শিল্পীর শিল্পকর্মকে বুঝতে হলে শিল্পীকেও বুঝা চাই। শিল্পীর দর্শন, চরিত্র ও শিক্ষার প্রতিফলন পড়ে তার কর্মে। যদি প্রতিফলিত না হয় তাহলে সে শিল্পকর্ম মেকি ও ক্ষণস্থায়ী। অবনীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আয়নাতে যেমন নিজের চেহারা তেমনি মনের দর্পণেও আমরা প্রত্যেকে নিজের মনোমতোকে সুন্দর দেখি। কারু কাছ থেকে ধার-করা আয়না এনে যে আমরা সুন্দরকে দেখতে পাব তার উপায় নেই।’
আলোকচিত্রী শফিকুল আলম কিরণের আলোকচিত্রকর্মের সঙ্গে আমার পরিচয় ২০০৭ কি ২০০৮ সাল থেকে। কিন্তু তার সংস্পর্শে আশা হয় ২০১৩ সালের দিকে। তিনি যেমন তার ছবিও তেমন। তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগে ভাবতাম, দুবার ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো পুরস্কারপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী স্বাভাবিকভাবেই তার রথের চাকা মাটি থেকে কিছুটা উপরে থাকবে। তার কাছে যাওয়ার পর বুঝলাম তিনি মাটিঘেষা মানুষ। বাণিজ্যিক আলোকচিত্রীর ভিড়ে তিনি ইমোশনাল শিল্পী। তিনি অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার মানুষের উপর কাজ করেছেন। এটি তার জীবনের প্রধানতম কাজ। যা তাকে এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও খ্যাতি। তা নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন নেই, শফিকুল আলম কিরণও এসব নিয়ে কথা বলেন না। তার কাছে এসব পুরস্কার ও সম্মাননার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ— তার ছবি অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার মানুষগুলোর জীবনে কোনো পরিবর্তন আনতে পারলো কিনা। তার এই পর্যায়ের প্রতিটি ছবিকে ছুঁয়ে গেছে আলোকচিত্রীর আবেগ-অনুভূতি ।
২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় শফিকুল আলম কিরণের ‘আনস্টপেবল : দ্য কারেজ উইদিন’ বইটি। বিষয়, অ্যাসিডের শিকার মানুষ। ছবির বইটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আমার থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। আলোকচিত্রী বক্তব্য দিতে গিয়ে কেঁদেছেন। যাদের ছবি তিনি তুলেছেন তারা যখন বক্তব্য দিয়েছেন তখনও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি এই আলোকচিত্রী। কেননা, শফিকুল আলম কিরণের কাছে অ্যাসিড-আক্রান্ত মানুষগুলো নিছকই সাবজেক্ট নয়, তাদেরকে তিনি স্বজন বলেই জানেন। তাদের সুখে-দুঃখে তিনি পাশে থাকেন। অন্যদিকে, ওই ভুক্তভোগীদের কাছে জনাব কিরণ কেবল একজন আলোকচিত্রী নন। বড় আপনজন। তারা আলোকচিত্রীর ছবি তোলা নিয়ে কথা বলেননি। বলেছেন, তাদের প্রিয় মানুষটি প্রতিনিয়ত তাদের খবর রাখেন, তাদের বাড়িতে যান, তাদের জন্য কেনাকাটা করেন…। এমন আলোকচিত্রীকে একটু জোর দিয়েই ইমোশনাল বলতে চাই। শিল্পী ইমোশনাল হবে না তো কে হবে!
