লিখেছেন মাহমুদুল হাসান রুবেল
১৪ জুলাই ২০১০ :
– হ্যালো রাহুল, আজ তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসো । গুড নিউজ আছে । মিষ্টি নিয়ে এসো ।
– কেন তনিমা ? কি জন্য ?
– বলতে লজ্জ্বা লাগছে । আমি এসএমএস করতেছি । বাই । টেইক কেয়ার ।
রাহুল কাজে মন দিল । ব্যাংকার সে । সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত কাজ করতে হবে । তারপর বাসায় । মতিঝিল থেকে উত্তরায় যেতে তাকে পুরো দুই ঘন্টা বাসে বসে থাকতে হবে । ঢাকা দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে । তনিমার এসএমএস আসলো ।
“তুমি বাবা হতে যাচ্ছো…”
এসএমএস পড়ে চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে গেল রাহুল । প্রথমবারের মতো বাবা হচ্ছে সে । অন্যরকম আনন্দ হচ্ছে তার । পাশের মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি এনে অফিসের সবাইকে দিল । সবাই তাকে কনগ্রাটস করলো । অফিস থেকে চারটায় ছুটি নিল । তারপর তনিমার জন্য নতুন শাড়ি আর কার্ড কিনলো । আর মিষ্টি তো আছেই।
বাসায় গিয়ে তনিমাকে জড়িয়ে ধরলো রাহুল । দুজনই আনন্দে কাঁদছে । এই কান্নার পিছনে অনেক কাহিনী আছে । তনিমাকে রাহুলের পরিবার মেনে নেয়নি । তাই রাহুল একাকী বিয়ে করে । তারপর আলাদা বাসায় থাকে। তাদের বিশ্বাস একটা বাচ্চা হলে রাহুলের বাবা-মা তাদের মেনে নিবেন । অল্প আয়ের সংসার তাদের । কিন্তু সুখের অভাব নাই । নতুন অতিথির খবরে তাদের আনন্দের আর সীমা নেই ।
১৭ জুলাই ২০১০ :
রাহুল আজ অফিস থেকে আসার সময় তার সন্তানের জন্য লাল ফ্রক, জুতা, কসমেটিকস সব কিনে এনেছে । তনিমা রাহুলের পাগলামি দেখে হাসতে হাসতে শেষ ।
– আমাদের যে মেয়ে হবে তোমাকে কে বলছে ? ছেলেও তো হতে পারে ।
– আমার মন বলছে আমাদের মেয়ে হবে । মেয়ের নামও ঠিক করে ফেলেছি । তোমার নামের সাথে মিল রেখে । অনিমা । তনিমার মেয়ে অনিমা ।
– হাহা । ছেলে হলে তোমার নামের সাথে মিল করে রাখবো । রাহুলের ছেল রুহুল ।
আরে না । রুহুল রাখলে বেশি মিলে যায় । দূর থেকে তুমি রুহুল বলে ডাকলে দেখবে আমিও চলে এসেছি । রাহুলের ছেলে রাসেল রাখা যায় ।
– আচ্ছা বাবা, নাম রাখার অনেক সময় পাবে । কিছু খেয়ে নাও ।
– আরে খাওয়ারও তো অনেক সময় মিলবে । রোমান্টিক মুডে আছি । জানো আমি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি । কারণ সিগারেটের নিচে যে টাকা খরচ করতাম তা আজ থেকে আমার অনাগত সন্তানের জন্য জমা রাখবো । আমাদের অভাবের সংসারে সঞ্চয় করতে হবে । বাচ্চাদের কাছে তার বাবা সব সময় সুপারম্যান । টাকা পয়সা না থাকলে সুপারম্যান হতে পারবো না ।
– তুমি একটা পাগল । তোমার পাগলামি কোনদিন শেষ হবে না ।
২ আগষ্ট ২০১০ :
রাহুল মিষ্টি নিয়ে তার বাবার বাসায় গেল । ডোর বেল বাজালো । কিন্তু তাকে দেখে কেউ দরজা খুললো না । তারপর আপন এক ভাই এবং এক বোনও দরজা খুলে দিল না । বাধ্য হয়ে দরজার সামনে মিষ্টির প্যাকেট রেখে ছোট বোনটার মোবাইলে ম্যাসেজ দিলো, সে যে বাবা হতে যাচ্ছে ।
মন খারাপ নিয়ে বাসায় এসে তনিমাকে সব খুলে বললো । তনিমা তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিলো ।
– মন খারাপ করো না রাহুল । আল্লাহ আমাদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন । সব একদিন ঠিক হয়ে যাবে । আমারও তো খারাপ লাগে । আমার কতো আশা ছিল আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির যত্ন নিবো । সবাইকে রান্না করে খাওয়াবো । আমাদের কপালে নাই । দেখে নিও আমাদের যেদিন বাচ্চা হবে তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে ।
– না তনিমা কিছুই ঠিক হবে না । আমার সন্তান তার দাদা-দাদীর আদর পাবে না ।
– আমি কথা দিচ্ছি আমি আব্বার পায়ে আমার সন্তান রেখে পায়ে জড়িয়ে ধরে বলবো, আমাদের ক্ষমা করে দিতে ।
