লিখেছেন সুদীপ্ত সালাম
ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফি কী তা বোঝার আগে আমাদের জানতে হবে ফাইন আর্ট কী। আর্টকে নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞায় সীমাবদ্ধ করা সম্ভব নয়। নন্দনতাত্ত্বিকরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। সংক্ষেপে আর্ট হচ্ছে— স্থান-কালকে অনুভব করার শৈল্পিক ও আবেগময় কৌশল।
ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফি কী তা বোঝার আগে আমাদের জানতে হবে ফাইন আর্ট কী। আর্টকে নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞায় সীমাবদ্ধ করা সম্ভব নয়। নন্দনতাত্ত্বিকরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। সংক্ষেপে আর্ট হচ্ছে— স্থান-কালকে অনুভব করার শৈল্পিক ও আবেগময় কৌশল। আর্ট সৃষ্টির যোগ্যতা হিসেবে দার্শনিক ও নন্দনতাত্ত্বিক জ্ঞানের প্রয়োজন। এই জ্ঞান শিক্ষা, চর্চা ও অভিজ্ঞতা নির্ভর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আর্ট এবং ফাইন আর্ট শব্দদ্বয়কে সমার্থক মনে করা হয়। সাধারণ অর্থে তা-ই। কিন্তু সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আলোচনার সময় মেনে নিতে হবে এদুটি শব্দের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। ফাইন আর্টের বাংলা করলে দাঁড়ায়— বিশুদ্ধ কলা বা শিল্প। আর্টের তুলনায় ‘ফাইন আর্ট’ গভীর। ‘ফাইন’ শব্দটি কোনো শিল্পকর্মের মান নির্ণয় করতে ব্যবহার করা হয় না বরং শিল্পকর্মের বিশুদ্ধতা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। ফাইন আর্টের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ফাইন-আর্ট অপ্রয়োজনের প্রয়োজন হিসেবে বিবেচিত। আর এখানেই আর্ট এবং ফাইন আর্টের প্রধান পার্থক্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি জামদানি শাড়ি অবশ্যই আর্ট, কিন্তু ফাইন আর্ট নয়। কেননা শাড়িটি ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছে। ফাইন-আর্ট শিল্পকর্ম তৈরির কোনো বৈষয়িক উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। উদ্দেশ্য একটিই— নিজেকে প্রকাশ করা। নিজেকে প্রকাশ করলে কী হয়? নিজেকে প্রকাশ করলে উপলব্ধি হয় ‘আমি আছি’। আর এই উপলব্ধির আনন্দকেই আর্ট সৃষ্টি লক্ষ্য বলে মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ। (ফটোগ্রাফি দুনিয়ায়ও একটি কথা আছে, ‘তুমি ফটোগ্রাফিকে সবকিছু দিয়ে দিতে পারো, কিন্তু ফটোগ্রাফি তোমাকে আনন্দ ছাড়া কিছুই দেবে না’) এই আনন্দ কে না চায়?
ভিজ্যুয়াল আর্ট বা শিল্পকলার আধুনিকতম সংযোজন ফটোগ্রাফি বা আলোকচিত্রকলা। ফটোগ্রাফির বহু শাখা-প্রশাখার মধ্যে ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফির অর্থ— বিশুদ্ধ আলোকচিত্রকলা। ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফি একজন আলোকচিত্রশিল্পীর দৃষ্টির গভীরতা এবং শৈল্পিক চিন্তাধারা প্রসূত। ক্যামেরাকে তুলি আর আলোকে রঙ করে ভিউফাইন্ডারের ক্যানভাসে মনের মাধুরী মিশিয়ে ছবি ফুটিয়ে তোলার নামই ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফি। ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে ক্যামেরা একটি যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। শিল্পীই সব। শিল্পীর জ্ঞান, সময়, স্থান ও উপলব্ধিই সমন্বয়েই আলোকচিত্রের সৃষ্টি। কিংবদন্তি আলোকচিত্রশিল্পী ইউসুফ কার্শ বলেছেন— ‘শাটার খোলার আগে দেখো এবং ভাবো। তোমার মন ও মস্তিষ্কই ক্যামেরার আসল লেন্স।’ ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফিতে কী দিয়ে সৃষ্টি করা হচ্ছে তা মূখ্য নয়, মূখ্য— কতটা বিশুদ্ধ আলোকচিত্র সৃষ্টি করা হয়েছে।
ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফির ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। ইতিহাসবিদরা বলেন, ব্রিটিশ আলোকচিত্রী জন এডউইন মেওয়েলই প্রথম ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফির বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেন। ১৮৫১ সালে তিনিই প্রথম ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফির প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। রানী ভিক্টোরিয়ার আমলকে ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফির সোনালি দিন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। সেসময় জুলিয়া মারগারেট ক্যামেরুন, চার্লস লাটউইড্জ ডজসন, অস্কার গুস্তাভ রেজল্যান্ডার প্রমুখ এই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যান। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফির আন্দোলনকে সুসংগঠিত করেন আলফ্রিড স্টাইগ্লিট্জ। এই ক্ষেত্রে তার বিখ্যাত ‘ক্যামেরা ওয়ার্ক’ পত্রিকাটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আরো কাজ করেছেন, এফ হল্যান্ড ডে, এডওয়ার্ড স্টাইকেন প্রমুখ। ষাটের দশকে ড. এস. ডি. জুহার গড়ে তোলেন ‘ফটোগ্রাফিক ফাইন আর্ট অ্যাসোসিয়েশন’। এভাবে ধারাবাহিক পদক্ষেপের মাধ্যমে সত্তরের দশকে এসে ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফি নিজের একটি অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়। এসময় মার্কিন আলোকচিত্রী এনসেল অ্যাডাম্স, স্যালি ম্যান, রবার্ট ম্যাপলথর্পসহ আরো অনেকে ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফিতে নতুন নতুন মাত্রা যোগ করেন। বর্তমানে ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফি একটি প্রতিষ্ঠিত শিল্পমাধ্যম। এই অবস্থানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপারচার ফাউন্ডেশন এবং মিউজিয়াম অব মর্ডান আর্টের বিশেষ অবদান রয়েছে।
