লিখেছেন আবির মৈত্র
বাংলা কথাসাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৯৪-১৯৫০) ক্লাসিক উপন্যাসগুলোর মধ্যে প্রধানতম হলো ‘আরণ্যক’। এটি বিভূতিভূষণের চতুর্থ উপন্যাস। উপন্যাসটির রচনাকাল ১৯৩৭-৩৯ খ্রিস্টাব্দ। বই হিসেবে প্রকাশের আগে প্রবাসী মাসিক পত্রিকায় উপন্যাসটি কার্তিক ১৯৩৮ থেকে ফাল্গুন ১৯৩৯ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভাগলপুরে থাকাকালে তিনি ‘আরণ্যক’ লেখার পরিকল্পনা করেন। ঐ সময় পাথুরিয়াঘাটা এস্টেটের সহকারী ম্যানেজার হিসেবে ইসমাইলপুর এবং আজমাবাদের অরণ্য-পরিবেশে থাকার ফলে আজন্ম নিসর্গরূপকার বিভূতিভূষণ ব্যাপক পরিভ্রমণ ও নানা বিষয়ে পর্যবক্ষেণ করেন। চাকরির সুবাদে তিনি যা কিছু পর্যবেক্ষণ করেছেন, উপলব্ধি করেছেন, তারই জীবন-ঘন বর্ণনা আমরা পাই আরণ্যক উপন্যাসে। এই সময়ে তার দিনলিপি-গ্রন্থ ‘স্মৃতির রেখা’তে তার সাক্ষ্য পাই আমরা,
এই বন, নির্জনতা, ঘোড়ায় চড়া, পথ হারানো অন্ধকার- এই নির্জনে জঙ্গলের মধ্যে খুপরি বেঁধে থাকা।এই জঙ্গলের জীবন নিয়ে একটা কিছু লিখবো- একটা কঠিন শৌর্যপূর্ণ, গতিশীল, ব্রাত্য জীবনের ছবি।
বিহারের পূর্ণিয়া জেলায় কুশী নদীর অপর পারের আজমাবাদ, লবটুলিয়া, ইসমাইলপুর সংলগ্ন বিস্তৃত অরণ্যময় অঞ্চলটি হচ্ছে আরণ্যক উপন্যাসের মূল পটভূমি। বন্য-অশিক্ষিত-দরিদ্র-অসহায় মানুষের অদ্ভুত-অজ্ঞাত জীবনধারা আর প্রকৃতির ভিন্নতর এক মুগ্ধতার আবেশ তাঁর এই কাহিনীর ক্যানভাস। উপন্যাসটি লিখিত হয়েছে উত্তম পুরুষে। এর কাহিনী আঠারো পরিচ্ছেদে বিভক্ত। দীর্ঘ উপন্যাসে চরিত্রবাহুল্যের কারণে কাহিনীর গতিশীলতা যাতে পাঠক হারিয়ে না ফেলেন, সেজন্য প্রতিটি পরিচ্ছেদকে লেখক ভাগ করেছেন কয়েকটি পর্বে।
উপন্যাসের মূল প্রটাগনিস্ট সত্যচরণ নামে এক যুবকের পনেরো-ষোলো বছর পূর্বের স্মৃতিচারণে গড়ে উঠেছে এর কাহিনী। বিএ পাশ বেকার যুবক সত্যচরণ তার এক বন্ধুর দাক্ষিণ্যে ভাগলপুরের কাছে এক জঙ্গলাবৃত এলাকায় জমিদার এস্টেটের একজন ম্যানেজারের চাকরি পায়। কয়েক হাজার বিঘা জঙ্গল পরিষ্কার করে খাজনা আদায় এবং প্রজাবিলি করার চুক্তিতে তার চিরপরিচিত ব্যস্ত কলকাতা শহর ত্যাগ করে পাড়ি জমায় বহুদূরে অরণ্যপ্রকৃতির কোলে, ‘বন্য’দের মাঝে। প্রথমদিকে গ্রামীণ অরণ্যের নিঃসঙ্গ-নিস্তরঙ্গ-শান্ত জীবনের সাথে তার ব্যস্ততা-কোলাহলমুখরতায় অভ্যস্ত শহুরে মন মানিয়ে নিতে পারে না, স্বভূমি-স্ববান্ধবের অভাব তাকে ব্যথিত করতে থাকে। কিন্তু একসময় এই ‘জঙ্গল তাকে পেয়ে বসে’। আস্তে আস্তে প্রকৃতির সৌন্দর্য-মোহে নিজেকে হারাতে থাকে সত্যচরণ,
