লিখেছেন জাহিদ হাসান মিঠু
উত্তর কোরিয়ার সংবাদমাধ্যম তো বটেই, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও কিম জং উনের সরব উপস্থিতি দেখা প্রায় প্রতিদিন। কিন্তু হঠাৎ করেই উত্তর কোরিয়ার সুপ্রিম লিডার কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন। গত এক সপ্তাহ ধরে তার দেখা মিলছে না৷
এমনকি ১৫ এপ্রিল উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছুটির দিনেও তাকে জনসম্মুখে দেখা যায়নি, যেদিন কিম জং উনের দাদা কিম ইল সাংকে স্মরণ করা হয়। আর এরপর থেকেই গুজব রটেছে কিম জং উনের শারীরিক অবস্থা ভালো নয়৷ এমনকি অনেকে বলছেন, তিনি মারাই গেছেন!
এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম থেকে কোনো কিছুই জানানো হয়নি। গুজবের বিপরীতে তারা দেশটির সুপ্রিম লিডারের সাম্প্রতিক কোনো ছবি প্রকাশ করেনি। এছাড়া কিম জং উন নিজেও ব্যক্তিগতভাবে কোনো মন্তব্য প্রকাশ করেননি। আর এর মধ্যেই খবর পাওয়া যাচ্ছে তার জন্য চিকিৎসক পাঠিয়েছে চীন। ফলে গুজব আরো জোরালো হয়েছে।
৩৬ বছর বয়সী কিম জং উন আগে থেকেই হৃদরোগে আক্রান্ত। তার দেহ অত্যন্ত স্থূলকায়। কিমের উচ্চতা ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি হলেও ওজন প্রায় ১৩৬ কেজি। যার ফলে তার বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) ৪৫! ‘দ্য গ্রেট সাকসেসর’ বইয়ের লেখিকা আনা ফিফিল্ড জানিয়েছেন তথ্যটি। ক্ষমতায় টিকে থাকতে নিজের স্বাস্থ্যের সাথে ভালোই যুঝতে হবে কিমের- এমনটিও বলেছিলেন তিনি।
কিম জং উনের শারীরিক পরিস্থিতির খবর দুই কোরিয়া, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে তাদের কেউই এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য প্রচার করেনি। এখন প্রথমেই যেটি দেখার বিষয় তা হচ্ছে, এই গুজবের সূত্রপাত কোথা থেকে।
এই গুজবের সূত্রপাত মূলত ১৫ এপ্রিলের পর থেকে। কারণ এই দিন পুরো উত্তর কোরিয়া জুড়ে তাদের প্রতিষ্ঠাতা কিম ইল সাংকে স্মরণ করা হয়, যিনি বর্তমান নেতা কিম জং উনের দাদা।
নিয়মানুযায়ী, কিম জং উনের সেদিন কুমসুসান প্যালেসে যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে গিয়ে প্রয়াত দাদার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন- এমনই রীতি। কিন্তু সেদিন কিমকে সেই অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি। এরপর থেকে গুঞ্জন শুরু হয়েছে যে কিম জং উন সম্ভবত অসুস্থ অথবা মারা গেছেন।
১৪ এপ্রিল উত্তর কোরিয়ার বেশ কিছু মিসাইল পরীক্ষার খবর পাওয়া গেছে। তাদের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যমেও তার ছবি প্রকাশ করা হয়। যেখানে কিমকে হাসতে দেখা গেছে। কিন্তু এর কয়েক ঘণ্টা পর থেকে উত্তর কোরিয়ার সংবাদমাধ্যম একেবারেই নীরব। তারা তাদের মিসাইল পরীক্ষা নিয়ে নতুন কোনো কোনো সংবাদ প্রকাশ করছে না।
আবার অনেকে মনে করছেন, উত্তর কোরিয়ায় করোনার সংক্রমণ ঘটেছে। কিম যেহেতু হৃদরোগে আক্রান্ত, ফলে তিনি যদি করোনায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে তার জন্য সেটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে৷
আবার কিছু বিতর্কিত সূত্র বলছে, কিমের হার্ট অপারেশন করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে বড় কোনো সমস্যা হয়েছে৷ চীনের চিকিৎসক পাঠানোর বিষয়টি করোনা এবং হার্ট অপারেশন দুদিকেই ইঙ্গিত বহন করে।