– তুমি কোন ভুল করোনি । আমরা পরস্পরকে ভালোবাসতাম । তাই বাবার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করোনি । তাই বাবা আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছেন । তারপরও যে তুমি আমাকে বিয়ে করেছো এটাই তো বেশি আমার জন্য । আমি অনেক ভাগ্যবান ।
– এভাবে বলে না ।
২২ সেপ্টেম্বর ২০১০ :
– তনিমা, আজ আমার বাসায় আসতে রাত ১১টা বাজবে । আমার এক কলিগের বিয়ে সন্ধ্যার পর মোহাম্মদপুরে । তোমাকে নিয়ে যেতাম । কিন্তু তোমার এখন রেস্টে থাকা দরকার । আমিও যেতাম না । না গেলে কলিগ কষ্ট পাবে ।
– আরে তুমি যাও । অবশ্যই যাবে । তাড়াতাড়ি চলে এসো । বুঝো তো বাসায় একা থাকতে ভয় লাগে ।
– ঠিক আছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসবো ।
মোহাম্মদপুরে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত ১০ টা বেজে যায় । বাসায় তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য একটা সিএনজি ভাড়া করলো । সিএনজি মহাখালি ফ্লাইওভারের উপর এসে নষ্ট হয়ে গেল । রাহুল সিএনজি থেকে নেমে তনিমাকে ফোন দিল । তখন রাত ১১টার উপরে বাজে ।
– তনিমা আমি মহাখালী চলে এসেছি । আধাঘন্টার ভেতর চলে আসবো । তুমি টেনশন করো না । শুয়ে পড়ো ।
৫-১০ মিনিট পর সিএনজি ঠিক হয় । রাহুল সিএনজির ভেতরে যখন ঢুকে তখন তার সাথে আরো দুজন উঠে । সে বুঝে যায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছে । চুপচাপ সিএনজিতে বসে সে । বসে তাদের বলে, আমার কাছে যা যা আছে নিয়ে যান । আমাকে দয়া করে মারবেন না । আমি আপনাদের কোন ক্ষতি করবো না ।
তারপর রাহুল তার মোবাইল মানিব্যাগ সব তাদের হাতে তুলে দেয় । এয়ারপোর্টের কিছু আগে ছিনতাইকারীরা তার চোখে মলম লাগিয়ে দিল । তারপর তাকে রাস্তায় ফেলে সিএনজি নিয়ে পালিয়ে যায় । রাহুলের উপর দিয়ে একটা মিনিবাস চলে যায় ।
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১০ :
তনিমা গতকাল সারারাত রাহুলের মোবাইলে ফোন দেয় । কিন্তু বন্ধ পায় । সারা রাত তার না ঘুমিয়ে কাটে । সকালে তনিমা তার বাবার বাসায় যায় । রাহুলের সব কলিগকে ফোন দেয় । কেউই তার সংবাদ দিতে পারেনি । ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ছুটে যায় তনিমা । মর্গতে গিয়ে খুঁজে পায় রাহুলের নিথর দেহ । তনিমা অজ্ঞান হয়ে পড়ে । রাহুলের বাবাকে ফোন দেয়া হলো । তিনি অবশেষে আসলেন । তবে সন্তানকে আর জীবিত পেলেন না ।
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১০ :
রাহুলের বাবা তনিমার কাছে আসেন । নিয়ে যেতে এসেছেন । তনিমা যেতে রাজী হলো না । রাহুলকে সে কথা দিয়েছিল সবাইকে নিয়ে সে যাবে । রাহুল যেখানে নেই সেখানে সে গিয়ে কি করবে ! রাহুলের বাবা কেঁদে বললেন, আমি অনেক বড় পাপ করেছি । আমার সন্তানকে কষ্ট দিয়েছি । তার এই মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী । বউমা, আমাকে শেষবারের মতো একটা সুযোগ দাও । রাহুলের অনাগত সন্তানের সব ভরণ-পোষণটা আমাকে করতে দাও । এতে আমার রাহুলের আত্মাটা শান্তি পাবে । আমাকে ক্ষমা করে দাও বউমা ।
২০ অক্টোবর ২০১০ :
তনিমার কাছে বেঁচে থাকা কোন মানে হয় না । তার মরে যেতে মন চায় । কিন্তু পারে না । রাহুলের ভালোবাসা তার সন্তানের জন্য বেঁচে থাকতে হবে তাকে । এ বেঁচে থাকার মধ্যে প্রাণের কোন অস্তিত্ত্ব নেই । বেঁচে থাকার জন্য কেবল বেঁচে থাকা । ছিনতাইকারীরা তাদের সন্তানদের খাবারের জন্য কিংবা তাদের কিছু সময়ের মাদকের জন্য এমন ক্ষতি করে যা কোনদিন পূরণীয় নয় । তারা কি বুঝতে পারে না তাদের লোভের জন্য কতো ক্ষতি হয় ? একটা তরুণীর জীবন নির্জিব হয়ে পড়ে । অনাগত একটা সন্তান কোনদিন কাউকে আর বাবা ডাকতে পারবে না । কোনদিন বাবার আদর কি বুঝবে না । রাহুলের মানিব্যাগে আর কতো টাকাই বা পেল তারা ? হয়তো বা ৫০০০ টাকা । হয়তোবা আরো কম । সে তো বেঁচে থাকতে চেয়েছিল সবকিছু দিয়েও । তবে কেন তাকে মরতে হলো ? তনিমা এবং তনিমার অনাগত সন্তানের এ ক্ষতির দায় নিবে কে ?