• যাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে তারা নির্ভয়ে সামনে এসে কাজ করতে পারেন।
• মাস দুয়েকের মধ্যে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যাবে।
• মাস্ক পরা আবশ্যক।
• সবচেয়ে বেশি ভয় আমাদের পানি নিয়ে। পানির মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়াতে পারে।
• ইরান, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, কানাডা থেকে আমাদের কাছে কিট চেয়েছে। জাপানও চেয়েছিল।
• ইউরোপিয়ান কমিশনকে অনুরোধ করলে কিটের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দিতে পারে।
• প্লাজমা থেরাপি ভালো, তার চেয়েও ভালো সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীর রক্ত দেওয়া।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ‘জিআর-কোভিড-১৯ র্যাপিড টেস্ট’ কিট উদ্ভাবক বিজ্ঞানী-গবেষক দলের প্রধান ড. বিজন কুমার শীলের থেকে মানুষের অনেক কিছু জানার আছে। জানার আগ্রহ আছে ড. বিজন সম্পর্কেও। দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে প্রথম কথা বলেছিলাম গত ৩০ মে। তিনি বলেছিলেন অনেক কিছু। কিন্তু পাঠকের আরও বহুকিছু জানার বাকি রয়ে গেছে। ফেসবুকে-ফোনে-ইমেইলে আমরা পাঠক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। সে কারণে আবারও তার মুখোমুখি হয়েছিলাম গত ৭ জুন। বেশ কয়েকজন পাঠকের প্রশ্নেরও জবাব দিয়েছেন ড. বিজন কুমার শীল।
করোনা নিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মনে আতঙ্ক এবং বহুবিধ প্রশ্ন। এটি কি দুর্বল হয়ে গেছে? নাকি আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছে? প্রাণহানির সংখ্যা কি আরও বাড়বে? মানুষের করণীয় কী? আমরা ঠিক কোন অবস্থানে আছি?
আমার পর্যবেক্ষণ, বাংলাদেশে বর্তমানে পাঁচ ধরনের মানুষ আছেন। প্রথম সেই সৌভাগ্যবান মানুষরা যারা এক সময় নিজেদের দুর্ভাগ্যবান মনে করতেন। তারা সংক্রমিত হয়ে আবার সুস্থ হয়েছেন। তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আর এই রোগে আক্রান্ত হবেন না। কিছু মানুষ আছেন যারা আক্রান্তদের কাছ থেকে কিছুটা সংক্রমিত হয়েছেন। তাদের শরীরে সংক্রমণের লক্ষণ প্রকাশ পায়নি। কিন্তু, তারা আক্রান্ত। আরেকটি গ্রুপ আছে যারা প্রকৃতি থেকে সংক্রমিত হয়েছেন। তারা বাতাস বা পানির মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছেন। তাদের লক্ষণের পরিমাণ কম ছিল। হয়তো তাদের সামান্য জ্বর ছিল বা স্বাদ পাচ্ছিলেন না। করোনাভাইরাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আপনারা হয়তো ইতিমধ্যে জানেন, এই ভাইরাসে সংক্রমিত হলে মুখে স্বাদ থাকে না। এর কারণ হচ্ছে, জিহ্বায় যে স্বাদ বোঝার স্নায়ুগুলো থাকে তাতে এই ভাইরাস ইনফেকশন তৈরি করে। এমন যারা ছিলেন তাদেরও অনেকেই সুস্থ হয়ে গেছেন। তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে। তাদের আর সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আরও একটি গ্রুপ আছে, যাদের শরীরে কোনো প্রকার লক্ষণ নেই। কিন্তু, তাদের লালাতে প্রচুর পরিমাণে ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। এই মানুষগুলো আমাদের জন্য ভয়ের কারণ। তারা অসুস্থ নন, সম্পূর্ণ সুস্থ। কিন্তু, তাদের কথা বলার সময় বা বিভিন্ন ভাবেই থুতুর সঙ্গে ভাইরাসটি আমাদের মাঝে ছড়াচ্ছে। আর শেষ গ্রুপ হচ্ছে যারা এখনও ভাইরাসটির সংস্পর্শে আসেননি। তাদের সংখ্যা অনেক বেশি। তাদেরও অনেকের মধ্যেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ হবে, অনেকের হয়ত কোনো লক্ষণ দেখা যাবে না। তাদের মাধ্যমে ভাইরাসটি আরও ছড়াবে। যাদের বয়স একটু বেশি, অন্যান্য শারীরিক সমস্যা আছে তাদের জন্য এটি চিন্তার কারণ হতে পারে। এটা যেহেতু মহামারি আকার ধারণ করেছে, তাই আমরা কখনোই ভাবতে পারব না যে ভাইরাসটি থেকে আমরা দূরে থাকতে পারব।
