লিখেছেন রাকিব তুষার
বিজ্ঞান বলছে, পৃথিবীর বয়স প্রায় সাড়ে ৪ বিলিয়ন বছর। পৃথিবীতে মানবজাতির আগমন অবশ্য তারও অনেক পরে। পৃথিবীর বয়স সম্পর্কে আমাদের ধারণা যেমন বিজ্ঞানের রেডিওমেট্রিক বয়স নির্ণয়ের পদ্ধতির মাধ্যমে, তেমনি মানবজাতির আদ্যোপান্ত জানতে পারি বিশ্ব ইতিহাসের মাধ্যমে। মানবজাতির ইতিহাস লিখিতভাবে সংরক্ষণ শুরু হয় প্রায় ৭,০০০ বছর পূর্বে। এরপর যুগের পর যুগ পেরিয়ে বর্তমান আধুনিক পৃথিবী।
আধুনিক পৃথিবী যতটা বিজ্ঞানমনস্ক, ঠিক ততটাই শেকড়সন্ধানী। এই শেকড়ের সন্ধান করতে গিয়েই বহু ঐতিহাসিক তাদের লেখনীর মাধ্যমে পৃথিবীর ইতিহাস তুলে ধরেছেন। এমনই একটি বই ‘Destiny Disrupted: A History of the World Through Islamic Eyes’। বইটিতে অত্যন্ত চমৎকারভাবে ইসলামের চোখে পৃথিবীর ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। ইসলামের চোখে ইতিহাস বর্ণনা করা হলেও বইটিতে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের পরিবর্তে প্রামাণ্য ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে।
সাধারণত ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলো পড়ার সময় অনেক পাঠকই অতিরিক্ত তথ্য, সাল ও ঘটনার ধারাবাহিকতার বর্ণনায় বিরক্ত হয়ে যায়। তবে এই বইটি একেবারেই ব্যতিক্রম। অত্যন্ত চমৎকারভাবে বইটিতে ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছে। সেই সাথে তথ্যগুলোও বেশ চমকপ্রদভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বইটি পড়ার সময় পাঠকের বিরক্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। অনুবাদক বইটি সম্পর্কে বলেছেন, “এই বইটিকে ইসলামি ইতিহাসের বিশ্বকোষ হিসেবে বিবেচনা করা যায় এবং এই বইয়ে যে পরিমাণ তথ্য রয়েছে তা দিয়ে আরো বেশ কয়েকটি বই লেখাও সম্ভব।“
মোট ১৭টি অধ্যায়ের ‘Destiny Disrupted: A History of the World Through Islamic Eyes’ বইটির বাংলা অনুবাদে এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪৬৪টি। ১৭টি অধ্যায়ে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরে গড়ে ওঠা সভ্যতা থেকে একেবারে ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরে আমেরিকায় সন্ত্রাসী হামলা পর্যন্ত।
পুরো বইটির সংক্ষিপ্ত পরিচিতির স্বার্থে মোট ১৭টি অধ্যায়ের ঘটনার ক্রমানুসারকে ৩টি ভাগে ভাগ করা যায়।
১
ইসলাম ধর্ম আসার পূর্বে পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম ও সাম্রাজ্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বিশেষভাবে সে সময়ের মধ্য-পৃথিবীর বর্ণনা প্রাধান্য পেয়েছে বইটিতে। সেই সাথে ইসলাম পূর্ববর্তী শক্তিশালী পারস্য সাম্রাজ্য, সেখানে ক্ষমতার পালাবদল ও বিভিন্ন শাসনামলে সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এরপর হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্ম ও নবুয়ত এবং মদিনায় হিজরতের বিবরণ পাওয়া যায়। হিজরত পরবর্তী সময়ে মক্কা বিজয় ও রাসূল (সা.) এর ইন্তেকালের পর খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনামলের ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে।
এছাড়াও চার খলিফার শাসনামলে পৃথিবীর মানচিত্রে মুসলিম সাম্রাজের আত্মপ্রকাশ এই বইয়ের আকর্ষণীয় অংশ। খিলাফতকে কেন্দ্র করেই মূল ধারার ইসলামে প্রথম বিভাজন তৈরি হয়। হযরত আলী (রা) এর মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে উমাইয়া শাসনামল, উমাইয়াদের পর আব্বাসীয় খিলাফত। এরূপ ক্ষমতার পালাবদলে ইসলাম ধর্মে একের পর এক বিভাজন ও ক্ষমতার লড়াইয়ে এক রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের বর্ণনা মিলবে বইটিতে।
২
দ্বিতীয় ভাগের অধ্যায়গুলোতে রয়েছে বিভিন্ন ইসলামী দার্শনিক ও তৎকালে আলেম শ্রেণীর প্রভাব। সেই সাথে ইসলামে বিভাজনের ফলে সৃষ্ট নৈরাজ্যের বিস্তারিত বর্ণনা। হযরত উমার (রা) এর আমলেই মুসলিম সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক আয়তন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। উমাইয়া শাসনামলে এসে মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক গুরুত্বের ইতিবাচক পরিবর্তন সম্পর্কে এই বইটিতে জানা যাবে। এরপর উমাইয়াদের হটিয়ে আব্বাসীয়দের ক্ষমতা দখলের পর আবার ব্যাপক নৈরাজ্য ও খিলাফতের পতনের মাধ্যমে পুরো মুসলিম সাম্রাজ্য তুর্কিদের উত্থানের ব্যাপারে বিশেষভাবে জানা যায় বইটিতে।
