লিখেছেন আহমেদ দীন রুমী
ভগবান একবার সকল জাতির প্রতিনিধিকে ডাকলেন। উদ্দেশ্য বরাদ্দকৃত বর্ণমালা তুলে দেওয়া। সংস্কৃতির অন্যতম মৌল উপাদান বর্ণ। নির্দিষ্ট দিনে তাই সব প্রতিনিধি সেখানে হাজির। শুধু ছিলো না ম্রো জাতিগোষ্ঠীর কেউ। উপায় না থাকায় ভগবান ম্রো-দের জন্য বর্ণমালা পাঠালেন কলা পাতায় লিখে। বাহক নিযুক্ত হলো এক গরু। দীর্ঘ পথের ক্লান্তি, মরুভূমির কড়া রোদ আর সেই সাথে শরীরের ক্ষুধা। শীঘ্রই আধমরা হয়ে পড়লো গরুটা। জীবন বাঁচানোর জন্য খেয়ে ফেললো কলাপাতাটি। আর খালি হাতে গিয়ে পৌছালো গন্তব্যে। তাকে দেখেই আগ্রহী হয়ে উঠে ম্রো-রা। জানতে চায় ভগবান বর্ণমালা পাঠিয়েছেন কি না। সোজা না করে দিলো পত্রবাহক।
নিদারুণ এই বৈষম্য মেনে নিতে পারলো না ম্রো জাতি। সকলে মিলে গেলো ভগবানের কাছে। অভিযোগ শুনে অবাক ভগমান। বাহক গরুকে ডাকা হলে সে স্বীকার করলো অপরাধ। বর্ণনা করলো ঘটনাও। এতো বড় ভুলের জন্য কষে চড় মারলেন ভগবান। অভিশাপ দিলেন ম্রোরা তাকে খুচিয়ে হত্যা করবে। চড় খেয়ে উপরের চোয়ালের দাঁত খসে গেলো বেচারার। সেদিন থেকে গরুর উপরের চোয়ালে দাঁত থাকে না। লিম্পু নামের খাচায় বেঁধে তাকে হত্যা করা হয় বছরে একবার। সেই থেকে ম্রোরা বর্ণহীন। অবশ্য পেয়েছে আরো অনেক অনেক দিন পর। দিয়েছেন একজন মহাপুরুষ মেনলে ম্রো এবং একটি ধর্ম- ক্রামা।
হঠাৎ মেনলে ম্রো
বান্দরবান শহরের অদূরে চিম্বুক পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত পোড়া পাড়া। অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ম্রোদের বসবাস এখানে বেশিই বলা যায়। মেনসিং ম্রো এবং তুমতে ম্রোর ছোট্ট সংসার। ১৯৬৫ সালের মে মাসের পূর্ণিমায় ঘর আলোকিত করে জন্ম নিলো প্রথম সন্তান। গরীব জুমচাষী পিতা হয়তো তাকে দেখেছিলেন সাদাসিধে চোখে। মা দেখেছিলেন সফল গৃহীর প্রতিমূর্তি। কিন্তু ছেলেটি তা-ই হলো; যা তারা কল্পনা করতে পারেননি। মেধা, চিন্তা, উদারতা এবং অধ্যবসায় দিয়ে সে গোটা ম্রো জাতিকে পরিচয় করিয়ে দিলেন নতুন পৃথিবীর সাথে। পিতা নাম রেখেছিলেন মেনলে। কিন্তু মানুষ তাকে চিনলো ক্রামাদি নামে। ক্রামা নামের সাথে ক্রামাদি ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। ক্রামা শব্দের অর্থ অসীম জ্ঞানের অধিকারী। বহুবার তা প্রমাণও করেছেন তিনি।
সেই সময় অধিকাংশ গ্রামে পাঠদান চলতো মারমা বর্ণমালায়। ম্রো সমাজের অজ্ঞতা আর কুসংস্কার সেখান থেকেই দাগ ফেলে মনে। ১৯৮০ সালে বান্দরবানের সুয়ালকের ম্রো আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। পড়াশোনা আর প্রাত্যহিক কাজের সাথে এখান থেকে শুরু হয় ধ্যান। প্রতি রাতে স্কুলের কাছে অশ্বথ গাছের নিচে ধ্যানমগ্ন কিশোর মেনলে। ভগবানের কাছে খুঁজতে থাকলেন মুক্তির চাবি। দীর্ঘদিন তাকে অপেক্ষা করতে হয়নি। ঠিক পেয়ে গেলেন নতুন ধর্ম ও বর্ণমালা। অবশ্য গোপন রাখা হলো কথাটা।
১৯৮২ সালের দিকে স্কুলে তার বর্ণমালার কথা জানাজানি হয়ে যায়। বিস্ময় প্রকাশ করে শিক্ষকেরা। মেনলে আর বেশিদিন স্কুলে থাকেননি তারপর। ফিরে আসলেন গ্রামে। কিন্তু যে স্বাধ তিনি পেয়েছেন; তা ত্যাগ করেননি। চলতে থাকলো ধ্যান এবং বর্ণমালার প্রচারণা। মানুষ প্রথমে তাকে পাগল ভাবতে শুরু করছিল। কেবল গ্রহণ করেছিল প্রবীণ পুরুষ লাংপুং। অবিশ্বাসী লাংপুং-এর বিশ্বাসী হয়ে উঠার ব্যাপারটা অলৌকিক। বাঁশ কাটতে গিয়েছে বনে। হঠাৎ সাদা পোশাক পরিহিত উড়ন্ত এক লোক কথা বলে উঠলো-
“হে লাংপুং, জগতের জন্য ধারালো এক দা জন্মগ্রহণ করেছে। তার পরিচর্যা করো। উপযুক্ত কাজের জন্য আরো ধারালো করো হাতল লাগিয়ে। গ্রীষ্মকালের আগুন যেমন থামানো যায় না; ক্রামাধর্ম আর তার বর্ণমালাকেও থামানো সম্ভব না। তবে তোমরা বিশ্বাস না করলে ভোতা দা-এর মতো এই বর্ণমালা এবং ধর্মও হারিয়ে যাবে।”
যেহেতু লাংপুং মোটামুটি গণ্যমান্যদের কাতারের লোক; তাই তার কথা সবাই উড়িয়ে দিতে পারলো না। দীক্ষা নিলো তংক্লাং এবং মেনঙি। এভাবে ম্রো বর্ণমালা শেখার ব্যবস্থা করা হলো গ্রামে। সাংমি বা শিক্ষক নিযুক্তি হলো বিনা পারিশ্রমিকে। প্রতিষ্ঠিত কমিটিতে স্থান পেলো সাংমি নেতখাই, চিকিৎসক মেনঙি, আহ্বাহক খেংক্লাং এবং প্রধান উপদেষ্টা সাংইয়ং। ক্রামাদি তিনজন পরামর্শদাতা নিয়ে প্রচারে ব্রতী হলেন।
তাতেও দীর্ঘ হলো না সময়। এক মহাসম্মেলনের আহবান করলেন এপ্রিল মাসের রবিবার। সকলের বর্ণমালা এবং ভাষা প্রসঙ্গে আলোচনা রাখার জন্য। একে বৌদ্ধধর্মের মহাসম্মেলন এবং খ্রিষ্টধর্মের কাউন্সিলের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এই দিন থেকেই ক্রামাধর্ম আনুষ্ঠানিকভাবে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। শুধু ম্রো না; খুমি ও অন্যান্যদের মাঝেও। কেবল বাংলাদেশে না; মায়ানমারেও। ধর্ম আর বর্ণমালা প্রচারের জন্য বহু স্থানে ভ্রমণ করেছেন ক্রামাদি মেনলে। তবে তা খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য। ১৯৮৪ সালের জুলাই মাসে আরো কঠোর ধ্যানের নিমিত্তে নিরুদ্দেশ জীবন বেছে নেন তিনি। ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে, একদিন পৃথিবীতে নতুন ধর্ম নিয়ে উনেকশানীত মাংলন নামে আবির্ভূত হবেন তিনি।
ধর্মীয় কাঠামো এবং পবিত্র ঘর
সামাজিক ক্রিয়া-কর্তব্য অনুসারে ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণের দেখা মেলে ক্রামা নির্দেশনায়। প্রতিটি গ্রামের নিয়ন্ত্রণ কাঠামোতে ছয়জন গুরু বা অরি-তরাউপ থাকে; যাদের উপর পৃথক কিছু দায়িত্ব অর্পিত। চখাং উপ-এর উপর ভেষজ চিকিৎসা, তরা উপ-এর উপর বিচার-সালিস এবং অরিপ উপ-এর উপর প্রয়োজনীয় উপদেশ প্রদানের দায়িত্ব। গ্রামের শিশুদের শিক্ষার জন্য সাংমি উপ, ধর্মবিষয়ক ব্যাখ্যা ও প্রচারের জন্য প্রসার উপ এবং গ্রামবাসীর জন্য আইন তৈরির দায়িত্ব অরি উপ-এর উপর। উল্লেখিত ছয়জন প্রভূত সম্মানীয় বলে পরিগণিত।
ক্রামাধর্মে পবিত্রতম স্থান কিইয়ং বা বিহার; যা তিন অংশে বিভক্ত। সোলুক কিম হলো বিহারের প্রার্থনা করার মূল স্থান। সবচেয়ে পবিত্র এই অংশে প্রবেশের আগে পা ধুয়ে নিতে হয়। সোলুক কিম আবার দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ অরি-তরাউপদের এবং অন্যভাগ পুণ্যার্থীদের। তবে পুন্যার্থীদের বসার জন্য কিছু নিয়ম আছে- নারী-পুরুষ আলাদা, বিবাহিতরা সামনে এবং অবিবাহিতরা পেছনে ইত্যাদি। অভ্যাগতদের বিশ্রামের স্থান নাংখর কিম। সবিশেষ রিয়াখেপ কিম হলো অরি-তরাউপদের অবস্থানের জায়গা। অবশ্য উপাসনায় আসা ব্যক্তিরাও বিশ্রাম নিতে পারে। পুণ্যার্থীদের ডাকা হয় পনেরো বার ঘন্টা বাজানোর মাধ্যমে। ভেতরের উপসনা রীতিতেও রয়েছে নিজস্ব বিশেষত্ব।
ফুং বা আচার-আচরণ
ক্রামাধর্মে ফুং বা চারিত্রিক আচার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সাফল্যের দরজায় দাঁড়িয়েও কেবল ফুং এর দোষে ব্যর্থ হতে পারে মানুষ। অবশ্য সংসারধর্ম পালনকারী এবং সংসারত্যাগীর জন্য ফুং আলাদা। সংসারধর্ম পালনের জন্য আটটি ফুং প্রণিধান যোগ্য। যেখানে মদ পান এবং অন্যান্য নেশাদ্রব্য থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। নিষেধ করা হয়েছে চুরি-ডাকাতি, মিথ্যা বলা, জুয়াখেলা, প্রাণিহত্যা, লোভ-হিংসা, ব্যভিচার এবং মানুষের প্রতি কুদৃষ্টি দেয়াকে। বাইবেলের টেন কমাণ্ডমেন্ট কিংবা বুদ্ধের অষ্টমার্গের কথা স্মরণযোগ্য। সংসারত্যাগী কিংবা সন্ন্যাসীদের জন্য বাড়তি আরো দুই ফুং পালন করতে হয়। মানবিক সকল সম্পর্কের বাইরে থাকা এবং ভগবানকে একমাত্র আত্মীয় বলে গণ্য করা আর সেই সাথে জঙ্গলে গিয়ে তপস্যা করা।
এছাড়াও সবার জন্য রয়েছে বিশেষ নিয়ম। ভাত খাওয়ার জন্য বলতে হয়, ‘চাকসাই প্রাসি ইয়ুংরি চক্রা প্রুক ঙরে রওয়াইক’। কারো সাথে দেখা হলে বলতে হয়, ‘সাইন সা চক্রা এন চেন চো’ এবং জবাবে বলতে হয়, ‘সাইন চেন চু চুক্রা’। বিদায়ের বেলায় উভয়কেই বলতে হয়, ‘সাইন সা’।
উৎসব-পার্বণ
প্রতিটি ধর্মের মতো ক্রামাধর্মেও রয়েছে উৎসব পার্বণ। প্রধান চারটি উৎসব যথাক্রমে প্রাত লা পই, সরাই লা পই, রামমো লা পই এবং লুত লা পই। প্রতিটি উৎসব তিনদিন করে এবং প্রতিদিন তিনবার করে বিহারে যাবার নিয়ম। প্রাত লা পই হলো ক্রামাদির ধর্ম ও বর্ণমালা প্রকাশের দিনকে স্মরণের উৎসব। এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত হলেও দিন নির্ধারিত হয় চাঁদ দেখে। নতুন বছরের শুরু হিসাবে মে মাসে পালিত হয় সরাই লা পই। ক্রামাধর্ম প্রচারক মেনলে জুলাই মাসে গৃহত্যাগ করে অদৃশ্য হয়েছিলেন। তাকে স্মরণ করে তাই পালিত হয় রামমো লা পই। সর্বশেষ ধর্মীয় উৎসব লুত লা পই পালিত হয় অক্টোবর মাসে।
বাংলায় যেমন নবান্ন উৎসব হয়, ম্রো সমাজে তেমন পালিত হয় চমুং পক পই। জুমের ধানে ভাত রান্না এবং শূকর কিংবা মুরগী জবাই হয়। খাওয়ানো হয় গ্রামের বয়স্কদের। নবজাতকের নাম রাখা অনুষ্ঠানকে বলা হয় মিংরুক পই। কান ছিদ্র করার সংস্কৃতিও পরাম রুই নামে উৎসব হিসাবে পালিত হয়। তাছাড়া সন্তানের বয়স বারো বছর হলে তাকে বিহারে নিয়ে গিয়ে ভগবানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়; এই উৎসব তাংফুং নামে পরিচিত।
সবিশেষ
ক্রামাধর্মের ধর্মগ্রন্থের নাম রিইয়ুং খতি। ধর্মীয় রীতিনীতি এবং জীবন নির্দেশিকা তাতে লিপিবদ্ধ। ক্রামাদি মানুষের শরীরকে একটা ঘরের সাথে তুলনা করেন; আত্মাকে মালিক। ঘরকে নিয়মিত দেখাশুনা করলেই কেবল তা পরিচ্ছন্ন থাকবে। শরীর ও আত্মার জন্যেও তাই-ই। যখন সমাজে চুরি ডাকাতি ও খারাপ কাজ বেড়ে যায়; তখন ভগবান শাস্তি দেন। ফলে বিভিন্ন বিপদাপদ আসে। খারাপ কাজে শাস্তি না দিলে তো অপরাধ বেড়ে যাবে। স্বর্গ বেশি দূরে না; বরং খুব কাছে। মন সৎ আর পবিত্র হলে এবং আচরণ ভালো হলে স্বর্গ দূরে না মোটেও। তার মতে, “কারো কষ্টের ফসল কেড়ে নিও না। পাপের বোঝা বাড়বে তাতে। যে অপরের ব্যথা বুঝে না; সে পাগলের অধিক ক্ষেপা।” মানুষকে ভয় করার কিছু নেই। যদি একান্তই ভয় করতে হয়; তবে ভগবানকে করা উত্তম। কারণ তিনিই রক্ষাকর্তা এবং একক সত্তা।
কেবল যোগ্যরাই টিকে থাকতে পারে প্রকৃতিতে। সেই যোগ্যতা প্রমাণের প্রতিযোগিতায় একার চেয়ে দলবদ্ধ থাকাটা সুবিধাজনক। মানুষের সামাজিক হয়ে উঠা তাই একরকম বাধ্যতামূলক। কিন্তু ব্যক্তিকে একক স্বার্থের বাইরে দাঁড়িয়ে সমাজের সম্মিলিত স্বার্থের জন্য ভাবতে হলে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। আদিম সমাজে মানুষকে সেই দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছে ধর্ম। বস্তুত কোন সমাজের ধর্ম হলো সেই সমাজের সামষ্টিক প্রজ্ঞা। বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেছে এক পরম ঈশ্বরের সাথে তার যোগাযোগের কথা। জেরুজালেম থেকে চীন অব্দি। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক কালে জন্ম নেয়া ধর্মের পেছনেও সামাজিক কারণ আছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এক ব্যক্তির মাধ্যমে বর্ণমালা এবং ধর্মের আগমনের নজির বিরল। আর এর মধ্য দিয়ে কেবল একটা মানুষ আলোকিত হয় নি; উপকৃত হয়েছে ম্রো নামের একটা জাতিগোষ্ঠী। ধর্মটি মূলধারার গবেষকদের মনোযোগ আকর্ষণের দাবি রাখে।