আমি মনে করি যারা ভাইরাসটিতে সংক্রমিত হয়ে আবার সুস্থ হয়েছেন তাদের যদি খুঁজে বের করতে পারি তাহলে ১০০ ভাগ লকডাউন থেকে মুক্তি হওয়া যাবে। আমাদের পুলিশ ভাইদের রাস্তায় দেখি গরমের মধ্যে পিপিই পরে দাঁড়িয়ে থাকেন। এটা কিন্তু দুঃসহ। তাদের মধ্যে অনেকেই সংক্রমিত হয়েছেন। এটা সত্য যে অনেকের দেহেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে লক্ষণসহ, আবার অনেকেই আছেন যাদের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। তাদের খুঁজে বের করতে হবে।
খুঁজে বের করার জন্যে তো পরীক্ষা করতে হবে। আমাদের তো পরীক্ষার সক্ষমতা অত্যন্ত কম। আপনার কি ধারণা, আমরা এই প্রক্রিয়াতে এত মানুষের পরীক্ষা করতে পারব?
না পারার কোনো কারণ নেই। আমাদের মধ্যে যারা আক্রান্ত হয়েছেন, সুস্থ হয়েছেন তাদের তো আমরা চিনি। তবে যাদের মধ্যে লক্ষণহীনভাবে ভাইরাসটি ছড়িয়েছিল তাদের কিন্তু আমরা চিনি না। এই মানুষগুলোর শরীরে কিন্তু এরই মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে। অ্যান্টিবডি পরীক্ষার জন্য প্রয়োজন র্যাপিড টেস্ট। এর মাধ্যমে খুঁজে বের করা যাবে কারা লক্ষণ না দেখিয়েও অ্যান্টিবডি তৈরি করেছে।
এদের শনাক্ত করার উপায় আছে। কিন্তু তার জন্য একটা পরিকল্পনা দরকার যে আমরা কি করতে চাই। এটা করা গেলে ১০০ ভাগ লকডাউন না করে কিছু মানুষকে সামনে আনা যাবে, যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।
আপনাদের উদ্ভাবিত কিট নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা, লেখালেখি, তর্ক হয়েছে। এখনও সেটির কার্যকারিতা পরীক্ষা চলছে। আপনি কি এখনও আশাবাদী যে আপনাদের কিটের সুফল দেশের জনগণ পাবে?
আমি এখনও আশাবাদী। কারণ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিকে এর ট্রায়াল চলছে, অপর দিকে আমরাও নিজেরা এখানে এর ট্রায়াল দিচ্ছি। আমরা আশা করি এই কিটটি আলোর মুখ দেখবে। এ দেশের মানুষ এই কিটের সুফল পাবে। এই কিটের মাধ্যমে আক্রান্তদের যেমন শনাক্ত করা সম্ভব তেমনি যারা আক্রান্ত হয়ে আবার সুস্থ হয়ে গেছেন তাদেরও শনাক্ত করা সম্ভব। তাদের শনাক্ত করার মাধ্যমে সমাজে তাদের সম্মুখ সারিতে এনে করোনা মোকাবিলায় কাজে লাগানো যেতে পারে। তারা নির্ভয়ে কাজ করতে পারবেন।
আমাদের কিটের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, আমরা অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডি দুটোকেই একসঙ্গে শনাক্ত করি। থুতুর ভাইরাসটি অত্যন্ত মারাত্মক। হাঁচি দিলে যে ভাইরাসটি বের হয় তা বাতাসে থেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়। কিন্তু, থুতুর মাধ্যমে যে ভাইরাসটি বের হচ্ছে তা মাটিতে পড়ে তার চারপাশে একটি বলয় তৈরি করে। যার মাধ্যমে এই ভাইরাস দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে। ধুলা, পানি বা অন্য কোনোভাবে এই ভাইরাসটি মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এ জন্যই যারা সংক্রমিত হয়েছে কিন্তু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না তাদের শনাক্ত করা খুব দরকার। আমি মনে করি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে যথাযথ পরিকল্পনা করে এটা করা সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা যাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে তারা নির্ভয়ে সামনে এসে কাজ করতে পারেন। এমনকি তারা মাস্ক না পরেও কাজ করতে পারবেন। যাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে তাদের পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
কয়েকদিন আগে বেশ কিছু গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিটে ত্রুটি নিয়ে। এ সম্পর্কে কি একটু বলবেন?
আসলে আমাদের অ্যান্টিজেন কিটে কোনো ত্রুটি নেই। সমস্যা নমুনা সংগ্রহে। কিট আমরা নিয়মিত পরীক্ষা করে যাচ্ছি। আমরা পরীক্ষার জন্য যে কিট দিয়েছি, সেই একই লটের কিট আমরা রেখেছি। সমস্যা হচ্ছে লালা সংগ্রহ নিয়ে। রক্ত সংগ্রহ করার একটি আন্তর্জাতিক পদ্ধতি আছে। কিন্তু, লালা সংগ্রহ করতে গিয়ে আমরা দেখলাম, লালা চাওয়া হলেও অনেকে লালার সঙ্গে কফ দিয়ে দিচ্ছেন। ফলে লালা সংগ্রহ প্রক্রিয়া নিয়ে আমাদের আরও কিছু কাজ করতে হলো। আশার কথা আমরা একটি পদ্ধতি বের করে ফেলেছি, যার মাধ্যমে যেখানেই লালা সংগ্রহ করা হোক না কেন প্রায় ৯০ শতাংশ সঠিকভাবে তা সংগ্রহ করতে পারবে। এটার ট্রায়াল আমরা দিয়েছি। প্রথমেই ডা. জাফরুল্লাহ স্যারের নমুনা নিয়েছি। ১০০ নমুনার ট্রায়াল আমরা করেছি এবং বেশ ভালো ফলাফল পেয়েছি।
পরীক্ষার জন্য নতুন এই পদ্ধতি আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে দেব। এরই মধ্যে অ্যান্টিবডি কিটের ট্রায়াল সম্ভবত সম্পন্ন হয়ে গেছে। আমরা অনুরোধ করেছি এর অনুমোদন দিতে। এর জন্য হয়তো এক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে।
একজন দর্শক আপনার কাছে প্রশ্ন করেছেন কোডিভ-১৯ কতদিন থাকতে পারে। সে বিষয়ে কোনো ধারণা করা যায় কিনা?
ভাইরাসটি কতদিন থাকবে এটা বলা খুব মুশকিল। এই ভাইরাস যতদিন বাড়তে পারবে ততদিন থাকবে। যতদিন সে বাড়ার জন্য পর্যাপ্ত উপাদান পাবে ততদিন বাড়বে। যখন উপাদান পাবে না তখন আর বাড়বে না। মানুষের মধ্যে যত বেশি অ্যান্টিবডি তৈরি হবে ভাইরাসটি তত দ্রুত দুর্বল হবে, নির্মূল হবে। আমার ধারণা মাস দুয়ের মধ্যে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যাবে, যা ভেদ করে এই ভাইরাসটি আর সামনে এগোতে পারবে না।
আপনি এর আগে বলেছিলেন, বাংলাদেশে ভাইরাসটির তীব্রতা ইতিমধ্যে কমে গেছে। এই তীব্রতা বলতে কি বুঝিয়েছিলেন?
ভাইরাসটি যে হারে ছড়াতে থাকে সেখানে কোনো বাধা পেলে তার তীব্রতা হারাতে থাকে। একটা পর্যায়ে সেভাবে আর আক্রমণ করতে পারে না। এটা ইউরোপে প্রমাণ হয়েছে। সেখানে ভাইরাসটির সংক্রমণ অনেক কমে গেছে। বাংলাদেশের যে তাপমাত্রা, এখানে বাতাসে হিউমিডিটি অনেক বেশি। এই ভাইরাসটি উচ্চ তাপমাত্রা এবং উচ্চ হিউমিডিটিতে টিকতে পারে না। আমার কাছে যেসব নমুনা এসেছে সেখানেও আমি কিছু বিষয় পেয়েছি। প্রথম দিকে ভাইরাসের যে অবস্থান ছিল তা অনেকটাই কমে এসেছে। এভাবেই যদি চলতে থাকে তাহলে অচিরেই ভাইরাসটি তার শক্তি আরও হারাবে। আমরা এই ভাইরাসে তাণ্ডবলীলা থেকে মুক্তি পাব। আমাদের দেশে ক্রমশই বৃষ্টি বাড়ছে, হিউমিডিটিও বাড়ছে।
আমরা কি বাংলাদেশে করোনাভাইরাসটি নিয়ে যথাযথ গবেষণা করতে পেরেছি?
আমাদের দেশে বেশ কিছু জিনোম সিকোয়েন্স হয়েছে।
আমাদের চিকিৎসক এবং নার্সরা করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। এই সংখ্যাটা কম না। ইতালিতে হয়তো সংখ্যা আরও অনেক বেশি ছিল। ডাক্তারদের মৃত্যুর বিষয়ে আপনার ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ কী?
করোনা মোকাবিলায় একেবারেই সম্মুখে যারা থাকেন তারা হচ্ছেন চিকিৎসক এবং নার্স। তারা সার্বক্ষণিকভাবে ভাইরাসটি মোকাবিলা করেন। তাদের মধ্যে অনেকেই আক্রান্ত হয় মারা গেছেন। এই বিষয়টি কিন্তু নির্ভর করে ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার সুরক্ষা ছিল কিনা, ভাইরাস সম্পর্কে তারা কতটা জানতেন বা কি করতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ভর করে তাদের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর। হতে পারে তারা অনেক সংবেদনশীল ছিলেন। ভাইরাসের পরিমাণের ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। কারও শরীরে যদি এক লাখ ভাইরাস প্রবেশ করে আর কারও শরীরে যদি ১০ হাজার ভাইরাস প্রবেশ করে তাহলে দুজনের মধ্যে কিছু বেশ খানিকটা পার্থক্য হবে। এক লাখ ভাইরাস যে হারে বৃদ্ধি পেয়ে শরীরে ক্ষতি করবে, ১০ হাজার ভাইরাস তো আর সেই হারে করবে না। এসবের পাশাপাশি তাদের যদি অন্য কোনো সমস্যা থেকে থাকে তাহলে সেটাও একটি প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। আমি আশা করব যারা কাজ করছেন তারা আরও বেশি সতর্ক হয়ে কাজ করবেন।
একবার আক্রান্ত হলে আবার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই, এই ব্যাপারটি অফিসিয়ালি শুনতে পাচ্ছি না কেন?
২০০৩ সালে যখন সার্স করোনাভাইরাস এলো তখন সেটা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়নি। মাঝে মার্স নামে মধ্যপ্রাচ্যে এসেছিল। এ ছাড়া প্রায় ১৭ বছর ভাইরাসটি ছিল না। ডেঙ্গু নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা চলছে। করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা না হওয়ার কারণে আমরা এ বিষয়ে অনেক কিছুই জানি না।
আপনারা হয়তো লক্ষ করছেন, আমি কিন্তু এই ভাইরাসটি নিয়ে কাজ করছি। করোনা আক্রান্ত ডা. জাফরুল্লাহ স্যারেরও অনেক কাছে থাকি। কিন্তু আমি এখনও ভালো আছি। আমার ধারণা আমার ইমিউনিটি ২০০৩ সালেই তৈরি হয়েছে।
অ্যান্টিবডি তৈরি হলে কতদিন একজন নিরাপদ থাকতে পারবেন?
আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আমাদের ধারনার চেয়ে বেশি সক্রিয়। সাধারণত কোনো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হলে তা এক বছরেরও বেশি সময় শরীরে থাকে। অন্তত এক বছর তো থাকবেই, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডি কিটের অনুমোদন দিয়েছে। আপনাদের কিট এবং এফডিএর অনুমোদিত কিটের মধ্যে পার্থক্য বা সামঞ্জস্য আছে কিনা?