সিউলভিত্তিক ডেইলি এনকে নামে এক পোর্টাল খবর প্রকাশ করে যে, ১২ এপ্রিল কিমের হৃদযন্ত্রে অপারেশন করা হয়েছে এবং তিনি ক্রমান্বয়ে সুস্থ হয়ে উঠছেন। যদিও তারা কোনো নির্ভরযোগ্য বরাত দিতে পারেনি। পরবর্তীতে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার এই খবরকে অসত্য হিসেবে উল্লেখ করেছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রও এই খবরের দিকে কড়া নজর রাখছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, কিমের বাবা কিম জং ইল ২০০৮ সালে হার্ট অ্যাটাক করলে চীনের চিকিৎসকরা তাকে সেবা দিয়েছিলেন। অন্তত দক্ষিণ কোরিয়ার মিডিয়াসমূহের দাবি ছিল তেমনটাই। ২০১১ সালে কিম জং ইল হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়েই মারা যান। এরপর থেকে উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতায় রয়েছেন কিম জং উন।
এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যদি কিম জং উন সত্যিকার অর্থেই মারা গিয়ে থাকেন কিংবা মারা যান, তাহলে উত্তর কোরিয়ার পরবর্তী নেতা কে হবেন? তারা পরিবারতন্ত্রকে কে টিকিয়ে রাখবেন? এখানে উত্তর হচ্ছে তার বোন কিম ইয়ো জং।
এপি-এর সূত্র বলছে, কিম জং উনের পর তার বোনের রাষ্ট্রের হাল ধরার সম্ভাবনা ৯০%। কারণ সাম্প্রতিক বছর গুলোতে তাকে কিমের সাথে বিশ্বনেতাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে দেখা গেছে।
কিম জং উনের দুই ভাইয়ের মধ্যে একজনের নাম কিম জং ন্যাম। তিনি ম্যাকাওতে বসবাস করতেন। ২০১৭ সালে তাকে কিমের লোকজন কুয়ালালামপুরে হত্যা করে। তিনি বয়সে কিমের চেয়ে বড়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাকে হত্যা করা হতে পারে। এ কারণে ক্ষমতায় থাকা সৎভাইকে চিঠি লিখে ক্ষমাও চেয়েছিলেন।
কিমের আরেক ভাই রয়েছে যার নাম কিম জং চোল। কিন্তু তিনি ক্ষমতার জন্য লালায়িত নন। তার রাজনীতির প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। এবং তিনি লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতেই ভালোবাসেন। চোল খুব ভালো গিটার বাজার। সর্বশেষ পাঁচ বছর আগে তাকে এরিক ক্লাপটনের কনসার্টে দেখা গিয়েছিল।
অনেকে ধারণা করছেন কিম জং উন মারা গেলে তার ভাই কিম জং চোল এই সুযোগ কাজে লাগাতেও পারেন।কেননা তাদের প্রতিষ্ঠিত পরিবারতন্ত্র তথা রাজতন্ত্রে এখন পর্যন্ত কোনো নারী কিন্তু ক্ষমতায় যেতে পারেননি!
কিম জং উনের নিজের বয়সই মাত্র ৩৬ বছর। তার কয়েকজন সন্তান থাকলেও তাদের বয়স খুবই কম। এক্ষেত্রে তার ৬৫ বছর বয়সী এক চাচা আছেন যার নাম কিম পিয়ং ইল, যিনি ইউরোপে কূটনীতিক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করার পর দেশে ফিরেছেন। তবে তিনি অনেকদিন হয়ে গেছে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে আছে।
কিমের আরেক চাচা ছিল, যার নাম জ্যাং সং থায়েক। কিম ক্ষমতায় বসার দুই বছরের মাথায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
সবদিক বিবেচনা করে কিম জং উন মারা গেলে ক্ষমতা বসতে পারেন তার বোন কিম ইয়ো জং কিংবা তার ভাই কিম জং চোল। তবে রাষ্ট্রে ইয়ো জংয়ের যেহেতু প্রভাব রয়েছে, সেক্ষেত্রে তার সম্ভাবনাই বেশি।
আর সবকিছু নির্ভর করছে কিম জং উন সত্যিকার অর্থেই মারা গেছেন কিনা। কারণ ২০১৪ সালেও তিনি পাঁচ সপ্তাহ জনসম্মুখে আসেননি। তবে যদি তিনি মারা তাহলে কে ক্ষমতায় বসবেন, সেই সিদ্ধান্ত অনেকটাই নির্ভর করবে চীনের উপর। কারণ, আখেরে চীনই হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার হর্তাকর্তা।