লিখেছেন সাদমান সাকিব
ভারতবর্ষ সুপ্রাচীনকাল থেকেই ইউরোপীয়দের কাছে সম্পদের আকর হিসেবে পরিচিত ছিল। এক ইংল্যান্ডের বিশাল সাম্রাজ্যের মধ্যে ‘সবচেয়ে সমৃদ্ধ উপনিবেশ’ তকমা তো ভারত এমনিতেই পেয়ে যায়নি। এখানকার অপরিমেয় সম্পদ শতাব্দীর পর শতাব্দী বেনিয়াদের আকর্ষণ করেছে।
ভারতের যেসব পণ্য বিশ্ববাণিজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপ ও পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে রপ্তানি হতো, তার মধ্যে মসলা অন্যতম। ভারতবর্ষের মসলার গন্ধে ম-ম করতো ইউরোপীয় রান্নাঘরগুলো। খাবারকে সুস্বাদু ও ঝাঁঝালো করার ক্ষেত্রে এসব মসলার জুড়ি মেলা ভার। তাই ভারতীয় মসলার বিপুল চাহিদা তৈরি হয় বিশ্ববাজারে।
সত্যেন সেনের ‘মসলার যুদ্ধ’ বইটি ভারতীয় উপমহাদেশের মসলা নিয়ে যে দ্বন্দ্ব সূত্রপাত হয়েছিল, তা ইতিহাসের আতশি কাচ দিয়ে দেখার একটি চেষ্টা।
মসলার বাজার হিসেবে প্রাচীনকালে ভারতবর্ষ উন্মুক্ত ছিল সবার জন্যই। ব্যবসায়ীরা দূরদূরান্ত থেকে আসতেন। মধ্যযুগে মুসলিমরা মিশর দখল করে নিলে ইউরোপীয়রা বেশ বিপাকে পড়ে। কারণ মিশর হয়ে ভারতবর্ষে জাহাজ নিয়ে আসতে হতো। আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ দিয়ে ভারতবর্ষে আসার জলপথ আবিষ্কার হয়নি তখনও। মুসলিমদের মিশরজয়ের ফলে আরবের মুসলমান ব্যবসায়ীরা একচেটিয়া ব্যবসার সুবিধা নিয়ে ভারতবর্ষের মসলার বাণিজ্য নিজেদের করে নেয়।
ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলোর মধ্যে পর্তুগিজরা ভারতবর্ষে প্রথম পা রাখে– এরকম তথ্য আমরা সবাই জানি। ভাস্কো দ্য গামার কথা কে না জানে! পর্তুগিজদের ভারতবর্ষে আসার মূল কারণ– মসলা। এক মসলার জন্যই তারা দু’বছর সাগর পাড়ি দিয়ে ভারতবর্ষে এসেছিল।
লেখক বইয়ের শুরুতেই বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন কেন ভারতের মসলার বাজার ইউরোপীয়দের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো। ভারতবর্ষে আসার আগে ইউরোপে মসলার ব্যবসা করত ইতালির ভেনিস রাজ্য। কিন্তু একচেটিয়া ব্যবসায় ভেনিসের ব্যবসায়ীদের দাম বাড়িয়ে দেয়ার কারণে পর্তুগিজরা ক্রুদ্ধ হয়, নিজেরাই মসলার মূল উৎসে হাত দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। সমৃদ্ধ নৌশক্তি, নিজেদের শক্তিশালী পুঁজিপতি শ্রেণী ও রাজার সমুদ্রপথ জয়ের তাগাদা তাদের স্বপ্নের পালে হাওয়া লাগায়। সুবিধামতো দামে মসলা পেতে হলে মসলার বাজার দখলের বিকল্প ছিল না তাদের। তাই পর্তুগিজরা যেকোনো মূল্যে ভারতবর্ষের মসলার বাজার দখল করে নেয়ার চিন্তায় বিভোর হয়ে ওঠে।
ভারতে মসলার মূল বাণিজ্য পরিচালিত হতো ভারতের সমুদ্রতীরের রাজ্য কালিকটে। তাই পর্তুগিজরা কালিকট দখলের জন্য তৎপরতা চালায়। কিন্তু কালিকটের জনগণ সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল তাদের কালিকটকে পর্তুগিজদের ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা করতে। কারণ কালিকট পর্তুগিজদের হাতে চলে আসলে তাদের ব্যবসারও পতন ঘটবে। শেষ পর্যন্ত কালিকটের পতন ঘটে। কিন্তু কালিকটের অসাম্প্রদায়িক জনগণের সংগ্রাম নিঃসন্দেহে পাঠকের মনে দাগ কাটবে।