গোটা বিশ্বে ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফির কদর হুহু করে বাড়ছে। বিশ্বফটোগ্রাফিতে বাংলাদেশে অবস্থান সন্তোষজনক। প্রধানত ফটোসাংবাদিকতায় বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। অথচ আর এক পাও এগোয়নি বাংলাদেশের ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফি। আগেই বলা হয়েছে ফটোগ্রাফির অনেকগুলো ধারা-উপধারা রয়েছে। কিন্তু তন্মধ্যে ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফি বিশিষ্ট। কেননা ফাইন-আর্টের সাথে একজন আলোকচিত্রীর সর্বোচ্চ সৃজনশীলতা জড়িত থাকে। সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, সুস্থ মানসিক বিকাশ এবং মননের স্ফূরণে ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফির প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। তারপরও বাংলাদেশে এই ধারাটি সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। কারণ, আলোকচিত্রী এবং সংগঠকরা কখনো উদ্যোগই নেননি। উদ্যোগ না নেয়ার কারণ— ফটোসাংবাদিকতা তথা প্রেস ফটোগ্রাফির ‘বাজার’ ভালো। একটি সোনালি ভোরের ছবির চেয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ছবি বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরলে বেশি বাহবা ও অর্থ কুড়ানো যায়। ফটোসাংবাদিকতা ও ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফির মধ্যে সংঘর্ষ নেই। ফটোসাংবাদিকতার গুরুত্ব ও প্রভাব অনস্বীকার্য। সঙ্কট দেখা দেয় তখন— যখন ফটোগ্রাফি বলতেই শুধু ফটোসাংবাদিকতাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়।
সমস্যা আরো ঘনীভূত হয় যখন পেশা ও নেশাকে একাকার করে ফেলা হয়। প্রায়ই জীবিকার তাগিদের অজুহাতে কোণঠাসা করা হয় ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফিকে— যা অত্যন্ত দুঃখজনক। জীবিকার তাগিদ আগেও ছিলো, এখনো আছে। তাই বলে শিল্পসত্তাকে ভুলে গেলে চলবে না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন— ‘মানুষে শ্রেষ্ঠ পরিচয় হচ্ছে মানুষ সৃষ্টিকর্তা। আজকের দিনের সভ্যতা মানুষকে মজুর করছে, মিস্ত্রি করছে, মহাজন করছে, লোভ দেখিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে খাটো করে দিচ্ছে। মানুষ নির্মাণ করে ব্যবসার প্রয়োজনে, সৃষ্টি করে আত্মার প্রয়োজনে।’ এনসেল অ্যাডামস যদি এই অজুহাত দেখাতেন? পিকাসো যদি শুধুমাত্র জীবিকার তাগিদেই তুলি হাতে নিতেন তাহলে কেমন হতো?
বাংলাদেশে যে ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফি হচ্ছে না তা নয়। হচ্ছে কিন্তু সাংগঠনিকভাবে কোথাও হচ্ছে না। চর্চা হচ্ছে না। দেশের নামি ফটোগ্রাফিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফি বিভাগ নেই। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদেও আলাদা কোনো বিভাগ নেই। আধুনিক শিল্পকলাবিষয়ক জাদুঘর হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মর্ডান আর্টেও ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফির জন্য পৃথক সংগ্রহশালা রয়েছে, কিন্তু আমাদের শিল্পকলা একাডেমি বা জাতীয় জাদুঘরে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। অন্তত ফটোগ্রাফির একটি বিভাগ তো থাকতেই পারে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এবিষয়ে কোনো পরিকল্পনাও আছে বলে মনে হয় না। এ থেকে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি বাংলাদেশে পুরো ফটোগ্রাফির অবস্থা কতটা শোচনীয়, সেখানে ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফির অন্ধকারে থাকা যেন স্বাভাবিক। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে আলোকচিত্রশিল্পীদেরকেই। ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফির আনন্দ ও সৃষ্টিরাজ্য সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা আমাদেরই দায়িত্ব। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এই রাজ্যেই ‘মানুষ আপন অসীম গৌরব লাভ করে, সেখানে প্রত্যেক মানুষের জন্যে সমগ্র মানুষের তপস্যা’। ফটোগ্রাফির এই আনন্দরাজ্য তৈরি করতে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রয়োজন।
সুদীপ্ত সালাম : লেখক ও ফটোসাংবাদিক