কোভিড ভাইরাসের অ্যান্টিবডি বের করার অনেকগুলো পদ্ধতি আছে। আমরা লালা থেকে ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ করছি। এটা সম্ভবত এখন পর্যন্ত শুধু আমরাই করতে পেরেছি। অন্যগুলো থেকে আমাদের পার্থক্য এটাই যে আমরা অত্যন্ত কম সময়ে ফল পাচ্ছি।
মাস্ক পরাটা কতটা জরুরি? কাপড়ের তৈরি মাস্ক কতটা সুরক্ষা দিতে পারবে?
মাস্ক পরা আবশ্যক। আমি মনে করি পরতেই হবে। আমি গণস্বাস্থ্য থেকে একটি মাস্ক ডিজাইন করেছিলাম যার তিনটি লেয়ার। কাপড়েরই তৈরি সেটাও। তিনটি লেয়ার ভেদ করে ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে না। এই মাস্কের সুবিধা হচ্ছে সাবান দিয়ে ধুয়ে ইস্ত্রি করে আবার পরতে পারবেন। যেকোনো মাস্ক পরলেই কাজ হবে তা নয়, মোটামুটি মানের মাস্ক পরতে হবে। কাপড়ের তৈরি তিন লেয়ারের মাস্ক অনেক ভালো কাজে দেবে।
বাসায় থেকে কতটা সুস্থ থাকা সম্ভব? বাজার বা অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস বাসায় আনতেই হচ্ছে।
ভাইরাসটি বাতাসেও থাকতে পারে। এর অর্থ এই নয় যে বাসার জানালা দরজা বন্ধ করে থাকতে হবে। দুই চারটা ভাইরাস যদি বাতাসের সঙ্গে আপনার ঘরে আসেও তা কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমার সবচেয়ে বেশি ভয় আমাদের পানি নিয়ে। পানির মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। আমরা যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারি তাহলে আমাদের সুস্থ থাকা অনেকটাই সম্ভব। যদি দু-চারটা ভাইরাস শরীরে ঢুকেই যায় তাহলে সেটা ভ্যাকসিনের মত কাজ করবে।
ধরে নিলাম আপনাদের কিট অনুমোদন পেয়ে গেল। সে ক্ষেত্রে অনুমোদন পাওয়ার কত দিনের মধ্যে আপনারা তা বাজারে দিতে পারবেন? লাখ লাখ মানুষের পরীক্ষার জন্য যে পরিমাণ কিট প্রয়োজন হবে তা তৈরির কাঁচামাল কি আপনাদের কাছে আছে?
খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন।
আমরা অনুমোদন পেয়ে গেলেই পরের দিন কিট দিতে পারব না। এটা সম্ভব না। আমরা এখন যে অনুমোদন পেয়েছি তা হলো পরীক্ষামূলক কিট তৈরি করার। যখন বাজারে দেওয়ার জন্য আমরা কিটটি তৈরি করতে যাব তখন অনেক কাঁচামাল লাগবে। তার জন্য আলাদা অনুমোদন লাগবে। অনুমোদন পেতে সপ্তাহখানেক সময় লাগতে পারে। আর সেই সঙ্গে কাঁচামাল আনতে আরও এক সপ্তাহের মতো সময় লাগবে। কাঁচামাল পেয়ে গেলে প্রতিদিন আমরা ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার কিট তৈরি করতে পারব। সেই ধরনের ব্যবস্থা আমরা নিয়ে রেখেছি। শুধুমাত্র অনুমোদন পেলেই আমরা জনবল নিব এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেব।
বেশ কিছু দেশ আপনাদের সঙ্গে কিটের জন্য যোগাযোগ করেছিল বলে জানতে পেরেছিলাম। সেগুলো কি অবস্থায় আছে?