৩
ক্ষমতার পালাবদল যেন পৃথিবীর ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ‘ডেস্টিনি ডিজরাপ্টেড’ বইটিতেও এই অবিচ্ছেদ্য অংশটি ঘুরে-ফিরে এসেছে বার বার। আব্বাসীয়দের পতনের পর দীর্ঘ সময় মুসলিম সাম্রাজ্য মুসলমানরা শাসন করলেও তা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল, যা উসমানীয় সাম্রাজ্যে আবার অনেকাংশেই একত্রিত হয়। এই বইটিতে উসমানীয়দের উত্থান-পতন, পুনরায় মুসলিম সাম্রাজ্যে বিভেদ, নৈরাজ্য সম্পর্কে জানা যাবে। সেই সাথে মুসলিম আমলে ইউরোপের অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থা ও ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্য সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। এরপর একসময় ইউরোপীয়দের দ্বারাই ওসমানীয়দের পতন, ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ও এসবের কারণ চমৎকারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বইটির একেবারে শেষের দিকে রয়েছে ইউরোপীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনে পিছিয়ে পড়া মুসলিম বিশ্বে আধুনিকতার সংস্পর্শ, উল্লেখযোগ্য মুসলিম সংস্কারকদের কথা, যাদের হাত ধরে পিছিয়ে পড়া মুসলিমরা আবার পুনর্জাগরিত হয়। আমেরিকার উত্থান, বিশ্ব রাজনীতিতে পশ্চিমাদের নেতৃস্থানীয় অবস্থান এবং মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানসহ উল্লেখযোগ্য সমসাময়িক ঘটনাসমূহ।
বইটিতে আলোচিত আরো কিছু চমকপ্রদ বিষয়
বইটিতে ক্রুসেড সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে। কীভাবে ক্রুসেডের যাত্রা শুরু হলো, ক্রুসেডারদের দ্বারা জেরুজালেমের দখল, আবার তার পুনরুদ্ধার। জানা যাবে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের এক দীর্ঘ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার নির্মম সত্য সম্পর্কেও।
শিয়া-সুন্নী; ইসলাম ধর্মের বৃহৎ দুটি বিভাজনের নাম। বইটিতে এই ঐতিহাসিক বিভাজন সম্পর্কেও জানা যাবে। সেই সাথে তাদের আদর্শিক পার্থক্যের ব্যাপারেও আলোকপাত করা হয়েছে।
মঙ্গোলদের উত্থান, চেঙ্গিস খানের বর্বরতা, আবার তুর্কিদের দ্বারা মঙ্গোলদের প্রতিরোধ ইত্যাদি সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে বইটিতে।
লেখক পরিচিতি
মীর তামিম আনসারির জন্ম ১৯৪৮ সালে আফগানিস্তানে। বাল্যকাল থেকেই ভীষণ ইতিহাসপ্রেমী এই মানুষটি তাঁর জীবনে অসংখ্য বই রচনা করেছেন। কাজ করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সট বুক এডিটর হিসে। সবসময় তিনি অনুভব করতেন পৃথিবীর ইতিহাস রচনায় পশ্চিমারা মুসলিম সাম্রাজ্যের ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে যায়। টেক্সাসের এক প্রকাশকের অনুরোধে একটি স্কুলের জন্য বিশ্ব ইতিহাসের বই রচনা করতে গিয়ে তিনি আরো বেশি করে অনুভব করেন, মুসলিম বিশ্বের ইতিহাস পৃথিবীর ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও পশ্চিমারা চায় তা বাদ দিতে।
সেখান থেকেই স্বপ্ন দেখতেন মুসলিম বিশ্বের ইতিহাস তিনি পৃথিবীর কাছে তুলে ধরবেন। একসময় ‘Destiny Disrupted: A History of the World Through Islamic Eyes’ বইটির মাধ্যমে তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়। ২০০৯ সালে বইটির প্রথম প্রকাশের পর তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।
অনুবাদক পরিচিতি
‘Destiny Disrupted: A History of the World Through Islamic Eyes’ বইটির বাংলা অনুবাদ করেছেন আলী আহমদ মাবরুর। ইতোমধ্যে বাংলা ভাষাভাষীর মানুষজন আলী আহমদ মাবরুর এর চমৎকার কিছু অনুবাদ গ্রন্থের সাথে পরিচিত হয়েছেন। তিনি তাঁর অনুবাদ গ্রন্থগুলোতে সবসময় সাবলীল ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠকের আকর্ষণ ধরে রাখতে চেষ্টা করেন। ‘ডেসটিনি ডিজরাপ্টেড’ বইটিতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় সর্বশ্রেণীর পাঠকদের কথা চিন্তা করেই অনুবাদ করেছেন বইটি।
অনলাইনে বইটি সংগ্রহ করতে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিঙ্কে: