রেমডেসিভির একটি প্রোনিউক্লিওটাইড যা শিরাপথে শরীরে দিতে হয়। এর প্রস্ততকারক আমেরিকার জিলিড নামে একটি ঔষধ কোম্পানি। এটা থমাস চিলার নামে একজন চেক বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানীর নেতৃত্বে গবেষণার ফসল। এই বিজ্ঞানী মূলত এইডসের ঔষধ আবিষ্কারের জন্য গবেষণা করছেন। ইবোলা ও মারবুর্গ ডিজিজের জন্য এই ঔষধটি প্রথমে তৈরি করা হয়েছিল। শুরুতে এটাও বলা হয়েছিল যে ঔষধটা ভালো কাজ করে এবং ২০১৬ থেকে ২০১৮ তে কঙ্গোতে ভালভাবে গবেষণার পরে কঙ্গোর স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ঔষধটি প্রত্যাখ্যান করেন এই যুক্তিতে যে এর চাইতে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি দিয়ে ইবোলার চিকিৎসায় অনেক বেশি ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে।
রেমডেসিভির কীভাবে কাজ করে?
এটা শরীরে প্রবেশ করে অ্যাক্টিভেটেড হয় এবং ভাইরাসের আরএনএ পলিমারেজ এনজাইমের কার্যকারিতা কমিয়ে দিয়ে আরএনএ ভাইরাসের বংশবিস্তারে বাধা দেয়। একে এজন্য চেইন টার্মিনেটর বলে। তাতে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধির গতি ধীর হয়ে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়।
জিলিড এর প্রধান আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাত করে তাকে ১৫ লাখ ডোজ ঔষধ দেবার কথা বলেছেন বিনামূল্য। তাতে দেড় লাখ লোক আপাতত চিকিৎসা পাবে।
এর আগে ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চে চীনে এই ঔষধ নিয়ে ট্রায়াল হয়েছে। যদিও সেখানে মাত্র ২৩৭ জনের ওপরে পরীক্ষা করা হয়। ১৫৮ জন ঔষধটি পায় ও ৭৯ জন প্লাসেবো। তাতে তেমন কোন সুফল পাওয়ার কথা গবেষকরা উল্লেখ করেন নাই।
১৫ দিনের মাথায় মোট মৃত্যুর পরিমাণ ছিল ১০%। তখন প্লাসেবো গ্রুপে মৃত্যু ছিল ৯%। ২৮ দিনের মাথায় মোট মৃত্যুর পরিমাণ ছিলো ২২ জন মানে ১৫%। বরং যাদের এই ঔষধ দেয়া হয় নাই তাদের মধ্যে অর্থাৎ প্লাসেবো গ্রুপে মৃত্যুর পরিমাণ ছিল ১৩%।
তার মানে ক্লিনিকালি ক্রিটিকাল পেশেন্টের মৃত্যুর উপরে তার তেমন কোন ভূমিকা নাই। বরং যারা ঔষধটা পায় নাই তারা কম মরেছে।
১০২ জন রোগী নানা ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার অভিযোগ করেন। ১২% রোগী অর্থাৎ ১৮ জনের মধ্যে এই ঔষধ বন্ধ করে দিতে হয়।
তারা বলেছেন যে এই ঔষধ সুস্থ হওয়াকে তরান্বিত করে এমন প্রমাণ পেতে হলে আরও গবেষণা দরকার। এই ঔষধে ক্লিনিকাল বেনেফিট পাওয়ার কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ নাই।
জিলিড পরে মোট ১০৬৩ জন রোগীর উপরে আরেকটি ট্রায়াল চালায় ও বলে যে ১৫ দিনকে সুস্থ হবার লক্ষ্যমাত্রা ধরে নিয়ে চালানো এই গবেষণায় মোট ১১ দিনের মধ্যে রোগীরা সুস্থ হয়ে গেছেন।
কাদের এই ঔষধ দেয়া হয়েছিল।
১. যাদের সঠিকভাবে এই গবেষণা সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়েছে।
২. যাদের অক্সিজেন লেভেল ৯৪% বা তার কম
৩. যাদের ফুসফুসের এক্সরেতে পরিবর্তন দেখা গেছে
৪. যাদের অক্সিজেন দিতে হচ্ছে
৫. যারা ভেন্টিলেশনে আছেন
যাদের সিমটম মৃদু তাদের এই গবেষণায় নেয়া হয় নাই। গর্ভবতী মা ও দুগ্ধবতী মায়েদের এই গবেষণায় রাখা হয় নাই।