যোগাযোগ হয়েছিল। ইরান, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, কানাডা থেকে আমাদের কাছে কিট চেয়েছে। জাপানের কাছে যখন কিট ছিল না তখন তারাও আমাদের কাছে চেয়েছিল। আরও কিছু দেশ যোগাযোগ করেছিল।
বাজারের অন্যান্য কিটের থেকে আমাদের কিটের একটি পার্থক্য আছে। এটা ব্যবহার করলে বোঝা যায়। অনুমোদন প্রক্রিয়ায় যেহেতু সময় লাগছে, ফলে আমরা তাদের কিছু বলতে পারছি না।
এই কিটটি নিয়ে আপনারা অনেক গবেষণা করেছেন, অর্থ লগ্নি করেছে। বাইরের অনেক দেশ আপনাদের কাছে এই কিট চেয়েছে। ধরেন, আপনাদের কিটটি অনুমোদন পেল না। সেক্ষেত্রে আপনারা কি করবেন?
অনুমোদন না পাওয়া দুর্ভাগ্যজনক হবে। আমাদের কিটটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা করছে। তাদের সঙ্গে আমাদের যে চুক্তি হয়েছে সে অনুযায়ী আমরা তাদের অনুরোধ করেছি পরীক্ষার উপাদান সংরক্ষণ করার জন্য। যাতে প্রয়োজনে আমরা পুনরায় সেগুলো পরীক্ষা করতে পারি।
আপনাদের কিট কি দেশের বাইরে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষা করা সম্ভব? বাংলাদেশের আইন কি?
অবশ্যই করা যায়। ইউরোপিয়ান কমিশনকে আমরা অনুরোধ করলে তারা কিটের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দিতে পারে। আমি যখন সিঙ্গাপুরে কাজ করেছি, তখন সেই দেশের আগেই আমরা অনুমোদন নিয়েছিলাম ইউরোপিয়ান কমিশনের। আমরা চাইছি এই অনুমোদন আমাদের দেশ থেকে আসুক। আপনারা হয়ত জানেন, কিটের বিভিন্ন তথ্য আমরা সহজে প্রকাশ করতে চাই না। আমরা বিজ্ঞানীরা কখনোই ১০০ শতাংশ তথ্য প্রকাশ করি না। সব তথ্য কোথাও লেখাও থাকে না। এটা যদি দেশের থেকেই অনুমোদন পায় তাহলে আমাদের সাহস থাকে।
প্লাজমা থেরাপি একটা বড় আলোচনার বিষয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই থেরাপি নিয়ে খুব একটা ইতিবাচক অবস্থায় নেই। কিন্তু, আপনি এই থেরাপি নিয়ে ইতিবাচক। আপনার অবস্থানটা একটু পরিষ্কার করবেন?
আমি আমার আগের অবস্থানেই আছি। যারা সংকটাপন্ন অবস্থায় আছেন তাদের জন্য প্লাজমা থেরাপি খুবই দরকার। যেমন ডা. জাফরুল্লাহ স্যার। তিনি যে অনেকটা সুস্থ আছেন তা এই প্লাজমা থেরাপির জন্যই। যাদের শরীরে অন্যান্য সমস্যা আছে তাদের পক্ষে এই ভাইরাসের অ্যান্টিবডি তৈরি করা খুব সহজ কাজ নয়। এই ভাইরাস রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সেই সময় আপনি যদি কারও শরীরে অ্যান্টিবডি দিয়ে দিতে পারেন তাহলে তা অবশ্যই ভালো। তবে মনে রাখতে হবে গ্রুপিংটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি বলব, সঠিক গ্রুপিং করে যদি রক্ত দেওয়া যায় তাহলে সেটা আরও ভালো। কারণ, রক্তের অ্যান্টিবডি ‘ভাইরাস যাতে বাড়তে না পারে’ তা নিয়ন্ত্রণ করে। রক্তের প্লাজমা সেল অ্যান্টিবডি তৈরি করে। প্রতি সেকেন্ডে তা দুই হাজার অ্যান্টিবডি তৈরি করে। সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীর শরীরে আরেকটি সেল থাকে, তা হলো মেমরি সেল। এটি খুব দ্রুত প্লাজমা সেল তৈরি করে। যার কারণে প্লাজমা থেরাপি ভালো হলেও তার চেয়েও ভালো সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীর রক্ত দেওয়া। এর ফলে ত্রিমুখী আক্রমণের মাধ্যমে ভাইরাসকে প্রতিহত করা যাবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভাবে অনেক কিছুই। তারা অনেক পরে অনেক কিছু স্বীকার করে। এখন তারা বলছে, উপসর্গ না থাকা রোগীরা