এই অরণ্যপ্রকৃতিকে ধ্বংস করিতে আসিয়া এই অপূর্বসুন্দরী বন্য নায়িকার প্রেমে পড়িয়া গিয়াছি। যখন ঘোড়ায় চড়িয়া ছায়াগহন বৈকালে কিংবা মুক্তাশুভ্র জ্যোৎস্নারাতে একা একা বাহির হই, তখন চারিদিকে চাহিয়া মনে মনে ভাবি, আমার হাতেই ইহা নষ্ট হইবে? জ্যোৎস্নালোকে উদাস আত্মহারা, শিলাস্তৃত ধূ ধূ নির্জন বন্য প্রান্তর! কি করিয়াই আমার মন ভুলাইয়াছে চতুরা সুন্দরী!
চতুরা প্রকৃতি-সুন্দরীর মায়ায় অনুঘটক রূপে কাজ করেছে উপন্যাসের অপরাপর চরিত্রগুলো- যুগলপ্রসাদ, রাজু পাঁড়ে, মটুকনাথ, ধাতুরিয়া, ধাওতাল সাহু, যুগলপ্রসাদ, ভেঙ্কটেশ্বর, কুন্তা, মঞ্চী, নকছেদী ভক্ত, রাজা দোবরু পান্না, রাজকন্যা ভানুমতী- আরও কত চরিত্র, কত বিচিত্র জীবন! এরা প্রত্যেকেই শহরবিচ্ছিন্ন অরণ্য লালিত নীচুতলার মানুষ। উপন্যাসের শুরুতে কথকের কাছে এরা নিতান্ত বর্বর বলে গণ্য হয়, কিন্তু সময়ের পথচলায় একসময় তিনি নিজেকে এদের জীবনপ্রবাহে এমনভাবে অঙ্গীভূত করেন যে, নিজেকেই এদের রহস্যময় সরল সাধারণ জীবনে অপাংক্তেয় মনে হতে থাকে, এরাই তার কাছে হয়ে ওঠে একেকজন বিস্ময়মানব।
এই উপন্যাসে লেখক প্রকৃতির নিবিড় রহস্যময়তা, মায়ালোক আর আদিমতায় খুঁজে পেয়েছেন জীবনের গাঢ়তম রূপ; দেখেছেন মানুষের বিচিত্র প্রবণতা আর উপলব্ধির নব নব রূপায়ন। অভিনব দৃষ্টিকোণ থেকে অভিজ্ঞতা আর বিশেষণের নবত্বে তিনি সাজিয়েছেন গোটা কাহিনী। উপন্যাসের নায়ক সত্যচরণ শহর থেকে গ্রামীণ এস্টেটে গিয়ে মিশেছে এই পটভূমিতে। উপন্যাসে তাকে আমরা পাই সৌন্দর্যবোধসম্পন্ন একজন উদারমনা আধুনিক যুবক হিসেবে। তার মূল দায়িত্ব ছিলো প্রভূত এলাকার অরণ্য নিধন করে তাকে আবাদ কিংবা বসোপযোগী করে জমিদারকে বৈষয়িক লাভের সন্ধান দেয়া। কিন্তু ম্যানেজারির দায়িত্বে বহাল হওয়ার পর অভাব কিংবা বেকারত্ব তার সেই সৌন্দর্যবোধ, প্রকৃতিপ্রেম আর সংবেদনশীলতাকে ভোঁতা করে দিতে পারেনি ।অরণ্য প্রকৃতির গভীর থেকে গভীরে সে প্রবেশ করেছে—সৌন্দর্যৈশ্বর্যের যে অনির্দেশ্য-অব্যক্ত রহস্য থরে থরে সাজিয়েছেন প্রকৃতিমাতা, তার সন্ধান করতে গিয়ে সে আবিষ্কার করেছে কী অদ্ভুত রোমান্স এই মুক্ত জীবনে- প্রকৃতিঘনিষ্ঠ নিবিড় পরিবেশের আনন্দ কী অনির্বচনীয়!
