ভোরের আলো ডেষ্ক: চমক নিয়ে আসছেন ডাকসু ভিপি নুর? তার পরিবর্তনের ঘোষণায় কি থাকছে? কেন তিনি নতুন দল গঠন করতে যাচ্ছেন? এমন নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ছাত্র আন্দোলন করতে গিয়ে দেশজুড়ে আলোচিত নুরুল হক নুর। পটুয়াখালীর চরাঞ্চলে বেড়ে ওঠা নুর দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ভিপি। ছাত্র অধিকার পরিষদের ব্যানারে আন্দোলন করতে গিয়ে বহুবার তিনি হামলার শিকার হয়েছেন। তারপরও দমে যাননি। এবার তিনি রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়ে ফের আলোচনায়। নুরের কথা- দলের মধ্যে যদি গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকে তাহলে কিভাবে দেশের মানুষকে ওই দল গণতন্ত্র উপহার দেবে? একটি দল যদি সঠিক নেতা বাছাই করতে না পারে তাহলে তারা কিভাবে মানুষের জন্য সঠিক নেতৃত্ব তৈরি করবে? নুর বলেন, আমরা চাই এই সিস্টেমের পরিবর্তন করতে। দলের মধ্যেই গণতন্ত্রের চর্চা করতে।
তার কাছে প্রশ্ন-কবে নাগাদ আপনার দল আত্মপ্রকাশ করবে? নুর বলেন, আমরা কাজ করছি অনেকদিন ধরেই। নির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণ বলবো না। তবে চমক হিসেবে দেখতে পাবে মানুষ। আমরা চেষ্টা করছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক এবং সিভিল সোসাইটিতে যাদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে তাদের যুক্ত করতে। আমরা নামসর্বস্ব দল, কিংবা এক ব্যক্তি এক দল- সেরকম চাচ্ছি না। এ জন্যই আমরা একটু সময় নিচ্ছি। অনেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে চান, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করছি সেসব মানুষের কাছে পৌঁছানোর।
নুরুল হক নুর বলেন, আমরা সব সময় বলে আসছি বর্তমানে দেশে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বা যে ধরনের রাজনীতি চলছে সেটা সাধারণ জনগণের কাঙ্ক্ষিত রাজনীতি না। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের দ্বারপ্রান্তে আমরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে মূলমন্ত্র ছিল সাম্য মানবিক মর্যাদার সামাজিক সুবিচার এবং বৈষম্যহীন একটি সমাজ গঠন করা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। আমি মনে করি এর কোনো একটি অংশও এখন পর্যন্ত পুরোপুরি পূরণ হয়নি। না পেয়েছি আমরা একটি বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা। না পেয়েছি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। না প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি ন্যায় বিচার। সে জায়গা থেকে আমরা দেখেছি মানুষের মনে অনেক ক্ষোভ রয়েছে। বিশেষ করে তরুণ সমাজ দেখেছে প্রতিহিংসার রাজনীতি। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তারা দমন-পীড়নের রাজনীতি করে। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য নানা ধরনের অপচেষ্টা চালায়। এসব কারণে তরুণ সমাজ এই রাজনীতি থেকে বিমুখ হচ্ছে। সে কারণে তরুণ সমাজকে রাজনীতিতে আকৃষ্ট করার জন্য আমরা বলেছি, তরুণদের নিয়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে চাই। কারণ আমাদের যে সিনিয়র সিটিজেন তাদের রাজনীতির চিন্তা-ভাবনা এবং চিন্তাধারা আমরা দেখেছি। আমরা মনে করি গত পঞ্চাশ বছরে তারা ব্যর্থ হয়েছে। যেহেতু আমি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। তারপরও অন্যান্য পেশার মানুষকে যুক্ত করার জন্য আমরা যুব অধিকার পরিষদ গঠন করেছি। শ্রমিকদের যুক্ত করতে শ্রমিক অধিকার পরিষদ গঠন করেছি। দেশের যেহেতু দেড় কোটির মতো শ্রমিক যারা প্রবাসী। বিভিন্ন দেশে রয়েছেন। সুতরাং তাদেরও আমি মনে করি দেশের প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সে কারণে তাদের যুক্ত করতে একটি প্রবাসী অধিকার পরিষদ গঠন করেছি। আল্টিমেটলি আমাদের ভিত্তিগুলো যদি মোটামুটি শক্তভাবে তৈরি করতে পারি তারপর হয়তো মূল দল ডিক্লারেশনের চিন্তা-ভাবনা করবো।
দেশে প্রতিষ্ঠিত একাধিক দল থাকতে মানুষ কেন আপনাদের নতুন দলের প্রতি আকৃষ্ট হবে?
