লিখেছেন মেহেদী হাসান
রবী ঠাকুর ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস লিখলেন ১৯১৬ তে। ৬৮ বছর পর অমরস্রষ্টা সত্যজিৎ রায় সেই উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমা বানালেন। ছবিটি বাংলা ইংরেজি দুই ভাষায় মুক্তি পেয়েছিল। তারপর আরো ৩৫টি বছর কেটে গেল। সত্যজিতের ‘ঘরে বাইরে’ করার পরে আরেক নির্মাতা অপর্ণা সেন একে আবার সেলুলয়েডের পর্দায় নিয়ে এলেন। গত বছরের শেষের দিকে মুক্তি পায় তার ছবিটি। এবার কাহিনীতে একটু পরিবর্তন করা হলো।
রবীন্দ্রনাথ যখন ‘ঘরে বাইরে’ লিখেন তখন এদেশে চলছিল সামন্ত প্রভুদের আধিপত্য, স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে জমিদার ও তাদের শাসনতন্ত্র, স্বদেশী বিপ্লবকে নব প্রজন্ম ইতিহাসের বইয়ের বিষয়-আশয় ছাড়া বেশি কিছু হয়তো ভাবতে পারত না। তাই অপর্ণা সেন কাহিনী ও চরিত্রগুলোতে সামান্য কাট-ছাঁট করলেন।
১০৩ বছর আগে যখন রবীন্দ্রনাথ ‘ঘরে বাইরে’ লিখছিলেন তখন আরেকটি আন্দোলনের আঁচ পাওয়া যায়। নারী জাগরণী আন্দোলন। বলে রাখা ভালো, রবী ঠাকুর নিজেও ছিলেন একজন নারীবাদী ও প্রগতিশীল। বিংশ শতকে এসে রবীন্দ্রনাথ যে লেখাগুলো লিখেছেন সেগুলো পড়লে বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
বিশ শতকের রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের নারীরা বাংলার পাশাপাশি হিন্দি বলতে পারে, নিয়মিত গানের রেওয়াজ করে, ইংরেজিতেও বাচচিত করতে পারে, ইংরেজ লাট-সাহেবদের প্রবর্তিত আইন এবং নিয়মের প্রতিবাদ করতে পারে, বাড়ির কর্তার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে। অর্থাৎ, নারীমুক্তি ও নারী জাগরণ রবীন্দ্রনাথের লেখায় খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আরেকটি কথা প্রচলিত আছে। বলা হয়ে থাকে, মানব মনের এমন কোনো অনুভূতি নেই যা রবীন্দ্র রচনায় উঠে আসেনি। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসটি তাই শুধু একটি রাজনৈতিক উপন্যাস হয়েই শেষ হয়ে যায়নি। এখানে অঙ্কিত হয়েছে ত্রিভুজ প্রেমের চিত্র, নারী মনের দ্বন্দ্ব, প্রগতিশীল এক জমিদারের মানসিক টানাপোড়ন, স্বার্থান্ধ একটি মহলের ষড়যন্ত্র।
স্বদেশীর নাম করে তখন একটি গোষ্ঠী সংখ্যালঘু মুসলমানদের একঘরে করে রাজনীতি করার যে পায়তারা করছিল রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার ঘোর বিরোধী। উপন্যাসের জমিদার চরিত্রে যে নিখিলেশ চৌধুরীকে দেখা যায় সে যেন জমিদার রবীন্দ্রনাথেরই প্রতিচ্ছবি। জমিদার তার স্ত্রী বিমলাকে নিজ বাড়ির আঙিনাতেই ইংরেজি শিক্ষা দেন, ইংরেজদের কায়দা-কানুন (যেগুলো ছিল সেই সময়ের আধুনিকতার পরিচায়ক) শেখান যাতে সে মুক্তচিন্তা ও মুক্তচর্চা করতে পারে।
হঠাৎ একদিন নিখিলেশ চৌধুরীর বাড়িতে হাজির হন তারই পুরোনো বন্ধু সন্দীপ মুখার্জী। দুই বন্ধু দুই আলাদা চেতনায় বিশ্বাসী। নিখিলেশ প্রগতিশীল, সন্দীপ প্রতিক্রিয়াশীল। সন্দীপের নিখিলেশের বাড়িতে আসার কারণও ছিল সে গ্রামে স্বদেশী আন্দোলনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা। সন্দীপ চরিত্রে কৃতঘ্নতারও চিহ্ন পাওয়া যায়। সন্দীপের বাড়িতে আসার পর স্বামী বাদে প্রথম কোনো পরপুরুষের সঙ্গ পায় বিমলা। সে সন্দীপের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে।
