ভোরের আলো ডেষ্ক: অনলাইন প্লাটফর্মগুলোতে অশ্লীলতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেন্সর না থাকায় ওয়েব সিরিজে উদ্ভট গল্প, অশালীন দৃশ্য, নোংরা সংলাপ ব্যবহার যেন আজ আর নতুন কোনো বিষয় নয়। আর এই স্রোতে গা ভাসাচ্ছেন আমাদের নাটকের জনপ্রিয় কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী। গল্পের প্রয়োজনে গালি ব্যবহার করা হলেও টিভি নাটকের সেই অংশের শব্দটুকু সাধারণত মুছে দেওয়া হয়। মাদকদ্রব্য ব্যবহার ও সেবন করার দৃশ্যে ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ লেখা থাকে। কিন্তু সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ওয়েব সিরিজে এ ধরনের সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়নি। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন আলোচনায় তিনটি ওয়েব সিরিজ প্রসঙ্গ। স্ট্রিমিং প্লাটফর্মে মুক্তি পাওয়ার কথা থাকলেও ইউটিউবে মুক্তি পেয়ে রীতিমতো বিতর্ক উসকে দিয়েছে এই ওয়েব সিরিজগুলো। ওয়েব সিরিজ তিনটি হলো- ওয়াহিদ তারিকের ‘বুমেরাং’, সুমন আনোয়ারের ‘সদরঘাটের টাইগার’ ও শিহাব শাহীনের ‘আগস্ট ১৪’। অভিনয় করেছেন আজাদ আবুল কালাম, মৌটুসী বিশ্বাস, শ্যামল মওলা, হিল্লোল, ইমি, অর্ষা, তাসনুভা তিশা, ফারহানা হামিদ, আবু হুরায়রা তানভীরসহ অনেক জনপ্রিয় তারকা।
গত ২৭ মে অনলাইনে মুক্তি পেয়েছে ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে’ শিহাব শাহীন পরিচালিত ক্রাইম থ্রিলার ‘আগস্ট ১৪’। গল্প থেকে বোঝা যায়, ঐশী নামের বখে যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তার মেয়ের গল্প এটি। ২০১৩ সালে যে মেয়েটি মা-বাবাকে নির্মমভাবে খুন করেছিল। আলোচিত সেই ঘটনা নিয়েই নির্মিত হয়েছে সিরিজটি। এই ধারাবাহিকে তুশি চরিত্রে অভিনয় করেছেন তাসনুভা তিশা। সেখানে দেখা যায়, বন্ধুদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক, বাসায় একা নীল ছবি দেখার মুহূর্তসহ নানা দৃশ্য। থ্রিলারের শুরুতেই বলে নেওয়া হয়, এটি ১৮ বছরের কম বয়সী দর্শকের জন্য নয়। আর এমন দৃশ্যগুলোতে অবলীলায় অভিনয় করেছেন তাসনুভা তিশা। যেভাবে আগে কখনোই তাকে দেখা যায়নি। এই সিরিজে আরও অভিনয় করেছেন শহীদুজ্জামান সেলিম, শতাব্দী ওয়াদুদ, মনিরা মিঠু, শাওন, তানভীর প্রমুখ। তাসনুভা তিশা বলেন, ‘ওখানে গল্পের বাইরে কিছু ছিল না। আমরা চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব ডিসেন্টলি কাজ করতে, তার চেয়েও কম এক্সপোজড করতে। দৃশ্যগুলো যেন দর্শকের ভালো লাগার মনে না হয়। অসংলগ্নতা হয়তো কিছুটা ছিল। ভাষার ব্যবহার বা অন্য যাই বলি, সেগুলো চরিত্রের জন্য করতে হয়েছে, যা আমি নরমালি নাটকের জন্য কখনো করি না। এখন কেউ যদি নেগেটিভ কিছু বলেন, তাতে কিছু যায় আসে না। এমনিতেও বলবেন। কিছু না হলেও বলবেন। অনেকেই তো খুব প্রশংসা করেছেন।
শ্যামল মওলা-মৌটুসী, আদনান ফারুক হিল্লোল-নাজিয়া হক অর্ষা, ইমি-আবু হুরায়রা তানভীর অভিনীত ওয়েব সিরিজ ‘বুমেরাং’ মুক্তি পেয়েছে ঈদে। এটি নির্মাণ করেন সিনিয়র নির্মাতা ওয়াহিদ তারেক। সিরিজের শুরুটাই চমকে দেবে দর্শককে। পর্দায় বাংলাদেশি অভিনয়শিল্পীদের এত নিবিড় বিছানার দৃশ্য এর আগে কখনো দেখানো হয়েছে কিনা, তা নিয়েও ভাবাবে। ‘বুমেরাং’ এই সিরিজের অন্য একটি পার্টে অভিনয় করেছেন মৌটুসী বিশ্বাস, শ্যামল মওলা, ইমিসহ আরও অনেকেই। এই গল্পটি সাজানো হয়েছে এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার নিয়ে। এতে বেশ কয়েকটি চুমো ও যৌন দৃশ্য রয়েছে। সেই দৃশ্যগুলোর স্ক্রিনশট এবার সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এই ওয়েব সিরিজ দুটি