কেবল নির্জনতম প্রকৃতির প্রেমই নয়, সেখানকার মানুষের ঐহিত্যকে নিজের মধ্যে লালিত করতে চেয়েছে সে। অনেকক্ষেত্রেই প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ সত্যচরণকে যতটা ভাবুক বানিয়েছে, তার থেকে বেশি প্রভাবিত করেছে বুনো মানুষের সহজ-সরল জীবন প্রণালী। আরণ্যক উপন্যাসে লেখক যে অন্ত্যজ ও প্রান্তিক মানুষগুলোর কথা বলেছেন, তারা একবেলা ভাত খেতে পায় না; ছাতু আর কলাই সিদ্ধ তাদের নিত্যকার আহার্য, তারা গয়া জেলা জানে, কিন্তু ভারতবর্ষের নাম শোনেনি কখোনো। তাদের চৈতন্য মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শহরের শ্রেণীর মনস্তত্ব থেকে স্বভাবতই ভিন্ন। লেখকের প্রতিনিধি সত্যচরণ মধ্যশ্রেণীর একজনরূপে প্রত্যক্ষ করে দুই শ্রেণীর সমৃদ্ধি এবং উল্লাসের বিপরীতে বঞ্চনা আর হাহাকারের সংঘর্ষ। ঔপন্যাসিক দেখান ঐ দারিদ্র্য, ঐ অশিক্ষা, ঐ বৈষম্য সত্ত্বেও মানুষ বাঁচে, নির্লোভ-সদাচঞ্চল-সদানন্দ জীবনে সতেজভাবে বাঁচে প্রকৃতির সঙ্গে। কথকের কণ্ঠে আমরা শুনি,
ইহাদের দারিদ্র্য, ইহাদের সারল্য, কঠোর জীবনসংগ্রামে ইহাদের যুঝিবার ক্ষমতা, এই অন্ধকার অরণ্যভূমি ও হিমবর্ষী মুক্তাকাশ বিলাসিতার কোমল পুষ্পাস্তৃত পথে ইহাদের যাইতে দেয় নাই, কিন্তু ইহাদিগকে সত্য পুরুষমানুষ করিয়া গড়িয়াছে।
নিভৃত অরণ্যচারী চরিত্রগুলোর সবারই জীবন-স্বপ্ন-মনের ভাষা আলাদা, সত্যচরণ এদের মনের ভাষা পড়তে চেষ্টা করেছে, পরম মমতায় বর্ণনা করেছে তাদের স্বপ্নকথাগুলো, তার তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি অব্যহতি দেয়নি জীবনের এক টুকরো সৌন্দর্যকেও। মানুষগুলোর প্রতি সত্যচরণের এই শ্রদ্ধা আমরা অটুট থাকতে দেখি উপন্যাসের শেষাবধি। তাদের দীর্ঘকালীন লালিত সংস্কার-বিশ্বাস-লোকাচারকে সে বিদ্রূপ করেনি, হোক না তা যুক্তির নিষ্ঠুর বিচারে অর্থহীন, কিন্তু কথক একে দেখেছে গভীর শ্রদ্ধার সাথে, আবার বন্যজন্তু অধ্যুষিত অরণ্যের নিলীম সৌন্দর্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে তার মধ্যেই আস্বাদ করেছে বিস্ময় ও রোমাঞ্চের রস।
সত্যচরণের প্রকৃতিচেতনায় তাৎপর্যপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসবোধ। নখদন্তহীন-ক্ষয়িষ্ণু সাঁওতাল রাজা দোবরু পান্না ও তার পরিবারের সান্নিধ্যে এসে সত্যচরণের নতুন উপলব্ধি ঘটেছে। তাদের জীবনকথা, তাদের ইতিহাস সত্যচরণের মনে জাগিয়েছে আর্য ও অনার্যের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের বৃহত্তর পটভূমি। তাদের এই ব্রাত্য অবস্থা দেখে তার মনে হয়েছে, অরণ্য যেন তার অন্তরে লুকিয়ে রেখেছে বহুকালের বঞ্চনার ইতিহাস, যা সময়ের ধারায় আজও প্রবাহমান,