সন্দীপ সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিমলার কাছ থেকে ছয় হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় আন্দোলনের দোহাই দিয়ে। পরে গ্রামে দাঙ্গা বাধিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। আর সে দাঙ্গা থামাতে গিয়ে মৃত্যু হয় নিখিলেশের। বিমলার সন্দীপের প্রতি দুর্বলতার কথা জেনেও নিখিলেশ ছিল শান্ত। নিখিলেশ চরিত্রের গুরুগম্ভীর ও চিন্তাশীল দিক পাঠক ও দর্শকদের মোহিত করেছে। মূলত এটুকুই ‘ঘরে বাইরে’র কাহিনী সংক্ষেপ।
কাহিনীকে ঠিক রেখে আশির দশকে সত্যজিৎ রায় রঙিন পর্দায় নির্মাণ করেন ‘ঘরে বাইরে’। ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার (এনএফডিসি) ব্যানারে ছবিটি নির্মাণ করা হয়। এবার সত্যজিৎকে তাই বাজেট নিয়ে ভাবতে হয়নি। মননশীল ও নান্দনিক সিনেমা নির্মাণে সহায়তা ও প্রযোজনার উদ্দেশ্যে ১৯৭৫ এ এনএফডিসি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান। ভারতের যেকোনো ভাষায় নান্দনিক সিনেমা নির্মাণে এরা পূর্ণ সহযোগিতা দিয়ে থাকে।
সত্যজিৎ রায় পরবর্তীতে এনএফডিসির ব্যানারে ‘গণশত্রু’ ও ‘আগন্তুক’ দুটো সিনেমা নির্মাণ করেন। রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ সত্যজিতের ছোঁয়ায় আরো প্রাণময় হয়ে ওঠে। শোনা যায়, ছবিটির চিত্রনাট্য নাকি সত্যজিৎ রায় চল্লিশের দশকেই লিখে রেখেছিলেন। ‘পথের পাঁচালী’র ও আগে। কাস্টিংয়ের ক্ষেত্রেও সত্যজিতের মুন্সীয়ানা ভাবটি ফুটে ওঠে। সন্দীপের চরিত্রের জন্য নির্বাচন করা হয় সে যুগের ফেলুদা খ্যাত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, নিখিলেশের চরিত্রটি করে ভিক্টর ব্যানার্জি এবং বিমলার পাঠটি দেওয়া হয় মঞ্চ কাপানো এক তুখোড় অভিনেত্রী স্বাতীলেখা সেনগুপ্তাকে।
ছবিতে মাস্টারমশাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মনোজ মিত্র। আরো যারা ছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম না নিলেই নয়। জেনিফার কাপুর, ইন্দ্রপ্রমিত রায়, বিমল চট্টোপাধ্যায়সহ আরো অনেকে। প্রত্যেক অভিনয় শিল্পী এই ছবিতে তার সেরাটা দিয়েছিলেন। সৌমিত্রর নিজস্ব অভিব্যক্তি যেন গল্পের সন্দীপেরই অভিব্যক্তি। একজন শিক্ষিত, আধুনিক মননা, কিছুটা অসহায় জমিদারের চরিত্রে ভিক্টর ব্যানার্জি যে অভিনয় দেখিয়েছিলেন তা তার ক্যারিয়ারকে আরো সম্ভাবনাময় করেছিল। তার একটি ডায়লগ ছিল, “স্বদেশী জিনিসটা যাদের পয়সা আছে তাদের; এসব গরীবদের জন্যে নয়।”
এই একটি ডায়লগই সে যুগের পুরো পটকে সামনে তুলে ধরে। আর সত্যজিৎ রায় কথাটি বেরও করেছিলেন নিখিলেশের মুখ দিয়ে। সন্দীপের এক গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিল অমল। মেধাবী একজন ছাত্র, ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগান যার রন্ধ্রেও আগুন জ্বেলে দেয়। স্বদেশীর প্রবল নাগপাশ থেকে সে সময়কার শিক্ষিত, আধুনিক তরুণরাও রেহাই পায়নি। আর একটি চরিত্র ছিল মাস্টারমশাই এর চরিত্র। প্রজ্ঞা আর অভিজ্ঞতার ছাপ যার চোখে মুখে। যিনি নতুনদের সাবধান করে দিচ্ছেন আসন্ন বিপদ থেকে। মাস্টারমশাই চরিত্রটি করেছিলেন মনোজ মিত্র।