ভিপি নুর বলেন, ষাটের দশকের শুরুতে, আশির দশকের শুরু বা শেষের দিকে, বাহান্নের ভাষা আন্দোলনসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছিল ছাত্র রাজনীতির বিশাল ভূমিকা। ছাত্ররা বিভিন্ন গণআন্দোলনে মানুষের গণমুখী কথা বলতো। আন্দোলন করতো। সে কারণে ছাত্রদের ভালো একটি অংশগ্রহণ ছিল। ওই সময় ছাত্র আন্দোলনগুলোতে শিক্ষকরা, সাংবাদিকরা সমর্থন দিতেন। কিংবা অংশগ্রহণ করতেন। মেধাবী ছাত্ররা সেখানে নেতৃত্ব দিতেন। কিন্তু এখন এই মেধাভিত্তিক রাজনীতিটা নেই। আজকে আমরা দেখতে পাই ক্ষমতাসীন দল, বিরোধী দলের বড় বড় নেতারা নিজেরাই বলেন যে, এখন রাজনীতি অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিতদের হাতে। রাজনীতি ধান্ধাবাজ-টেন্ডারবাজদের হাতে। সুতরাং তার মানে বোঝা যাচ্ছে যে এই কারণেই হয়তো আমরা যেটা বলি ভদ্রলোক, শিক্ষিত লোক কিংবা সৎ সাহসী লোক এই নোংরা রাজনীতি পছন্দ করে না। আমরা সেখানে চেষ্টা করবো যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেয়ার। এখানে মেধাবী মানুষদের উৎসাহী করবো। আমরা মনে করি, আমাদের দেশে যে প্রথা চালু হয়েছে- একজন হোমরা চোমরা ছোট নেতা যায়, তার পেছনে একটি বিশাল বহর হেঁটে যায় তাকে প্রটোকল দেয়ার জন্য। এটা তো একটি রাজনীতির ধারা হতে পারে না। রাজনীতি করবেন সমাজের প্রয়োজনে। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে। সমর্থকরা মিছিল-মিটিং করবে। কিন্তু কোনো ব্যক্তি-পূজার যে রাজনীতি এটা কোনো রাজনীতির সংস্কৃতি না। আমাদের দেশে দেখা যায় কোনোমতে একজন ছোটোখাটো নেতা বা জনপ্রতিনিধি হতে পারলে সে মনে করে রাজনীতিটা একটি টাকা কামানোর মেশিন। এই যে একটি অসৎ চিন্তা-ভাবনা এ কারণে সৎ মানুষগুলো রাজনীতি থেকে দূরে। এখানে আমরা তরুণ এবং আমাদের অন্যতম একটি বিশেষত্ব হচ্ছে এখানকার নেতৃত্ব দেবে তরুণরা। আমরা সিনিয়র সিটিজেনদের কাছ থেকে পরামর্শ নেবো। কিন্তু এটার পরিচালনা করবে এবং নেতৃত্ব দেবে তরুণরা। নিউজিল্যান্ডের মন্ত্রিসভার বেশিরভাগ নেতার বয়স চল্লিশের নিচে। আমরা চাই যে এই ধরনের তরুণরা একটা চমক দেখাক। এবং আমাদের বিশ্বাস বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই পরিবর্তন চায়। দেশে এখন যে রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্যতা বা বিরাজনীতিকরণ চলছে। ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে শুরু করে এখন দেশে কোনো রাজনীতি আমি মনে করি না আছে। ২০১৩ সালের পর থেকে বিরোধী দলগুলোর যে ভূমিকা পালন করার কথা ছিল তারা আদৌ কি পেরেছে? পারেনি। এই যে গৃহপালিত বিরোধী দল বা প্যাকেট গৃহপালিত বিরোধী দল বলেন। এছাড়া অন্য যে বড় বড় শক্তি বা রাজনৈতিক দলগুলো আছে তারা কি করতে পেরেছে। মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হলো এটার স্বপক্ষে কি করতে পেরেছে? তারা কোনো বৃহৎ আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছে? পারেনি। মানুষ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আজকে আইনকে প্রভাবিত করে ক্ষমতাসীনরা। এটা শুধু বর্তমান সরকার নয় এর আগেও যারা ক্ষমতায় ছিলেন একই কাজ করেছেন। তারা এটার পক্ষে মানুষকে একত্রিত করা, প্রতিবাদ করা এর কোনোটিই পারেনি। সমপ্রতি আমেরিকায় একজন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লোয়েডের পুলিশের হাতে মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ওই অঙ্গরাজ্য থেকে পুলিশকে বিলুপ্ত করা হয়েছে। সেখানকার পুলিশের সংস্কার নিয়ে কথা হলো। আমাদের দেশে অহরহ পুলিশের হাতে নাগরিকরা নির্যাতিত হচ্ছে। প্রাণ হারাচ্ছে। থানার ভেতরে মানুষ মারা যাচ্ছে পুলিশের হাতে। কোথাও একটা প্রতিবাদ হয়েছে এটা নিয়ে? কারণ এখানে তো ভয়ের রাজনীতি চলছে। ভয় দেখিয়ে মানুষকে দমিয়ে রাখার একটি প্রবণতা চলছে। এখন আমরা বিশেষ করে কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন করেছি। এখানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেখিয়ে দিয়েছে। আগে অনেকেই মনে করতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরাই আন্দোলন-সংগ্রাম করে। সেখানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছে এখন আন্দোলন আর পাবলিক-প্রাইভেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন ছাত্ররা আন্দোলন করতে জানে। দাবি আদায় করতে জানে। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে যেভাবে ভূমিকা পালন করেছে। এটা শুধুমাত্র নিরাপদ সড়কের জন্য নয়। তাদের প্লাকার্ডে স্লোগান ছিল, পঞ্চাশ বছরের জঞ্জাল সরানোর কাজ চলছে। রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে। উই ওয়ান্ট জাস্টিস। জাস্টিসের পরিধিটা ব্যাপক। এর মধ্যে দিয়ে তরুণরা এবং আমরা বিশেষ করে ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছি তারা চায় একটি রাজনীতির যদি সুন্দর পরিবেশ হয় তাহলে তারা রাজনীতিতে উৎসাহী হবে। এ কারণে আমরা চেষ্টা করছি বিশেষ করে তরুণদের যুক্ত করে তাদেরকে আকৃষ্ট করে নতুন রাজনৈতিক দল করতে। সেক্ষেত্রে গতানুগতিক রাজনৈতিক দলগুলো একটি পরিবার কেন্দ্রিক রাজনীতি করছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দলটি এখন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের মধ্যেই নেতৃত্বটা সীমাবদ্ধ হয়ে গেল। বিএনপি জাতীয়তাবাদী দল জিয়া পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়েছে। এবং ভবিষ্যতে তাই হবে। তাই বলি একটি দলের মধ্যে যদি গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকে তারা কীভাবে দেশের মানুষকে গণতন্ত্র উপহার দেবে। আমরা চাই এই সিস্টেমের একটা পরিবর্তন করতে।