ভোরের আলো ডেস্ক:
বাংলাদেশে প্রায় দু’মাস ঘরে নিখোঁজ ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে নিয়ে যাওয়ার ছবি প্রকাশ হবার পর বিভিন্ন মহল থেকে নিন্দার ঝড় উঠেছে।
সংবাদকর্মীসহ অনেকেই এই ঘটনার সমালোচনা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের অনেক ব্যবহারকারী ওই ছবিটিকে নিজেদের প্রোফাইল পিকচার হিসেবেও ব্যবহার করেন।
অনেক ব্যবহারকারী আবার মি. ইসলামকে হাতকড়া পড়ানোর বিষয়টির আইনগত ভিত্তি কতটা রয়েছে এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
নিখোঁজ হওয়ার ৫৩ দিন নিখোঁজ থাকার পর ৩রা মে ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের খোঁজ মেলে।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, যারা তাকে হাতকড়া পরিয়েছে তারা অবশ্যই জানতেন যে তিনি সংবাদকর্মী। কোন দাগী আসামী নন।
‘এভাবে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়াটা আসলে হয়রানি করা, হেনস্তা করা,’ তিনি বলেন।
‘একজন সাংবাদিককে পিছমোড়া করে বেধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এটার অনেক ব্যাখ্যা হতে পারে। তবে আমরা চাই না যে কোন দিনই কোন সংবাদকর্মীকে এভাবে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক,’ ফরিদা ইয়াসমিন বলেন।
নিখোঁজ হওয়ার ৫৩ দিন নিখোঁজ থাকার পর ৩রা মে ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের খোঁজ মেলে।
পুলিশ কী বলছে?
গত শনিবার গভীর রাতে বেনাপোল-রঘুনাথপুর সীমান্ত থেকে আটক করে টহলরত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবির সদস্যরা। পরের দিন তাকে হাতে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়।
মি. ইসলামকে আদালতে হাজির করেন বেনাপোল পোর্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুন খান। তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, হাতকড়া সবাইকে পড়ানো হয়। অন্য আসামীদের যেভাবে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাকেও সেভাবেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
‘আসামীকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিতে হলে তাকে অবশ্যই হাতকড়া পড়াতে হবে, এটা নিয়ম। আমরা সেই নিয়মটাই পালন করেছি,’ তিনি বলেন।
তবে তাকে যে ধারায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে সে ধারা অনুযায়ী হাতকড়া পরানোটা জরুরী কিনা এমন প্রশ্নে মি. খান বলেন, তার বিরুদ্ধে আরো তিনটি মামলা রয়েছে।
‘চারটা মামলার আসামী হিসেবে তাকে হাতকড়া পরিয়ে আদালত পাঠানো হয়েছে।’
ফেসবুক পোস্টের পর মামলা
পক্ষকাল নামে একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজল একই সাথে দৈনিক খবরের কাগজ বনিক বার্তার আলোকচিত্রি।
মার্চ মাসের ১০ দশ তারিখ রাজধানীর হাতিরপুল এলাকায় সন্ধের দিকে পক্ষকালের কার্যালয় থেকে বের হন। এরপর থেকে তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এর আগে মি. ইসলামের ব্যক্তিগত ফেসবুক পাতায় একটি খবর প্রকাশের জের ধরে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্য।
এই মামলার একদিন পর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন শফিকুল ইসলাম। নিখোঁজ হওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে একই আইনে আরো একটি মামলা করেন আওয়ামী লীগের আর এক নেতা।
তখনও সামাজিক নেটওয়ার্কে তার নিখোঁজ হওয়া এবং এসব মামলাকে ঘিরে বেশ আলোচনা তৈরি হয়েছিল।
আইন কী বলছে?
মি. ইসলামকে হাতকড়া পড়ানোর বিষয়টি আইনগতভাবে কতটা যৌক্তিক এমন প্রশ্নে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেটির বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, হাতকড়া পড়ানোর বিষয়টি অপ্রয়োজনীয়।
এ বিষয়ে আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, হাতকড়া পরানোর বিষয়টি রয়েছে পুলিশ রেগ্যুলেশন অব বেঙ্গল ১৯৪৩-তে। এই আইনে পুলিশ আসামীকে দরি বেধে নিয়ে যাবে নাকি হাতকড়া পড়িয়ে নিয়ে যাবে সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই।
‘এই আইনে বলা আছে যে, যদি পুলিশ মনে করে যে আসামী পালিয়ে যেতে পারে তাহলে তার পালানো ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে,’ মি. বড়ুয়া জানান।
নারীদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে তাদের ক্ষেত্রে হাতকড়া পড়ানোর দরকার নাই।
সাংবাদিক মি. ইসলামের বিষয়টি উল্লেখ করে মি. বড়ুয়া বলেন, সব বিষয় বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, তাকে আসলে হাতকড়া পড়ানোটা অপ্রয়োজনীয়।
‘সাংবাদিক কাজলের বিষয়টা একটু অড,’ তিনি বলেন।
তিনি বলেন, মি. ইসলামের পরিবারের পক্ষ থেকে চকবাজার থানায় একটি মামলা করা হয়েছিল যেখানে বলা হয়েছে যে ১০ই মার্চ থেকে তিনি নিখোঁজ। সেই মামলায় কোন অগ্রগতি নেই। সেই মামলাটি চলমান ছিল। তার মানে সে কারো না কারো কাস্টডিতে ছিল।
এ বিষয়ে স্থানীয় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে একাধিক সংবাদও প্রকাশ করা হয়। আর তাই তাকে পাওয়া যাওয়ার পর তার বিষয়ে খোঁজ-খবর করাটা উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি।
মি. বড়ুয়া বলেন, ‘পাসপোর্ট আদেশ ১৯৭৩ এর ১১ এর ৩ ধারায় গ্রেফতার করা হলো। আর গ্রেফতারের পর তাকে যেভাবে নিয়ে যাওয়া হলো সেটা অপ্রয়োজনীয় ছিল।’
তার বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়েছে তাতে সবচেয়ে বেশি হলে তিন মাসের কারাদণ্ড হতে পারে বলেও জানান তিনি।
‘প্রতীকী হাতকড়া’
এদিকে একজন সাংবাদিককে এভাবে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে হাজিরের বিষটিকে লজ্জাজনক বলে উল্লেখ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন।
তিনি বলেন, হাত কড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ছবিটি খুবই প্রতীকী।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমের যে স্বাধীনতা নেই এবং স্বাধীন সাংবাদিকতাও যে নেই এই ছবি সেটারই প্রতীক বলে মনে করেন তিনি।
‘তাকে যে হাতকড়া পড়ানো হয়েছে সেটি হচ্ছে আজকের দিনের সাংবাদিকতার চেহারা। এটা খুব পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।’
বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের এবং অবদমিত করবার যে প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে চলছিল তারই একটা প্রতীক হিসেবে ফুটে উঠেছে। এটা সাংবাদিক সমাজের জন্য বড় বার্তা এবং বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের জন্য ভীত হওয়ার কারণ আছে বলেও মনে করেন তিনি।
(ভোরের আলো/ফআ)