সোহরাব হাসান:
করোনাভাইরাস সংক্রমণের মতো মহাদুর্যোগে সাধারণ মানুষ আশা করেন তাঁরা যাঁকে নির্বাচিত করেছেন, তিনি তাঁদের পাশে থাকবেন, সাধ্যমতো সহায়তা করবেন। কিন্তু এই সময়ে বাংলাদশেরই একজন সাংসদ জনগণের পাশে না থেকে কুয়েতের কারাগারে আছেন মানব পাচারের অভিযোগে।
এই সাংসদের নাম কাজী শহিদ ইসলাম ওরফে পাপলু। লক্ষ্মীপুর–২ আসন থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত। তাঁর নির্বাচিত হওয়ার একটি কাহিনি আছে। তার আগে কুয়েতের সর্বশেষ খবরটি জেনে নিই।
৬ জুন কুয়েতের গোয়েন্দা পুলিশ শহিদ ইসলামকে গ্রেপ্তার করে মানব পাচার ও অবৈধ মুদ্রা পাচারের দায়ে। এরপর তাঁকে দেশটির আদালতে হাজির করা হলে রাষ্ট্রপক্ষ রিমান্ডের আবেদন জানায়। আদালত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যত দিন প্রয়োজন তত দিন রাখার নির্দেশ দেন। তিনি এখন কুয়েতের কারাগারে আছেন। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড কারাগারে তাঁর অবস্থান নিয়ে ২ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে। শহিদ ইসলাম প্রথমে তাঁর বিরুদ্ধে কুয়েত সরকারের আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাঁর দাবি,বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক পাঠাতে তিনি কোনো অর্থ নেননি। পরে কুয়েতের পুলিশ যখন তাঁকে অভিযোগকারী বাংলাদেশি শ্রমিকদের মুখোমুখি করে, তখন তিনি তাঁর ‘কিছু সীমাবদ্ধতা ও ভুলের’ কথা স্বীকার করেন। এর আগে কুয়েতে কর্মরত সাতজন বাংলাদেশি শ্রমিক কুয়েত সরকারের কাছেঅভিযোগ করেন যে এমপি শহিদ ইসলাম তাঁদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৩০ হাজার দিনার করে নিয়েছেন।
এ ছাড়া তাঁদের ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর জন্যও মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন। কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক পত্রিকায় বাংলাদেশি সাংসদ শহিদ ইসলামের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর ছাপা হয়েছে। এসব খবরের পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কুয়েতের বাংলাদেশ মিশনের মাধ্যমে বিষয়টির সত্যাসত্য জানার জন্য চিঠি লেখে। কুয়েত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। যদিও তাঁরা অনানুষ্ঠানিকভাবে জানতে পেরেছেন সাংসদ শহিদ কুয়েতের কারাগারেই আছেন।
এদিকে কুয়েতের উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আনাস আল সালেহ শনিবার তাঁর টুইটে বলেন, দেশে সবচেয়ে বড় মানব পাচার চক্রের হোতা এশিয়ার একটি দেশের নাগরিককে আটক করা হয়েছে। মানব পাচারের অভিযোগের তদন্তে সরকারি কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী ব্যক্তি যে–ই হোক না কেন, তাঁদের বিচারের আওতায় আনা হবে। কাউকে ন্যূনতম ছাড় দেওয়া হবে না। (প্রথম আলো, ১৫ জুন, ২০২০)
কুয়েতি উপপ্রধানমন্ত্রী কোনো দেশের নাম উল্লেখ না করলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তিনি বাংলাদেশের প্রভাবশালী ব্যক্তির কথাই বলেছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে আরও জানা যায়, শহিদ ইসলামের অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে দেশটির কিছু সরকারি কর্মকর্তারা জড়িত। এর আগে খবর বের হয়েছিল, শহিদ ইসলাম কুয়েতের সাতজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে সাতটি দামি গাড়ি উপঢৌকন হিসেবে দিয়েছেন।
কুয়েতের উপপ্রধানমন্ত্রী তাঁর টুইটে মানব পাচারকারীদের ধরার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সাধুবাদ জানিয়েছেন এবং অভিযান চলবে বলে জানিয়েছেন। কূটনৈতিক সূত্রের বরাতে প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে মানব পাচার নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল কুয়েত। তাঁদের ধারণা, মানব পাচারকারীরা এই সুযোগে দেশটিতে অনেক মানুষকে পাচার করে দিতে পারে। বিষয়টি কুয়েতের পার্লামেন্টেও আলোচনা হয়েছে।
৪ এপ্রিল পার্লামেন্টের স্পিকার মারজুক আল ঘানিম মানব পাচারের বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন,করোনাভাইরাসের বিস্তারের মধ্য দিয়ে ভিসা–বাণিজ্যের নামে মানব পাচারের সঙ্গে যুক্ত লোকজনের মুখোশ খুলে দিয়েছে। কুয়েতের সাংসদ আবদুল করিম আল কানডারি মানব পাচার ও অবৈধ মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক সাংসদ কাজী শহিদ ইসলামের সঙ্গে জড়িত কুয়েতের মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তাদের নাম প্রকাশ করার দাবি জানিয়েছেন।