ডোজ ছিল প্রথমে ২০০ মিলিগ্রাম শিরাপথে ও পরে প্রতিদিন ১০০ মিলিগ্রাম শিরাপথে।
এটা দেবার পরে অধিকাংশ রোগী ১১ দিনে সুস্থ হয়েছেন বলে তারা দাবি করেছেন। তারা বলেছেন যারা ঔষধ পেয়েছে তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার ৮% ও যারা পায় নাই তাদের মধ্যে মৃত্যু ১১.৬%।
তার মানে ১০০০ লোকে মৃত্যু হবে রেমডেসিভির দিলে ৮০ জনের না দিলে ১১৬ জনের। তবে তারা টেস্টটি করেছেন ১৫ দিন স্ট্যান্ডার্ড ধরে। ২৮ দিনে গেলে বিষয়টা কী হয় সেটা তারা বলেন নাই।
ঔষধটা আরও ট্রায়াল হবে। তবে কমপ্যাশনেট ব্যবহারের জন্য মানে ধারণাপ্রসূত আন্দাজের উপরে ব্যবহারের জন্য ইউএসএ, জাপান, কানাডা এটাকে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে বলেছে। চিলারের দেশ যেহেতু চেক প্রজাতন্ত্র সেখানে এটা ব্যবহার করা হয়েছে।
এটার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে আছে বমিবমি ভাব, লিভারে প্রদাহ, ব্লাড প্রেসার কমে যাওয়া, প্রচুর ঘাম হওয়া, কাঁপুনি। এর মারাত্মক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে আছে অর্গান ফেইলিওর ও রেসপিরেটরি ফেইলিওর। এছাড়া এটা শিরাপথে দেবার সময় ইনফিউশন রিঅ্যাকশনও হয়। কারো কারো রক্তে প্লেটেলেট কমে যায়, অ্যালবুমিন ও পটাশিয়াম কমে যায়।
রেসপিরেটরি ও অর্গান ফেইলিওর একটি ভয়াবহ বিষয় কারণ করোনা নিজেই এই দুটি কাজ করে। তাই বিষয়টা নিয়ে আরও বুঝা দরকার আছে। অর্থাৎ ঔষধটির প্রকৃত কার্যকারিতা প্রমাণিত নয়। এটার ভালোমন্দও প্রমাণিত নয়। এটা ইবোলাতে কাজ করে না। ল্যাবর্যাটের ওপরে ও রেসাস বানরের ম্যাকাকি প্রজাতির উপরে সার্স ও মার্স ভাইরাস ইনফেকশনে এটা কাজ করে বলে মনে হলেও আদতে মানব রোগীদের বেলায় এটা কাজ করে কি না সেটা বুঝা যায় নাই।
তবে বিড়ালের বা ফেলাইন রেসপিরেটরি করোনাভাইরাসে মানে বিড়ালের হাঁচি কাশিতে এটা কাজ করে বলে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
একটা ট্রায়াল ড্রাগ বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে বলে দাবি করা এবং এর অতি উচ্চমূল্য নির্ধারণ করা মোটেও দেশপ্রেমের কাজ নয়। সারা দুনিয়াতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট দশলাখ লোকের জন্য এই ঔষধ দেয়া যাবে বলে জি লিড ট্রাম্প সাহেবকে জানিয়েছেন।
আমাদের কোন ঔষধ কোম্পানি যদি এটা উৎপাদন করেও, তাদের উচিত এটা বিনামূল্যে সরকারকে প্রদান করা। কারণ এটা একটা অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ। এটা ব্যবহার করলে যে ডেটা পাওয়া যাবে তার মূল্য বহু হাজার ডলার।
শুধু তাই না যে ঔষধের ট্রায়াল এখনো চলছে আমেরিকা ও ইউরোপে সেটা এখানে বিক্রির কথা বা দাম নিয়ে কথা হবে কেন?
এটা যাদের উপরে ব্যবহার করা হবে তাদের ইনফর্মড কনসেন্ট নিয়ে যথাযথ কম্পেনসেশন ঠিক রেখে তারপরই বিনামূল্যে সেটা ব্যবহার করা উচিত।
ট্রায়াল ড্রাগকে করোনার ঔষধ বলে পত্রিকার শিরোনাম করাটাও সঠিক নয়।
আব্দুন নূর তুষার: চিকিৎসক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।
[লেখাটি ফেসবুক থেকে নেওয়া]