সত্যজিতের যখন এই ছবির কাজে হাত দেন তখন তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ও খ্যাতনামা চলচ্চিত্রকার। নিজের সিনেমার সংগীত পরিচালনা নিজেই করার ব্যাপারে সত্যজিতের আলাদা খ্যাতি ছিল। ‘ঘরে বাইরে’-র ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। স্বয়ং সত্যজিতই ছবিটির সংগীত সংযোজনার কাজটি করেন। সম্পাদনার দ্বায়িত্ব দেওয়া হয় দুলাল দত্তকে। আর ডিস্ট্রিবিউশন। তার জন্য তো এনএফডিসি ছিলই।
এবার আসা যাক অপর্ণা সেনের ‘ঘরে বাইরে’-তে। অর্পণা ছবিটির নাম একটু পাল্টে রাখেন ‘ঘরে বাইরে আজ’। কাহিনীতেও সামান্য পরিবর্তন আনা হয়। উদ্দেশ্য ছিল একে একুশ শতকের সাথে প্রাসঙ্গিক করা। অপর্ণা সে ক্ষেত্রে পুরোপুরি সফল হয়েছেন। কাকতালীয়ভাবে এখন সময়টিও কিছুটা স্বদেশী যুগের মতো। রবীন্দ্রনাথ যখন ‘ঘরে বাইরে’ লিখেন তখন দেশে স্বদেশীর নাম করে চলছিল নগ্ন রাজনীতির খেলা। আর এখন। ভারতে চলছে জাতীয়তার নামে সংখ্যালঘু নির্যাতন। উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা রাজনীতির কলকাঠি নেড়ে সংখ্যালঘুদের উপরে চালাচ্ছে নির্মম অত্যাচার। সে যুগের স্লোগান ছিল ‘বন্দে মাতরম’ আর এ যুগের স্লোগান ‘জয় শ্রী রাম’।
একদল তরুণ এই উগ্র গোঁড়ামিতে সাড়া দিয়ে মেতে উঠেছে অনাচারে। ‘ঘরে বাইরে’ তাই এ যুগেও বড্ড প্রাসঙ্গিক। অপর্না জমিদার নিখিলেশকে করেছেন সিনিয়র জার্নালিস্ট নিখিলেশ। এক জায়গায় কিন্তু দুই নিখিলেশই এক। দুজনেরই আছে একটা বড় শ্রোতাগোষ্ঠী। সমাজের প্রতিটি স্তরে বার্তা প্রেরণের ক্ষমতা। আবার দুই নিখিলেশই একই চেতনায় বিশ্বাসী। সন্দীপ চ্যাটার্জীকে এবার করা হয়েছে সন্দীপ ঝা। বিহারের এক ধনবান পরিবারের সন্তান।
আর বিমলাকে করা হয়েছে বৃন্দা। দলিত পরিবারের বিমলা নিখিলেশের বাড়িতে এসে হয়েছে শিক্ষিতা, স্বাবলম্বী বৃন্দা। ইংরেজি এক প্রকাশনার প্রুফ রিডিং করে সে। ‘ঘরে বাইরে আজ’ এর নতুন ছাঁচের কাহিনী একুশ শতকের সাথে পুরোপুরি মানিয়ে গেছে। অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও ছিলেন যথেষ্ট পটুয়া। নিখিলেশের চরিত্রটি অনির্বাণ ভট্টাচার্য একদম সফলভাবে করেছেন। চোখের চাহনি, গাম্ভীর্যপূর্ণ কণ্ঠস্বর, প্রতিটি সংলাপ, মুখভঙ্গি সবকিছু মিলেয়ে মানানসই। যীশু সেনগুপ্ত করেছেন সন্দীপ চরিত্রটি।
অপর্ণা এই চরিত্রে বলতে গেলে, সত্যজিৎ বা রবীন্দ্রনাথ থেকে সফল। এবারের সন্দীপের ভেতর দ্বৈতমুখীতা আছে। ভালো-মন্দ দুটোই দেখা যায় তার মধ্যে। আর বিমলা বা বৃন্দার কথা না বললেই নয়। তুহিনা দাস চরিত্রটি করেছেন। তার অভিনয় এক কথায় ছিল অনবদ্য। সমাজ আধুনিক হচ্ছে, নারীর জাগরণ হচ্ছে। তবুও নারীরা কোথায় যেন পুরুষতন্ত্রের কাছে পেরে উঠছে না। অপর্ণা সেন ‘ঘরে বাইরে আজ’-এ সেটা বৃন্দা চরিত্রে ভালোভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন।
এবারের মাস্টারমশাই করেছেন শক্তিমান অভিনেতা অঞ্জন দত্ত। অমল চরিত্রে দেখা গেছে তরুণ অভিনেতা ঋতব্রত মুখার্জীকে। তার ভেতরে চোখে পড়বে তারুণ্যের উদ্দামতা, অজানাকে জানার আকাঙ্ক্ষা। এই অমলই যেন দেশের গোঁড়া নেতৃবর্গের ডাকে সাড়া দেওয়া পথভ্রষ্ট তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করছে। সম্পাদনা, সিনেমাটোগ্রাফি সব মিলিয়ে ‘ঘরে বাইরে আজ’ একটি সফল চলচ্চিত্র। শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের ব্যনারে অপর্ণা সেন নিবেদিত ‘ঘরে বাইরে আজ’ একটি যুগোপযোগী, প্রাসঙ্গিক ও যুক্তিনিষ্ঠ চলচ্চিত্র সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।