ভোরের আলো ডেষ্ক: হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল। অসুস্থ রোগী নিয়ে ধরনা। কোথাও মিলছে না ঠাঁই। মিলছে না চিকিৎসা। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে রাস্তায়ই প্রাণ যাচ্ছে মানুষের। আবার কিছু কিছু সরকারি হাসপাতালে ভাগ্যগুণে ভর্তি হতে পারলেও চিকিৎসা পাওয়া আরেক ভাগ্যের ব্যাপার। সেখানে ট্রলি থাকলে ট্রলি ঠেলার লোক মিলে না। আর আইসিইউ, অক্সিজেনের হাহাকার তো আছেই।চিকিৎসার অভাবে খোদ হাসপাতালের মালিক ও চিকিৎসকও মারা গেছেন। কিন্তু শত অভিযোগ কানে তুলছে না কেউ। তাই মিলছে না এ থেকে নিষ্কৃতি।
গতকাল সকাল ১১টা। মিটফোর্ড হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক যুবক। তার চোখেমুখে হতাশার ছাপ। শ্বাস নিতে পারছিলেন না। শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছিলো। উত্তপ্ত রৌদের তাপে বেশ ক্লান্তও দেখাচ্ছিলো। আশেপাশে বসার কোনো স্থান নাই। একটু পর দুর্বল শরীর নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এমন দৃশ্য দেখে স্বজনরা আহাজারি করছিলেন। ভাইকে বাঁচানোর জন্য আকুতি মিনতি করছিলেন এক লোক। বলছিলেন, আমার ভাইটারে একটু বাঁচাও। তারে একটু চিকিৎসা দাও। কিন্তু করোনা রোগী সন্দেহে স্বজন ছাড়া কেউ পাশে আসছেন না। বারবার চেষ্টা করেও তারা হাসপাতালের কারো সাহায্য পাচ্ছিলেন না। পরে কয়েকজন সংবাদকর্মীর সহযোগীতায় ওই রোগীর ঠাঁই হয় হাসপাতালের বেডে।
এই রোগীর বড় ভাই সোহেল মিয়া বলেন, আমার ভাই এলিফ্যান্ট রোডের একটি দোকানে চাকরি করে। কয়েকদিন ধরে তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো। তাই ভোরবেলা তাকে নিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালে এসেছি। এখানে আসার পর ট্রলি নাই, ডাক্তার নাই। ট্রলি আসলে ট্রলি ঠেলার লোক খোঁজে পাই না। জরুরি বিভাগে বারবার কথা বলেও তাকে ভর্তি করাতে পারছিলাম না। চোখের সামনে আমার ভাই কষ্ট পাচ্ছিলো। শ্বাস নিতে পারছিলো না। জরুরি ভিত্তিতে তার অক্সিজেন দরকার ছিলো। কিন্তু ব্যবস্থা করতে পারি নাই। ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে আমি চিৎকার করে কান্নাকাটি করছিলাম। এমন সময় কয়েকজন সাংবাদিক এসে জরুরি বিভাগে কথা বলে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। তারা এগিয়ে না আসলে হয়তো আমার ভাইকে আর ভর্তি করাতে পারতাম না।
সোমবার রাতে করোনার উপসর্গ নিয়ে ঢাকার তিন হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছেন বরিশালের রাহাত-আনোয়ার হাসপাতালের চেয়ারম্যান অর্থপেডিক সার্জন আনোয়ার হোসেন। সোমবার সকালে এই চিকিৎসকের শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আনা হয়। তারপর স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে গেলে সিট খালি না পেয়ে নেয়া হয় সিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে সিট না পেয়ে নেয়া হয় বাড্ডার এএমজেড হাসপাতালের আইসিইউতে। রাত তিনটার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ফজিলাতুন্নেসার বয়স প্রায় ৮০ বছর। শারীরিক নানা সমস্যায় কাবু। হার্টে রিং পড়ানো হয়েছে আগেই। করোনাকালীন সময়ে তিনি ব্রেন স্ট্রোক করলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সিলেটের মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে তাকে ভর্তি করতে পারেননি স্বজনরা। তার ছেলে শাহ সাইদুর রহমান বলেন, মায়ের জন্য আইসিইউ খুব প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু তারা করোনা পরীক্ষা না করিয়ে ভর্তি নেবেন না। এরপর মাকে নেয়া হয় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ভর্তি করা হয় সাধারণ মহিলা ওয়ার্ডে। এরপর করোনা পরীক্ষা হয় তার। এই পরীক্ষায় ফলাফল ‘নেগেটিভ’। তিনি অভিযোগ করে বলেন, করোনার ফলাফল নেগেটিভ আসার পরও তারা আইসিইউ দিতে রাজি হয়নি। তারা জানান, ফের করোনা পরীক্ষা করার জন্য। এরপর আবার মায়ের করোনা পরীক্ষা করতে দেই। সেই রিপোর্ট আসার আগেই মায়ের অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। আইসিইউ’র জন্য আবেদন করলে তারা রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত দেয়া হবে না বলে জানান। আমরা ল্যাব থেকে জানতে পারি মায়ের নেগেটিভ এসেছে। কিন্তু তারা কোনো পেপারস কিংবা ম্যাসেজ দেয়নি। একজন পরিচিত চিকিৎসকের মাধ্যমে হাসপাতালে অনুরোধ করাই। তিনি ল্যাব থেকে করোনা নেগেটিভ বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ৫দিন পর ৬ই জুন রাত ৩টার দিকে মাকে আইসিইউ’তে নেয়া হয়। পরদিন ৭ই জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি আরও বলেন, মাকে যদি আইসিইউ’তে আরো আগে নেয়া যেতো তবে হয়ত আরো কিছু দিন বেঁচে থাকতেন।
তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ইমরুল হাসান। এই বয়সেই মা হারা হয়েছে। ছোট্ট বেলা থেকেই বাবার আদর বঞ্চিত। বাবা কর্মের জন্য থাকেন কাতারে। প্রায় ২ বছর থেকে কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন তার মা আফসানা রেহেনা। আফসানার স্বামী মাহমুদ হাসান করোনার কারণে দেশে আসেন মার্চ মাসে। মে মাসের ২৮ তারিখ হঠাৎ অসুস্থতা বাড়ে আফসানার। তাদের বাড়ি গাইবান্ধা জেলার ঘোড়াঘাটে। সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে নেয়া হয় গাইবান্ধা সরকারি হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করোনা পরীক্ষা ছাড়া ভর্তি নিতে রাজি হননি। এরপর গাইবান্ধার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে নেয়া হলেও কেউ তাকে ভর্তি নেয়নি। ওই দিন রাতেই তাকে ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসতে আসতে আরও কাবু হয়ে পড়েন। ভর্তি করা হয় হাসপাতালের কিডনি বিভাগে। এর কিছুক্ষণের মধ্যই মারা যান তিনি। তখন চিকিৎসকরা বলেন, আগেই অক্রিজেনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন ছিলো। অক্সিজেনের অভাবেই মৃত্যু হয়েছে তার। করোনা পরীক্ষা করা হয় আফসানার। মৃত্যুর পর সেই পরীক্ষায় ফলাফল আসে নেগেটিভ।
রাজধানীর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইম্রিতা দেব নাথ। ৪ঠা জুন বড় ভাইয়ের সঙ্গে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। মারাত্মকভাবে পায়ে আঘাত পান। তাকে নেয়া হয় নিউরো সাইন্স হাসপাতালে। তার বড় ভাই সুব্রত দেব নাথ বলেন, রাত তখন প্রায় ১টা। এই সময় জরুরি বিভাগে বোনকে নিয়ে যাই। অঝোর ধারায় রক্ত ঝরছিলো। হাত দিয়ে চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করতে পারছিলাম না। কেউ এগিয়ে আসেনি। অনেক অনুরোধ করবার পর পায়ে দেবার জন্য তুলা ও ব্যান্ডেজ দেয়া হয় আমাকে। সেটি আমাকে লাগাতেই হয়েছে। চিকিৎসা না পেয়ে পরে সেখান থেকে নিয়ে যাই সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে। তখন রাত প্রায় ২টায় সেখান থেকে জানানো হয় রক্ত থেমে গেছে রোগীতে বাড়িতে নিয়ে যান। আমি তাদের চিকিৎসা দেবার জন্য অনুরোধ করি কিন্তু তারা প্রয়োজন নেই বলে জানান। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসছিলো সে। এরপর তারা ব্যাথানাশক ওষুধ কিনে আনতে বলেন। আরও কিছু ওষুধ লিখে দেন তারা। আর বলেন, সমস্যা নাই বাড়িতে নিয়ে যান। উপায়ন্তর না দেখে তাকে কলেজ রোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানেই তার পায়ে ব্যান্ডেজ করিয়ে দেয়। সেলাই দিতে হয় ৩টি। এক প্রশ্নের জবাবে সুব্রত দেব নাথ বলেন, আমার বোন গরমে ঘেমে ভিজে যায়। সেখান থেকে ঠাণ্ডা লেগে যায়। তাই সে বারবার হাঁচি ও কাশি দিচ্ছিল। আর বন্ধ রুমে যেতেই প্রায় প্রতি মিনিটে হাঁচি দিচ্ছিল এই কারণেই হয়ত চিকিৎসা মেলেনি তার।
এ বিষয়ে জাতীয় করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির উপদেষ্টা ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এবি এম আবদুল্লাহ বলেন, চিকিৎসকদের মধ্যে করোনার ভয় আগে ছিল, এখন অনেকটাই কম। করোনা ছাড়াও হার্টের, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিকস, কিডনিসহ কত রোগীইতো আছে। করোনার বাইরেও অনেক রোগী মারা যাচ্ছে। এখন গণপরিবহণ খুলে দেওয়া হয়েছে তাই রোগীরাও আসতে শুরু করেছে হাসপাতালে। তাই সরকারি বেসরকারি সকল হাসপাতালের উচিত সঠিক সেবা নিশ্চিত করা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) আমিনুল হাসান বলেন, এ এরকম কোনো অভিযোগই আমাদের জানা নাই। এরকমটা হওয়ার কথা না। সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিতে কোনো নির্দেশনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্দেশনা দেয়াই আছে, নতুন করে কি কোনো নির্দেশনা দিতে হবে?