ড. মোহম্মদ মাহবুব চৌধুরী:
ছোটবেলায় মাইজদিতে ইটের চাঁড়া দিয়ে ‘চাঁড়া-মীর’ নামে আমরা একটা খেলা খেলতাম। ক্লাস ওয়ান-টুর সময় থাকতাম নানার বাসার পাশেই। আমি, মিজান ভাইয়া, আমাদের প্রিয় টুটুল মামাসহ পাড়ার পোলাপাইনরা সবাই মিলা খেলতাম। আমরা রাস্তা থেইকা খালি সিগারেটের প্যাকেট কুড়ায়ে ওই গুলারে টাকা বানাইতাম। যে সিগারেটের প্যাকেট বেশি পাওয়া যাইতো- যেমন স্টার, সিজরস, ক্যাপষ্টান এইগুলার একটা খালি প্যাকেট ১০, ২০, ৩০ টাকা আবার K2, বগলা, কিং ষ্টর্ক, রমনা, ব্রিস্টল এই সিগারেটের খালি প্যাকেটগুলো কম পাওয়া যাইতো বইলা এগুলার ভ্যালু ছিল বেশি-৭০,৮০,৯০ টাকার এর মত। আর লম্বা সিগারেট এর প্যাকেট পূর্বানী, উইলস কিংস, এমব্যাসি এগুলার ভ্যালু ছিল হাইয়েষ্ট-১০০ এর মত মনে হয়। এইখানে কিন্তু বক্স এর মত প্যাকেট যেমন গোল্ড-লিফ, ৫৫৫, গোল্ড ফ্ল্যাক, বেনসন এই প্যাকেটগুলার কোন বেইল আছিলনা।
যাই হোক এই সিগারেটের খালি প্যাকেট কালেক্ট করার জন্য বাসা হতে একদিকে মাইজদি বাজার আর আরেকদিকে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত ২-৩ কিলোমিটার রাস্তার দুইপাশে কেউ কাউরে না জানায়া আমরা একলা একলা খুইজা বেড়াইতাম; দেখতাম কোন খালি প্যাকেট পাওয়া যায় কিনা। মাঝেমধ্যে কোন প্যাকেট বৃষ্টিতে বা শিশিরে ভিজা থাকতো আবার কতগুলোতে মাটি লাইগা থাকতো। রেয়ার প্যাকেট হইলে ওগুলাও তুইলা আনতাম-পরিষ্কার করতাম, শুকাইতাম। কী যে উত্তেজনা হইতো শরীলে! গর্ব হইতো দেখাইতে পারমু আরেকজনরে ‘আমার কাছে এই প্যাকেট আছে, তোর কাছে আছে?’ ঐ প্যাকেটগুলারে রাবার ব্যান্ড দিয়া বাইন্ধা একটা ‘বোন্দা’ বানাইতাম। কিছুক্ষণ পর পর গইনা দেখতাম কত টাকা হইসে, গন্ধ শুকতাম, এরপরে লুকায়া রাখতাম কেউ যাতে দেইখা না ফালায় আমার এই ভাণ্ডার!
এখন খেলার সময় আমরা মাটিতে একটা দাগ কইরা ঐখানে পা রাইখা কঠিন একটা জায়গায়- পুকুরের ঢালে, গাছের গুড়িতে বা একটু উঁচা জায়গায় এমনভাবে চাঁড়াটা ছুইড়া মারতাম যাতে ঐখানে আটকে থাকে। তখন আরেকজনরে কইতাম ঐ জায়গায় ‘হিট’ করতে বা মারতে-আর সিগারেটের খালি প্যাকেট দিয়ে বেট ধরতাম। ওই পাবলিক যদি তার চাঁড়াটা আমার চাঁড়ার এক বিঘতের মধ্যে ফালাইতে পারতো তাইলে আমার প্যাকেটগুলো পাইয়া যাইতো, আর না পারলে আমি ওর প্যাকেটগুলা নিয়া নিতাম। হিসাব ছিল পুরাই পাক্কা-কোন ভেজাল নাই। এক ‘বিঘত’ মাপের ক্ষেত্রে আমরা এক্কেবারে হাতের কাইনা আর বুড়া আঙুল যতটা পারা যায় টানটান কইরা দেখতাম ‘বিঘত’টা ঠিক আছে কিনা। যাগো আঙুল একটু লম্বা আছিল ওরা একটু বেশি সুবিধা পাইতো। দুরূহ পজিশনে চাঁড়াটা প্লেইস করাটাই টার্গেট থাকতো সবার, জিতার চান্স বেশি থাকতো বইলা। অনেক সময় পরের জন প্রথম জনের টার্গেটে নিজের চাঁড়া পৌছানো দুরূহ মনে করলে উল্টা প্রথম জনরে ‘ফিরত’ আসতে কইতো। এর মানে হইলো প্রথম জনরে উল্টা তার নিজের ফেলা জায়গা থেইকা প্রথমে যেই দাগ থেইকা সে চাড়াটা ছুইড়া মারছিল সেখানে আবার ছুইড়া মারতে হইতো। ঐটাও একটা চ্যালেঞ্জ আছিল- চাঁড়াটা এইখানেও ঐদাগের এক বিঘতের মধ্যে ‘ফিরত’ না আসলে সে বেট এ হাইরা যাইত আর নিজের সিগারেটের প্যাকেটগুলা দিয়া দিত।
অনেক পোলাপাইন আবার ওয়েল্ডিংয়ের দোকান থেকে লোহার ছোট ছোট বার কালেক্ট কইরা ঐটারে চাঁড়ার মত ইউজ করতো। ইটের চাঁড়ার চাইতে লোহার বার বেটার আছিল কারণ কোনা শার্প থাকার কারণে ঐগুলা গাছের গুঁড়িতে ক্রিটিকাল পজিশনেও বইসা থাকতে পারতো। আমার টুটুল মামুর এরকম একটা চারকোণা লোহার বার আছিল যার মাঝখানটা আবার গোলমত একটু ফাঁকা ছিল। মামুর আবার ঐটা নিয়া কিছুটা ‘গর্ব’ ও আছিল কারণ ঐটারে উনি বহু ক্রিটিকাল পজিশনে-পুকুরের ঢালে, গাছের গুড়িতে টার্গেট কইরা ফেলতে পারতেন। অন্য কেউ ঐখানে সহজে ইটের চাঁড়া ফেলতে পারতোনা আর এই কারণে উনি বেশি বেশি জিতাও যাইতেন। শেষদিকে আমারো তিনকোণামত একটা লোহার বার আছিলো। দিনেদুপুরে চান্স পাইলেই এই খেলাটা খেলতাম। বড়রা খুব একটা দেখতে পারতোনা এই খেলাটা। কিন্তু তাই বইলা আমাদের খেলা বন্ধ থাকে নাই।
আমি শিওর এই খেলাটা ৭০-৮০’র দশকে নোয়াখালীর বাইরে দেশের অন্য জেলাতেও একটু ভিন্ন ফরমেটে খেলা হইতো! আমি, মিজান ভাইয়া, টুটুল মামা আর পাড়ার পোলাপাইনদের সাথে মাইজদিতে ছোটবেলার ঐ চাঁড়া খেলার স্মৃতি এখনো চোখে ভাসে!