আমাদের মূল্যবোধের সঙ্গে বেমানান। এ প্রসঙ্গে অভিনেত্রী মৌটুসী বিশ্বাস বলেন, ‘অনেকে বলছেন, আমাদের নাটক ধ্বংস হয়ে যাবে! তাদের আমি বলছি, এটি নাটক নয়, একটি ওয়েব সিরিজ। শুধু তা-ই নয়, এটি ইউটিউবের মতো ওপেন প্লাটফর্মে প্রকাশিত হওয়ার কথাও ছিল না। একটি নির্দিষ্ট প্লাটফর্মে সাবস্ক্রাইবেশন ফি দিয়ে দেখতে হবে এটা বলা হয়েছিল। তার মানে এটি একটি ১৮+ গল্প। সুতরাং যে দেখবে সে প্রাপ্তবয়স্ক। প্রাপ্তবয়স্করা এ ধরনের কাজ নিয়মিতই দেখছে। আমরা যে কাজটি করেছি তার গল্প যেদিকে গেছে, সেভাবে শুধু অভিনয়টুকু করেছি। কতটা শারীরিকভাবে ঘনিষ্ঠ হয়ে কাজটা করেছি, তা শুটিং স্পটে থাকলে আপনারা বুঝতেন।’
‘সদরঘাটের টাইগার’ সুমন আনোয়ার পরিচালিত ওয়েব সিরিজ। এতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন ছোট পর্দার অভিনেতা শ্যামল মওলা। তার বিপরীতে লাইলী চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফারহানা হামিদ। গল্পে দেখা যায়, সদরঘাটের শ্রমিক টাইগার। সে লাইলীকে ভালোবাসে। লাইলী পতিতা। তাদের মধ্যে প্রেম হয়। এরপর ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে। এই ওয়েব সিরিজের অধিকাংশ সংলাপে একাধিকবার অশালীন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু শব্দগুলো মুছে দেওয়া হয়নি। সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ প্রসঙ্গে শ্যামল মওলা বলেন, ‘এই ওয়েব সিরিজের রেসপন্স বেশ ভালো! বাংলাদেশে এই বাজেটের এই লেভেলের ওয়েব সিরিজ করা সাহসের ব্যাপার!’ সমালোচনা তো থাকবেই! নতুন কিছু যখন হয় তখন কেউ খুশি হবেন, কেউ অখুশি হবেন- এটাই তো স্বাভাবিক। বিষয়টি পরিচালকের ব্যাপার। আমার ভূমিকা হচ্ছে অভিনয় করা। আশা করছি আপনারাও এপ্রিসিয়েট করবেন। দুনিয়া যেভাবে চলছে আমরাও সেভাবে চলছি!’
২০১৭-১৮ সালে অনলাইনে মুক্তি পাওয়া কিছু নাটকে দেখা যায় কতিপয় তারকার খোলামেলা দৃশ্য। সেই সময় ‘আবাসিক হোটেল’, ‘হেলেন অব ট্রয়’ সিরিজগুলোতে কিছুটা খোলামেলা দৃশ্য থাকায় বেশ সমালোচনার মুখেও পড়েন সেগুলোর নির্মাতা এবং শিল্পীরা। এরপর শ্যামলের ‘আন্ডারশেভ’ও ছিল অশ্লীল দৃশ্যে ভরা। নির্মাতা ও প্রযোজকরা মনে করেন, দর্শকদের অনলাইন প্লাটফর্মমুখী করতেই বিদেশি ওয়েব সিরিজের অনুকরণে কনটেন্ট নির্মাণ করতে চাইছেন দেশি নির্মাতারা। সে ক্ষেত্রে তারা এরকম কিছু দৃশ্য জুড়ে দিচ্ছেন, যা ২০০০ সাল পরবর্তী বাংলা চলচ্চিত্রের কাটপিসের মতো। এসব ওয়েব সিরিজের বাজেট নাটকের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। সে কারণে অভিনয়শিল্পীদের আগ্রহও থাকে বেশি। প্রযোজকদের আগাম শর্ত মেনে চুক্তি করেই কলাকুশলীরা যুক্ত হন এসব সিরিজে। টিভি প্রযোজক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাজু মনতাসির বলেন, ‘আমরা শুনেছি, নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে অ্যাসোসিয়েশনের বাইরের কিছু প্রযোজক শিল্প-সংস্কৃতির তোয়াক্কা না করে সুড়সুড়ি জাগানো কাজ করছেন।
এসব ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই। আমরা শিল্পী এবং নির্মাতাদের নৈতিকভাবে সৎ থাকতে অনুরোধ করতে পারি।’ চলচ্চিত্রে নোংরা সংলাপ, অশ্লীল পোশাক, নকল গল্পের ওপর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু নাটক বা ওয়েব সিরিজের কোনো সেন্সর নেই। তারই সুযোগ নিচ্ছেন কেউ কেউ। সরকার যেখানে পর্নোগ্রাফি বন্ধে তৎপর, সেখানে ওয়েব সিরিজের নামে এই অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। বিশেষ করে যারা টেলিভিশনে নিজস্ব সংস্কৃতি বজায় রেখে অভিনয় করছেন, তাদেরই ওয়েব সিরিজে অশালীন দৃশ্যে অভিনয় করতে দেখে বিস্মিত হচ্ছেন অনেকে।