ভারতবর্ষের নৌশক্তির অক্ষমতা ও কালিকটের প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর নির্লিপ্ততা চোখে পড়ে বেশ। পর্তুগিজরা যখন কামানসংযুক্ত যুদ্ধজাহাজে চড়ে সমুদ্রপথে দোর্দন্ড প্রতাপে রাজ করছে, তখন ভারতবর্ষের শাসক ও জনগণ– উভয়ের কাছেই কাছে কামান ছিল রহস্যময় বস্তু। তাই পর্তুগিজদের সাথে উপমহাদেশীয় নৌশক্তি পেরে ওঠেনি কোনোভাবেই। প্রতিবেশী রাজ্যগুলো কালিকটকে দুর্দিনেও সাহায্য করেনি। বরং পর্তুগিজদের আগমনে খুশি হয়েছিল এই ভেবে যে, পর্তুগিজদের কাছ থেকে ঘোড়া আমদানি করতে পারবে তারা।
ভারতবর্ষে প্রথম আগমনকারী শক্তি পর্তুগিজদের ইসলাম-বিদ্বেষের সাথে পরিচয় করে দিয়েছেন লেখক। সমুদ্রপথে নিরপরাধ হজ্জ যাত্রীদের ডুবিয়ে মারা কিংবা আরব মুসলিম ব্যবসায়ী-বোঝাই জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে তাদের কট্টর ইসলাম-বিরোধী মনোভাবের নগ্ন দিকটি উন্মোচিত করে দেন লেখক। ব্যবসার খাতিরে তারা মুসলিমদের বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু অন্যান্য ধর্মের সাথে তাদের কোনো বিরোধ ছিল না। কারণ মুসলিমদের করায়ত্ব মিশর তাদের ভারতবর্ষে আগমনের প্রধান বাধা ছিল। তাদের আগমনের পূর্বে মসলার বাজার আরব বণিকদের ভিড়ে অন্য কেউ সুযোগ পেত না। ক্রুসেডের ফলে ইউরোপে যে মুসলিমবিরোধী জনমত গড়ে ওঠে তা পর্তুগিজদের ইসলাম-বিদ্বেষের আগুনে ঘি সংযোগ করেছিল।
মসলার গল্পে অবধারিতভাবেই ইন্দোনেশিয়ার কথা চলে আসবে। মসলার উৎপাদনে পৃথিবীর মূল জায়গা ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলো। এখানে অনেক মসলা জন্মায় যেগুলো পৃথিবীর আর কোথাও জন্মায় না। তাই এখানেও আরব বণিকদের হটিয়ে দিয়ে জায়গা করে নেয় পর্তুগিজরা। কিন্তু পর্তুগিজরাও এখানে বেশি দিন টিকতে পারেনি। ডাচদের কাছে হার মেনে তাদের ইন্দোনেশিয়া ত্যাগ করতে হয়।
পর্তুগিজদের পতনের পর ডাচরা তাদের স্থান দখল করে নেয়। পর্তুগিজরা মসলা চাষীদের উপর কোনোরকম বিধিনিষেধ আরোপ করেনি। কিন্তু ডাচরা ইন্দোনেশিয়ায় চাষীদের উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করে। এসবের ফলে চাষীরা সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। মসলার পর ইউরোপে কফির চাহিদা বৃদ্ধি পেলে চাষীদের জোর করে কফি চাষে বাধ্য করা হয়, দাম বেধে দেয়া হয়। ঠিক অনেকটা ভারতবর্ষের সাধারণ চাষীদের নীল চাষে বাধ্য করার মতো।
ইংরেজরা ডাচদের সাথে মসলার যুদ্ধে টিকতে পারেনি। ইন্দোনেশিয়ায় অল্প সময় বাণিজ্য করে তাদের সেখান থেকে চলে আসতে হয় ডাচদের চাপে। কিন্তু সেখান থেকে চলে আসলেও ভারতীয় উপমহাদেশ ঠিকই নিজেদের করে নিয়েছিল। এদেশীয় সকল বাণিজ্য নিজেদের তো করে নিয়েছিলই, এদেশের শাসনক্ষমতাও দখল করেছিল। এদেশের শাসকদের কুটিল নীতি ও উন্নত সামরিক বাহিনীর সাহায্যে পরাজিত করে এদেশের মানুষের ভাগ্যবিধাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল।
সত্যেন সেন ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করে গিয়েছেন মসলার ইতিহাস, মসলা নিয়ে রাজনীতির ইতিহাস। সাবলীল বর্ণনা পাঠককে নিয়ে যায় ঔপনিবেশিক যুগে। ইউরোপীয়দের কূটনীতি চোখে পড়ে, সাথে এদেশীয় শাসকদের অদূরদর্শীতাও। স্বল্প আয়তনের এ বইটিতে লেখক ইতিহাসের অনেক কিছুই নিয়ে এসেছেন।
ঘরে বসেই বইটি সংগ্রহ করতে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিঙ্কে:
১) মসলার যুদ্ধ