সংক্রমণ ঘটায় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিসের উপর ভিত্তি করে এ কথা বলেছে, আমি জানি না। এই বক্তব্য বা অবস্থানের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে দ্বিমত পোষণ করছি। আমরা প্রতিনিয়ত গবেষণা করছি। গবেষণায় প্রমাণ মিলছে, উপসর্গহীন করোনা আক্রান্তদের লালায় প্রচুর পরিমাণে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি। তাদের লালায় যে পরিমাণ ভাইরাস পাচ্ছি, তা অন্যদের সংক্রমিত করবেই। উপসর্গহীনরাও ভাইরাস ছড়ায়, তারা অবশ্যই সংক্রমণের কারণ।
আমার ধারণা অল্পদিনের মধ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আবার তাদের অবস্থান পরিবর্তন করবে।
আমি মনে করি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কিছু নয়। যদি হতো তাহলে আজ ভ্যাকসিন থাকত। ২০০৩ সালে সার্স করোনাভাইরাস এসেছিল। আজ ২০২০ সাল। এত দিনেও কেন করোনাভাইরাসে ভ্যাকসিন তৈরি হলো না? এই প্রশ্ন আমি তাদের বারবার করেছি।
করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কি কেউ প্লাজমা ডোনেট করতে পারবেন? নাকি এটা জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় আছে?
যাদের শরীরে জ্বর, সর্দি, কাশি, পেটের সমস্যার মতো লক্ষণ দেখা গিয়েছে তাদের শরীরে ২১ দিনের মধ্যেই খুব ভালো পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। সুস্থ হওয়ার সাধারণত একমাস বা ৪৫ দিন পর প্লাজমা দিলে ভালো হয়। প্লাজমা ডোনেশনের আগে ডোনারের প্লাজমা খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করতে হবে। যাদের খুব সামান্য পরিমাণে করোনা সংক্রমণ হয়েছে তাদের প্লাজমা এ ক্ষেত্রে কাজে দেবে না। কারণ তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি খুব কম থাকে।
কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হয়েছে এমন রোগী যদি বেশি মাত্রায় সংক্রমিত হন তাহলে তার চিকিৎসা কী?
এ বিষয়ে ভালো উদাহরণ ডা. জাফরুল্লাহ স্যার। তিনি দীর্ঘ দিন কিডনি ডায়ালাইসিস করছেন। কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করলে অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে একটি বিশেষ ওষুধ নিতে হয়। সে ধরনের পরিস্থিতি থাকলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারেন। তবে এমন রোগীদের সাবধানে থাকাই ভালো।
মনের জোরটা অনেক বড় বিষয়। কখনো রোগকে ছাড়বেন না। করোনাকে আপনাকে জয় করতে হবে। একে কখনো ভয় পাবেন না। আপনার আশপাশ দিয়ে এটা চলে যাবে, আপনি টেরও পাবেন না। তবে সতর্ক থাকুন।
আশপাশে যদি করোনা রোগী থাকে তাহলে সতর্ক থাকব কীভাবে?
মাস্ক অবশ্যই পরবেন।
আজকের শেষ প্রশ্ন। অ্যান্টিবডি পরীক্ষা কোথায় এবং কিভাবে করব?
অ্যান্টিবডি পরীক্ষা এই মুহূর্তে বাংলাদেশে হচ্ছে না। বাংলাদেশে করোনা পরীক্ষার জন্য একমাত্র পিসিআর পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। অ্যান্টিজেন বা অ্যান্টিবডি পরীক্ষা বাংলাদেশে এখনও অনুমোদন পায়নি। করোনা চিকিৎসার জন্যে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের কিট দিয়ে যা তিন থেকে পাঁচ মিনিটে করা সম্ভব।
আশা করছি আমরাই প্রথম তা করতে পারব, অনুমোদন পাব। গণস্বাস্থ্যের প্রতিটি কর্মী এবং দেশের মানুষ আশা করছেন তারা এই কিটের সুফল পাবেন।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন গোলাম মোর্তোজা