লিখেছেন আমীন আল রশীদ
প্রায় দুই মাস পর সন্ধান মিললো নিখোঁজ ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের। আজ রবিবার ভোররাত পৌনে তিনটায় বেনাপোল থানার এক পুলিশ সদস্যের ফোন থেকে তিনি পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। জানান, তিনি ভালো আছেন।
তবে ঘটনা এখানেই শেষ নয়। ভারত থেকে অনুপ্রবেশের অভিযোগে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তাকে গ্রেপ্তার করেছে। তার বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের মামলাও হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, এর আগে নিখোঁজের পর ফিরে আসা ব্যক্তিদের সঙ্গে সাংবাদিক কাজলের ঘটনাটির পার্থক্য আছে। কাজলের ক্ষেত্রে আসলেই কী ঘটেছে, তিনি এতদিন কোথায় ছিলেন, কারা তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, এতদিন আটকে রেখে তার সঙ্গে কী আচরণ করা হয়েছে, তার কাছ থেকে কোন কোন বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে এবং সবশেষ কোন শর্তে বা কোন চাপে তাকে ছেড়ে দেয়া হলো— সেসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো কোনোদিনই জানা সম্ভব হবে না।
অথবা আসলেই যদি তিনি ভারতে গিয়ে থাকেন এবং সেখান থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে থাকেন, সেটিরও বা রহস্য কী? বরং অনুপ্রবেশের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ায় এই প্রশ্নগুলো এখন হাল্কা হয়ে যাবে। ফলে যে প্রশ্নটির উত্তর হয়তো চিরতরেই হারিয়ে যাবে তা হলো, সাংবাদিক কাজলের আসলেই কী হয়েছিল? মুক্তি পাওয়ার পরে তিনি কি এসব বিষয়ে নিয়ে আদৌ সত্য কথাগুলো বলবেন বা বলতে পারবেন?
তবে কথা বলুন আর চুপ থাকুন, এই দিনটি কাজল ও তার পরিবারের জন্য অত্যন্ত আনন্দের। জীবনের চেয়ে বড় কিছু তো হয় না। যদি কাজলের সন্ধান না মিলতো, যদি তাকে মেরে ফেলে লাশ গুম করে ফেলা হতো, তাতেই বা কার কী করার ছিল? কাজলের পরিবার এতটা প্রভাবশালী নয় যে, এই হত্যা বা গুমের বিচার দাবিতে সারা দেশ তোলপাড় করে ফেলতো বা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভয় পাইয়ে দিতো। বরং কাজলের সন্ধান দাবিতে অল্পবিস্তর যা হয়েছে, তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তার সহকর্মী, বন্ধু এবং সংবেদনশীল মানুষেরা অব্যাহতভাবে এই ইস্যুতে লেগে ছিলেন।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আজ ৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষ্যে সাংবাদিকদের অনেকেই ফেসবুকে তাদের প্রোফাইল পিকচার বদলে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে সেখানে Where is Kajol লেখা ছবি পোস্ট করছিলেন। আরও অনেকে আজকের দিনে এভাবে তাদের প্রোফাইল পিকচার বদলে ফেলতেন। কিন্তু, তার আগেই জানা গেল, কাজলের সন্ধান মিলেছে। এটি ২০২০ সালের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের একটি বড় উপহার নিশ্চয়ই।
স্মরণ করা যেতে পারে, এর আগেও কাজলের মতো যারা নিখোঁজের পর ফিরে এসেছেন, তারা চুপ থেকেছেন। সম্ভবত তাদের ছেড়ে দেওয়ার প্রধান শর্তই থাকে, চুপ থাকা। একমাত্র ব্যতিক্রম লেখক ফরহাদ মজহার। যিনি ফিরে আসার পরে কিছু কথা বলেছিলেন এবং তার সঙ্গে কী আচরণ করা হয়েছিল, সে বিষয়ে কিছু তথ্য দিয়েছিলেন। বাকিরা সেভাবে পরিষ্কার করে কিছু বলেননি।
২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মুবাশ্বার হাসান ও সাংবাদিক উৎপল দাসও নিখোঁজের পরে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু, কারা তাদের নিয়ে গিয়েছিল, কেন নিয়েছিল এবং কেনই বা ফিরিয়ে দিলো, সেই প্রশ্নের উত্তর জানা যায়নি। এমনকী, তাদের পরিবারও এই প্রশ্ন করতে চায়নি।
ফিরে আসা মানুষেরাও কথাবার্তায় সতর্ক। সতর্ক অথবা ভীত যাই হোক না কেন, মুবাশ্বার তখন একটি মন্তব্য করেছিলেন এরকম: যারা তার মতো অপহৃত/ নিখোঁজ/ গুম হয়নি, তাদের পক্ষে এটা কোনোভাবেই আন্দাজ করা সম্ভব নয় যে, বিষয়টা কত ভয়াবহ। তিনি এই ঘটনাকে সাইক্লোনের সঙ্গেও তুলনা করেন।
এর মানে, অনেক কথা না বললেও মোবাশ্বার কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। পেশাদার অপরাধী, ধরা যাক টাকার জন্য কোনো চাঁদাবাজ বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী অল্প বেতনে চাকরি করা সাংবাদিক বা শিক্ষকদের ধরে নিয়ে যায় না। তাছাড়া ভুলক্রমে এদের মতো কাউকে ধরে নিয়ে গেলেও ফিরে আসার পর তাদের চুপ থাকার কথা নয়। তার মানে তাদেরকে পেশাদার কোনো অপরাধী গোষ্ঠী ধরে নেয়নি। কারা ধরে নিয়ে গিয়েছিলো এবং তাদের কী উদ্দেশ্য ছিল, ফরহাদ মজহার বা মোবাশ্বার হাসানের কথায় তার কিছুটা ইঙ্গিত মিলতে পারে।
সমস্যা হলো, নিখোঁজ হওয়ার পর যারা ফিরে আসেন, গল্পগুলো অনেকটা ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের মতো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লক্ষ্য করে দুর্বৃত্তরা গুলি ছুঁড়েছে এবং পাল্টা গুলিতে তিনি বা তারা নিহত হয়েছেন— এই বর্ণনা এখন সবার মুখস্ত। একইভাবে নিখোঁজ বা গুমের পর ফিরে আসা মানুষেরাও যা বলেন, তার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য থাকে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা কিছুই বলেন না।
যেমন, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা কিংবা পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক নিখোঁজের পরে ফিরে এলেও এ নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে তারা কোনো কথা বলেননি। বিষয়টি নিয়ে তারা কোনো আইনি ব্যবস্থাও নেননি। কারণ তারা জানেন, যারা ধরে নিয়ে গিয়েছিলো তাদের সঙ্গে আইনি লড়াই করে কোনো লাভ নেই। বরং তাতে বিপদ বাড়বে এবং দ্বিতীয় দফায় নিখোঁজ হলে হয়তো লাশটাও পাওয়া যাবে না।
মুবাশ্বার হাসান ফিরে আসার পরে বলেছিলেন, তার কাছে টাকা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু, তিনি শেষ অবধি কেন মুক্তিপণ দিয়েছেন, এমন কোন কথা তিনি বা তার পরিবার গণমাধ্যমকে বলেননি। এর মানে তাকেও ধরে নিয়ে যাওয়ার পেছনেও টাকা বা মুক্তিপণ কোন বিষয় ছিল না।
সাংবাদিক উৎপল, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ তানভীর কিংবা আবু বকরক সিদ্দিককে ধরে নেওয়ার পেছনেও টাকা-পয়সা কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। কী উদ্দেশ্য? সম্ভবত তথ্য আদায় ও ভয় দেখানো, যাতে ভবিষ্যতে তারা সাবধান থাকেন। ফিরে আসার পরে এতটাই সাবধান যে, তারা আর কথাই বলেন না।
ধরা যাক, যে লোকগুলো নিখোঁজ বা গুম হয়েছেন, তাদের কেউ কেউ অপরাধে যুক্ত। সেক্ষেত্রে প্রচলিত আইনেই তাকে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব। যদি কোনো ব্যক্তি সরকার বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকেন, যদি কারো ফেসবুক স্ট্যাটাস বা কর্মকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকার বিব্রত হয়, তাহলে তাকে সতর্ক করা কিংবা তাকে শাস্তি দেওয়ার আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে। রাষ্ট্রের যে কোন নাগরিকের বিরুদ্ধেই মামলা হতে পারে এবং তার দল ও মত যাই হোক, তার বিচারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এমনকী, তাকে জিজ্ঞাসাবাদেরও আইন রয়েছে। কিন্তু তারপরও কিছু মানুষের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এবং ফিরে আসার পরে যে রহস্যের জন্ম হয়, তা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। এভাবেই একটি সমাজ ও রাষ্ট্রে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হতে থাকে।
সম্ভবত যারা এভাবে মানুষজনকে ধরে নিয়ে যান, তাদের মূল উদ্দেশ্যই থাকে সমাজ ও রাষ্ট্রে এমন একটি ভয়ের সংস্কৃতি জারি রাখা, যাতে মানুষ কিছু বলার বা লেখার আগে ১০ বার ভাবে। যাতে সে মুক্তভাবে কোনো কিছু চিন্তা করতেও ভয় পায়। কারণ মুক্তচিন্তা এবং মুক্তভাবে সেই চিন্তার প্রকাশ অনেক সময়ই ক্ষমতাবানদের উদ্বেগের কারণ হতে পারে। ক্ষমতাবানরা সব ধরনের উদ্বেগের অবসান চান।
যারা তাদের জন্য ন্যূনতম উদ্বেগ তৈরি করেন বা করতে পারেন, তারা এভাবে নিখোঁজ হন। আর এই ক্ষমতাবানরা সব সময় যে রাজনৈতিক শক্তি, এমনও নয়। বরং রাজনীতির বাইরের ক্ষমতাবানরাই অধিকতর বেশি শক্তিশালী; অনেক সময় রাজনৈতিক শক্তিও তাদের কাছে পরাজিত হয়।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, রংধনু টেলিভিশন