ওদের দেখিলেই অলিখিত ভারতবর্ষের ইতিহাসের এই ট্র্যাজিক অধ্যায় আমার চোখের সামনে ফুটে ওঠে।
আবার রাজা দোবরুর সমাধিতে ফুল ছড়িয়ে দিয়ে সত্যচরণ নিজেকে খুঁজে পেয়েছে বহতা ইতিহাস-স্রোতের মাইলফলকে, আর্যজাতির একজন হয়ে পুষ্পমাল্য অর্পণের মাধ্যমে আর্য ও অনার্যের অন্তরসত্তাকে বাঁধতে চেয়েছে শ্রদ্ধার মেলবন্ধনে।
সুদীর্ঘকাল যাবৎ এই অরণ্যপ্রকৃতি ও এর জীবনের সাথে নিবিড়ভাবে মেশবার দরুণ সত্যচরণের প্রকৃতিপ্রেম আরো প্রকট হতে দেখি, যখন সে উপলব্ধি করে এখানে তার দিন ফুরিয়ে আসছে। ইতোমধ্যে অরণ্যের বহু এলাকায় মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীরা ক্রয় করেছে, নির্বিচারে অরণ্য নিধন করে ঘর তুলেছে। সত্যচরণ নিদারুণভাবে বাঁধা পড়ে তার দায়িত্বজালে। সুপ্রিয় অরণ্যানীকে রক্ষা করতে না পারার সূক্ষ্ম বেদনার স্রোত প্রবাহিত হতে থাকে তার করুণ আর্তিতে। পরাজিত আত্মার সমাধির উপর নগরসভ্যতার যে তাজমহল তৈরি হচ্ছে তার অন্তঃসারশূন্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে সে,
মানুষ কি চায়—উন্নতি, না আনন্দ? উন্নতি করিয়া কি হইবে, যদি তাহাতে আনন্দ না থাকে?… যাহারা জীবনে উন্নতি করিয়াছে বটে, কিন্তু আনন্দকে হারাইয়াছে। অতিরিক্ত ভোগে মনোবৃত্তির ধার ক্ষইয়া ক্ষইয়া ভোঁতা—জীবন তাহাদের নিকট একঘেঁয়ে, একরঙা, অর্থহীন—মন শান বাঁধানো, রস শেখানে ঢুকিতে পারে না।
প্রকৃতির সাথে তার কি প্রকট যোগ তা আমরা দেখতে পাই, যখন চাকরি অবসানে অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের মুখোমুখি অরণ্যপ্রকৃতিকে পেছনে ফেলে কলকাতায় পুনর্যাত্রাকালে আক্ষেপ করে সত্যচরণ বলে,
হে অরণ্যানীর আদিম দেবতারা,
ক্ষমা করিও আমায়।
উপন্যাসের শেষে সত্যচরণের এই খেদ, অন্তর্বেদনা পাঠক মনেও সঞ্চার করে শূন্যতার অনুভূতি।
সবমিলিয়ে নির্জন মায়াবী অরণ্যের বর্ণনা, সেখানকার হতদরিদ্র মানুষের জীবনসংগ্রাম, তাদের রোগ-শোক-আনন্দ-উচ্ছ্বাস-অভাব-আবেগ এবং বিভূতিভূষণের প্রগাঢ় জীবনদর্শনের সম্মেলনে আরণ্যক হয়ে উঠেছে মনের গহীনে বেঁচে থাকার মতো কালোত্তীর্ণ এক আখ্যান!