আটকের পর কুয়েতের সিআইডি সাংসদ কাজী শহিদ ইসলামের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পর্কে ১১ জনের সাক্ষ্য নিয়েছে। ১১ জনই সাংসদের বিরুদ্ধে মানব পাচারের অভিযোগ আনার পাশাপাশি প্রতিবছর ভিসা নবায়নের জন্য বাড়তি টাকা নেওয়ার অভিযোগ এনেছেন বলে কুয়েতের পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছে। কুয়েতের গোয়েন্দারা আটক সাংসদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের লোকজনের অভিযোগ আর ব্যাংকসহ কুয়েতের স্থানীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত বুধবার সাংসদ কাজী শহিদের প্রতিষ্ঠান মারাফি কুয়েতিয়া গ্রুপের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মুর্তজা মামুনকে আটক করে। মুর্তজা মামুন কানাডার নাগরিক।
অপর এক খবরে বলা হয়, সিআইডি শহিদ ইসলামের চেকবই জব্দ করেছে এবং তাঁর ব্যাংক হিসাবে প্রচুর অর্থ লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে। উল্লেখ্য, গত ফেব্রুয়ারিতে কুয়েতের পত্রিকায় শহিদ ইসলামের বিরুদ্ধে মানব পাচারের মামলাসংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হলে তিনি তা অস্বীকার করেন। এরপর মার্চে কুয়েতে যান তিনি। সেখানে তাঁর বব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মারাফি কুয়েতিয়ার প্রধান নির্বাহীও তিনি। ব্যবসার কাজে বছরের বেশির ভাগ সময় তাঁকে কুয়েতে থাকতে হয়।
মার্চে কুয়েতে যাওয়ার সময় তিনি সাংসদ হিসেবে পাওয়া কূটনৈতিক পাসপোর্ট ব্যবহার না করে ব্যবসায়ী হিসেবে নেওয়া পাসেপার্ট ব্যবহার করেছেন। অথচ বাংলাদেশের আইনানুযায়ী একজন নাগরিক দুটি পাসপোর্ট ব্যবহার করতে পারেন না। আওয়ামী লীগের ১৯৯৬–২০০১ সালের সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী ব্যক্তিগত পাসপোর্টে সিঙ্গাপুর সফর করার কারণে পদচ্যুত হতে হয়েছিল। একই আইনে শহিদ ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
এবার আসি শহিদ ইসলামের রাজনৈতিক আখ্যান প্রসঙ্গে। ১৯৮৯ সালে তিনি একটি কোম্পানির সুপারভাইজার পদে চাকরি নিয়ে কুয়েতে যান। ১৯৯০ সালে ইরাক কুয়েত দখল করলে তিনি দেশে ফিরে আসেন। পরে কুয়েতের অবস্থা স্বাভাবিক হলে তাঁর ভাই কুয়েত বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী মনজুরুল আলমের সহায়তায় ফের সেখানে যান। তখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ফলে তাঁর খুঁটি বদলের প্রয়োজন হয়। ২০১৬ সালে তিনি দেশে এসে এলাকায় প্রচুর দান–খয়রাত করতে থাকেন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অর্থসহয়াতা দেন।
২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ আসনটি মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়। এরপর শহিদ ইসলাম ভিন্ন কৌশল নেন। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীদের নিজের পক্ষে নিয়ে আসেন।
নির্বাচনের ১৫ দিন আগে জাতীয় পার্টির প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। তাঁর এই ঘোষণা এবং আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীদের শহিদ ইসলামের পক্ষে নামার নেপথ্যে টাকার খেলা ছিল বলে আওয়ামী লীগের নেতারাই এখন স্বীকার করেছেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর শহিদ ইসলামের দ্বিতীয় মিশন ছিল তাঁর স্ত্রীকে সংরক্ষিত কোটায় সাংসদ বানানো এবং তাতেও সফল হন। স্বামী–স্ত্রী দুজনই জাতীয় সংসদের সদস্য। স্বামী মানব পাচারের অভিযোগে কুয়েতের কারাগারে। এই অভিযোগের সঙ্গে স্ত্রীর কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের রাজনীতি, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পেছেন যে টাকার খেলা হয়, শহিদ ইসলাম অনেক উদাহরণের একটি মাত্র। যেখানে সারা জীবন রাজনীতি করে, জেলজুলুম সহ্য করেও দলের ত্যাগী নেতারা নির্বাচনে মনোনয়ন পান না, সেখানে এ ধরনের লোক কীভাবে নির্বাচিত হন, তা মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। ব্যবসা করে কেউ রাজনীতি করতে পারবেন না, সে কথা আমরা বলছি না। কিন্তু যাঁরা রাজনীতিকে ব্যবসার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন, তাঁদের সম্পর্কে নতুন করে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, বাংলাদেশের একজন সাংসদ বিদেশে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এটি দেশের জন্য লজ্জাজনক। এই লজ্জা শুধু দেশের নয়, সরকার ও সংসদেরও। বর্তমানে জাতীয় সংসদের অধিবেশন চলছে। বাজেট ছাড়া অন্য বিষয়ে আলোচনা হবে না বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু যে ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সংসদের মানসম্মানের প্রশ্ন জড়িত, সেই ঘটনা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। প্রয়োজনে এক ঘণ্টার আলোচনা হোক। তবু কেন একজন সাংসদ বিদেশে কারারুদ্ধ হয়ে আছেন, তা জানার অধিকার দেশবাসীর আছে। কেননা তাদের করের অর্থেই সাংসদের বেতন–ভাতা দেওয়া হয়।
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি