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেন তিনি। এভাবে বিভিন্ন সময় মোট ৭০ লাখ টাকা নিয়েছে তারা। এসময় আনোয়ারকে তার ভাবি ও ভাতিজির জন্য কানাডার বিমান টিকিট দেওয়া হয়।
ইমিগ্রেশনে গিয়ে বুঝতে পারে প্রতারণা
২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল আনোয়ার হোসেনের ভাবি ও ভাতিজি কানাডা যাওয়ার উদ্দেশে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যায়। সেখানে যাওয়ার পর ইমিগ্রেশন পুলিশ তাদের ফেরত পাঠায়। কারণ তাদের পাসপোর্টে কানাডার জাল ভিসা। বিষয়টি তাৎক্ষণিক ইউআরবিআই ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজমের প্রধান নির্বাহী আব্দুর রহমান ও মাহমুদুল হাসানকে জানায়। তখন তারা নয়-ছয় কথা বলা শুরু করে। পরিবারটি তখন বুঝতে পারে তারা প্রতারণার শিকার হয়েছে।
টাকা চাইলেই হত্যার হুমকি
আনোয়ার এজেন্সির কাছে কয়েক দফায় টাকা ফেরত চেয়েছেন। প্রতিবারই তাকে হুমকি দিয়েছে ওই এজেন্সির মালিক ও কর্মচারীরা। গত বছরের ৩১ অক্টোবর ওই অফিসে টাকা চাইতে গেলে তাকে মারধর করে ভয়ভীতি দেখায় প্রতারক চক্রটি। এমনকি কানাডায় বসবাসরত তার ভাই তারেকও ফোন হুমকি দিয়েছে। এ বছরের ১০ মে ইয়াছিন নামে এক সন্ত্রাসী তারেককে ইমোতে ফোন দিয়ে হত্যার হুমকি দিয়েছে। যাতে তারা টাকা না চায়।
প্রায় দেড় বছর পর মামলা
গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে পুরো ঘটনাটি ঘটে। প্রতারিত হওয়ার পর পরিবারটি বিভিন্ন উপায়ে ও বিভিন্ন সময় টাকা ফেরত চাইলেও তাদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। উপায়ন্তু না পেয়ে প্রায় দেড়বছর পর ১০ জুন মানবপাচার আইনে মামলা করে পরিবারটি। মামলার পর তিন জন আসামি গ্রেফতার হয়েছে।
আসামি কারা
শরীয়তপুরের কানাডা প্রবাসী নজরুল ইসলাম, পুরানা পল্টনের ইউআরবিআই ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম এর প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রহমান, শরীয়তপুরের মাহমুদুল হাসান, আবিদ ইলেক্ট্রনিক্স প্রোপাইটার আবিদ হোসেন মোল্লা ওরফে রনি মোল্লা, ঢাকা কামরাঙ্গীরচরের ইয়াসিন এবং মোহাম্মেদ নামে এক ব্যক্তি যার ঠিকানা অজ্ঞাত। এছাড়াও আরও কয়েকজন অজ্ঞাত আসামি রয়েছে।
পুলিশের বক্তব্য
পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বক্কর সিদ্দিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা মামলা নেওয়ার পর সেটি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তারাই তদন্ত করছেন।’