ভোরের আলো ডেষ্ক: করোনার মধ্যে শুধু কুয়েত থেকেই দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বাংলাদেশি কর্মীকে। এই কর্মীদের বড় একটি অংশই কুয়েত গিয়েছিলেন অর্থ ও মানবপাচারে অভিযুক্ত এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের কোম্পানির মাধ্যমে। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে নেয়া হয়েছিলো ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কুয়েত গিয়ে চাকরি তো দূরে থাক, কোনরকম জীবন নিয়ে শূন্যহাতে ফিরেছেন তারা। কুয়েত সিআইডি এইসব ভুক্তভোগীদের জবানবন্দী নিয়ে মাঠে নেমেছে। রিমান্ডে নিয়েছে এমপি পাপুলকে। ভুক্তভোগীদের বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে, পাপুলের সাথে ফেঁসে যেতে পারেন স্থানীয় কয়েকজন দূতাবাস কর্মকর্তাও।
গেল ফেব্রয়ারিতে অবৈধ ভিসা ব্যবসার দায়ে পাপুলের বিরুদ্ধে কুয়েত সিআইডি রিপোর্ট করলে গা ঢাকা দিতে দেশে ফিরে আসেন তিনি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তখন খবর আসে ‘কুয়েত থেকে লাপাত্তা পাপুল।’ এবার তিনি করোনার মধ্যেই কুয়েত ফিরে নিজেকে জাহির করতে ৯ মার্চ ফেসবুক লাইভে আসেন এবং সেখানে দম্ভ নিয়ে বলেন, ‘আমি কাঁচের পাহাড় তৈরি করিনি, আমি পাথরের পাহাড় তৈরি করেছি… এটা ভাঙবে না, কেউ ভাঙতে পারবে না।’
তার সেই দম্ভ ভাঙতে শুরু করেছে। একজন অবৈধ আদম ব্যবসায়ী পাপুল এই টাকার পাহাড়ের জোরেই এমপি হয়েছেন। লক্ষ্মীপুরের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ ভোটারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, জন্মের পর পাপুলের বেড়ে ওঠা ঢাকা ও চট্টগ্রামে। ১৯৯২ সালে তার ভাই বিএনপি নেতা কাজী মঞ্জুরুল আলমের হাত ধরেই মরুভূমির দেশ কুয়েতে পাড়ি জমান তিনি। মরুর বুকে গড়ে তোলেন টাকার পাহাড়। কীভাবে একজন সাধারণ শ্রমিক থেকে বৈধ-অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে টাকার পাহাড় গড়েছেন সে প্রসঙ্গে না হয় পরেই লিখবো।
হঠাৎ করেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দেড়-দুই বছর আগে ২০১৬ সালে লক্ষ্মীপুরে আবির্ভূত হন কাজী পাপুল। স্থানীয় একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দেন এলাকায় জনসেবা করতে এসেছেন তিনি। নিজে মুখেই বলেন, ‘জন্মের পর প্রথম এসেছি। রায়পুরকে জেলায় রুপান্তরিত করতে চাই।’ এরপর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জামশেদ কবিরের হাত ধরে দান-খয়রাত শুরু করেন। পাতি নেতা ও স্থানীয় কিছু যুবকদের মোটরসাইকেল কিনে দিয়ে নিজের পেছনে ভেড়ান। কথায় কথায় টাকা পয়সা ঢেলে এলাকায় অল্প দিনে মানবতার সেবক বনে যান।
এবার সময় আসে কাঙ্খিত লক্ষে পৌঁছবার। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে জোটের রাজনীতিতে তার ওই আসনে (লক্ষীপুর-২) জাতীয় পার্টির লক্ষ্মীপুর জেলা সভাপতি মোহাম্মদ নোমানকে মনোনয়ন দেয়া হয়। আর পাপুল হন স্বতন্ত্র প্রার্থী। তখন থেকেই প্রতিপক্ষের সাথে বনিবনা করার চেষ্টা করে যান পাপুল। যেহেতু চাঁদ রাতে গরুর দাম কমে অথবা বাড়ে, সুতরাং সেই অপেক্ষায় থাকে অনেকে। সরগরম হতে থাকে নির্বাচনী মাঠ। এরপর নির্বাচনের ঠিক এক সপ্তাহ আগে হঠাৎ করেই লাপাত্তা হন প্রতিপক্ষ নোমান। কেউ বলছেন, পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে, কেউ বলছেন ১০ কোটি টাকার বিনিময়ে প্রতিপক্ষকে কিনে নেন টাকার পাহাড়ওয়ালা পাপুল। এমপি নির্বাচিত হন কুয়েত প্রজাতন্ত্রের প্রিন্স খ্যাত কাজী শাহিদ ইসলাম পাপুল। শুধু তাই না, পরবর্তী সময়ে স্ত্রী সেলিনা ইসলামকেও একইভাবে কুমিল্লায় সংরক্ষিত আসনের (৩৪৯) এমপি বানান। এলাকার দুই একজন আওয়ামী লীগ নেতা বিভিন্ন জন-সমাবেশে মাঝেমধ্যে তাকে ‘হাইব্রিড’ গালি দিয়ে জালাময়ী বক্তব্য দিলেও বেশিরভাগই চুপ। তাতে পাপুলও খুশি। আওয়ামী লীগের কোন পদ-পদবী লাগে না তার। বছরে দু-একবার হেলিকপ্টার যোগে এলাকায় আসেন। মরুভূমির সম্রাটের মতো এলাকায় নামেন, তারপর টাকা ছিটিয়ে চলে যান!
গেল ফেব্রুয়ারিতে কুয়েতের স্থানীয় পত্র-পত্রিকা ছাড়াও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সিআইডির বরাত দিয়ে যখন তার নামে অর্থ ও মানবপাচারের অভিযোগ তুলে নিউজ হয়, তখন তা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও জানানো হয়। এ নিয়ে তদন্তে নামে দুর্নীতি দমন কমিশনও। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আবার তা ধামা চাপা পড়ে যায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনকে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করলে ‘ফেক নিউজ’ বলে উড়িয়ে দেন তিনি। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দোষ দেবো না, উনাকে আমাদের কুয়েত দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত আবুল কালাম যা বুঝিয়েছেন- হয়ত তিনি তাই-ই বুঝেছেন। এমপি পাপুলের কুয়েতে অবৈধ ভিসা ব্যবসার পেছনে দূতাবাসের কয়েকজন কর্মকর্তার সংশ্লিষ্ট থাকার যে অভিযোগ ভুক্তভুগিরা তুলছেন, তা উড়িয়ে দেয়া যায় না। আশা করি, এবার পাপুলের শক্ত দুর্নীতির পাহাড় ভাঙবে। কারণ, সত্য পাথরের চেয়েও কঠিন। সত্যের কাছে ভেঙে যাক পাপুলের পাথরের পাহাড়, টাকার পাহাড়- এটাই প্রত্যাশা।