লিখেছেন আজমিনা তোড়া
বিশ্ববিদ্যালয়ে লাজুক স্বভাবের এক থিয়েটার কর্মীকে চিনতাম। খুব সামান্য পরিচয়। মাঝে মাঝে ফাঁকা ক্যাম্পাসে বসে বাঁশি বাজাতো! কেউ সুরের প্রশংসা করলে বিনয়ীভাবে হাসত। হঠাৎ-ই একদিন বন্ধুবান্ধব মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে ছবি দেখতে গেলাম। শুনলাম নতুন পরিচালক। দুই একটা শর্ট ফিল্ম করে বড় বড় সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখছে।
সিনেমা দেখতে গিয়ে দেখি অডিটোরিয়াম এ তিল ধারণের জায়গা নাই। ছেলেপেলে সব মাটিতে বসে সিনেমা দেখার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ‘প্রারম্ভ’ নামের সেই সিনেমা দেখার পর অবাক হয়ে দেখি সিনেমার পরিচালক সেই লাজুক আর স্বল্পভাষী চৈতন্য রাজবংশী।
এই অল্প বয়সে (তখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় বর্ষে) এবং একেবারেই পুঁজিহীনভাবে সে বিশ্ববিদ্যালয়েরই পাত্র পাত্রী আর এর-তার ক্যামেরা ধার করে ফাটাফাটি একটা সিনেমা দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। এই দিয়েই বড় কাজে হাত দেয়া রাজবংশীর। এর পর একে একে প্রত্যর্পণ সহ আরও উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ তার ঝুলিতে এনে দিয়েছে বেশ কিছু পুরস্কার। মাদকের ভয়াবহতার ওপর নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র “না” ঢাকা শিল্পকলা একাডেমি, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শন করা হয়।
স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পরভুঁইও বলি দেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন সম্মান বয়ে আনে। তিনি ২০১৮ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর অন্যতম সম্মাননা “সাস্টসিসি এওয়ার্ড ২০১৮” লাভ করেন।
বর্তমানে সদ্য স্নাতকোত্তর পাশ করা প্রতিটা ছেলে সরকারি চাকুরির সোনার হরিণ ধরার পেছনে যখন ব্যস্ত, সেই সময়ে অন্য রকম ভাবনার এক যুবক চৈতন্য। সমাজের অসংগতিগুলো তুলে ধরাই যেন তার প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব। সমাজে নারীর অবস্থান,নারীর প্রতি সহিংসতা, জঙ্গিবাদ, প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার ফাঁকফোকর, সব নিয়েই যেন একা আর ভাবনা। চৈতন্য অনুধাবন করেছে, তরুণ সমাজ এখন বই পড়া ভুলে গেছে। তবে তারা প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখতে যায়। ভাল সিনেমা হলে তা বাংলা হলেও তরুণ সমাজ সেই সিনেমা দেখে। সেই বোধ থেকেই তার বিশ্বাস জন্মেছে তরুণদের ভাবনার জগতে নাড়া দিতে পারে কেবল সিনেমা!
মাটি ও মাতার কাছে কখনো হার মানেনি চৈতন্য। মাটির টান, বাঁশির সুর আর লোকগান তার সিনেমার উপজীব্য। এই উপজীব্য কে অন্তরে ধারণ করে হঠাৎই অনুধাবন করে কুমারপাড়ার কথা, কুমারদের মাটি নিয়ে প্রতিনিয়ত যুদ্ধের কথা,বাজার থেকে মাটির জিনিসের চাহিদা উঠে গেলেও সেই বাপ দাদার তথা দেশের ঐতিহ্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তা, দিন শেষে মাটির ঈশ্বর হয়ে ওঠার গল্প। এই গল্প বাংলা সিনেমায় আগে কেউ কখনো বলেনি।বাংলা সাহিত্যেও কুমারদের নিয়ে তেমন কথা হয়নি কোথাও। অথচ এই শিল্পটা বিলীন হতে চলল প্রায়।একে এখন ধরে রাখা না গেলে পরে আর পারা যাবে না।
ভাবনা আছে, অথচ সাধ্য নেই। ‘মাটিশ্বর’ এর ভাবনা মাথায় নিয়ে যখন টাঙ্গাইল এর এলাসিন গ্রামে তার নিজভূমে করোনার সাধারণ ছুটি কাটছে তখন কুমারপাড়ার কয়েকজন যুবক পরামর্শ দেয় ভাল ক্যামেরা না থাকলেও যেন কাজ শুরু করা হয়, কারণ সাধারণ ছুটি শেষ হলে সবাই কর্মস্থলে ফিরে যাবে। এই কাজটা করার সুযোগ এভাবে আর পরে নাও আসতে পারে। উপায়ন্তর না দেখে চৈতন্য কাজ শুরু সাধারণ একটা মোবাইল আর সেলফি স্টিক নিয়ে।
এবারের চৈতন্যের নিবেদন ‘মাটিশ্বর’ পুরোটাই মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ধারণ করা। ইচ্ছাই যে মানুষের একমাত্র অদম্য শক্তি চৈতন্যের ‘মাটিশ্বর’ তারই প্রমাণ। চৈতন্যে জানায়, “ছোট বেলা থেকেই কুমার দের দেখে আসছি। মাটির সাথে তাদের অস্তিত্বের জীবনচিত্র। হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করতে হয় তাদের। রচিত হয় তাদের জীবন প্রবাহ। মাটিই যেন হয়ে উঠে ঈশ্বর। এই মাটির স্বরূপ সন্ধান করতেই আমার এই কাজ।”
বর্তমানে কাজটির চিত্রগ্রহণ প্রায় শেষের দিকে। সিনেমার প্রধান সহ-পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন রাম পাল ও পার্থ পাল।সহযোগিতায় আছেন দিপু পাল, সাব্বির আহমেদ ও ইমরুল হাসান।