ওই অনুষ্ঠানেই আমাকে বইটি উপহার দেন জনাব কিরণ। বইটি বের করেছে অ্যাসিড সার্ভাইভার্স ফাউন্ডেশন। বইটিতে আলোকচিত্রী মোট বারো জনের আলোকচিত্রিক গল্প বলেছেন। সংবদেনশীলতার সঙ্গে তিনি প্রত্যেকটি চরিত্রকে বছরের পর বছর অনুসরণ ও অনুধাবন করছেন। ছবিগুলো ১৯৯৭ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে তোলা। সব কটা ছবি সাদাকালো। শিরোনাম থেকে স্পষ্ট জনাব কিরণের উদ্দেশ্য। তিনি অ্যাসিড সন্ত্রাসের ভয়াবহতাকে ‘প্যাসিভ’ রেখে, ‘অ্যাক্টিভ’ রেখেছেন অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার মানুষগুলোর ঘুরে দাঁড়ানোর দিকটাকে। এখানেই বইটির সার্থকতা। আশাবাদ সাদাকালো ছবিতেও নানা রঙের আলো ছড়িয়েছে।
বইটি শুরু হয়েছে ছোট্ট বাবলির গল্প দিয়ে। বাবলির জন্মের পরপরই তার বাবা তাকে অ্যাসিড খাইয়ে দিয়েছিল। ফুটফুটে বাবলি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ছবিতে দেখি সে স্কুলে যাচ্ছে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শাড়ি পরে নাচছে। তার জীবনের পুরো একযুগ ফ্রেমবন্দি করেছেন আলোকচিত্রী!
মাজেদা যখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা তখন অ্যাসিডদগ্ধ হন। পরে তার একটি ছেলে হয়। নাম রাখা হয়— ইমন। ১৯৯৮ সালে ইমনের বয়স মাত্র তিন দিন, তখনকার একটি ছবি সবার মনে দাগ কাটবে। হাসপাতালের বেডে অ্যাসিডদগ্ধ মার সঙ্গে শুয়ে মার ঝলসে যাওয়া মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে সে! আর কিছু বলতে হয় না। তার আট বছর পরের ছবি, ইমনকে স্কুলের জন্য তৈরি করছেন মাজেদা। ছেলে ও মার মুখে নির্মল হাসি। কোথায় অ্যাসিড! কোথায় ঘৃণা! ইমন এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
একজনের প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বীণার বোন মুক্তি। প্রতিশোধ নিতে অ্যাসিড ছোঁড়ে ওই ছেলে। মুক্তিকে বাঁচাতে গিয়ে অ্যাসিডদগ্ধ হন সাহসী বীণা। বীণার ছবিগুলোর জন্য একবার ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো পুরস্কার অর্জন করেন আলোকচিত্রী। আলো ঝলমলে সরু গলি দিয়ে কথা বলতে বলতে বীণা ও মুক্তির হেঁটে আসার ছবিটি বীণার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতীক হয়ে আছে। বইটির প্রচ্ছদেও বীণার মুখ।
পেয়ারা কিভাবে অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিলেন সে গল্পের চেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে কিভাবে সে ওই বিপর্যয়ের পর ঘুরে দাঁড়ালো। বিভিন্ন সামাজিক কাজে তিনি এখন নেতৃত্ব দেন। একটি ছবি চোখে লেগে থাকে, গাভীর দুধ সংগ্রহ করছেন পেয়ারা। অ্যাসিডদগ্ধ মুখে তৃপ্তির হাসি। যে হাসির কাছেই তো পরাজিত সহিংসতা।
বান্ধবীদের সঙ্গে নেইল পলিশ দিচ্ছেন অ্যাসডিদগ্ধ হাস্যোজ্জ্বল সোনিয়া। প্রাণবন্ত ছবি। বান্ধবী— মানে সেই অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার বীণা ও তার বোন মুক্তি। এক ছেলে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে অ্যাসিডে ঝলসে দেয় সোনিয়ার মুখ। সেই প্রতিকূল সময় পেরিয়ে আবার নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন তিনি। প্রতিকূল সময়ের ছবির পাশাপাশি বইটিতে প্রাধান্য পেয়েছে সোনিয়ার ফিরে আসার কাহিনী। তার আরেকটি ছবি মাসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে। হাসছে সোনিয়া, তার খুশিতে আনন্দে আত্মহারা মা।
কিশোরী মনিরার প্রথম ছবিটি দেখে বুকটা ধক করে ওঠে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে খাবার খাচ্ছে সে। ফুল-লেংথের ছবিটি তার একাকিত্ব ও যন্ত্রণাকে বয়ান করে। তবে বিপরীত চিত্রও আছে, বিপর্যয় কাটিয়ে সোনিয়ার স্কুলে ফিরে যাওয়া। বন্ধুদের সঙ্গে ‘ট্রেন ট্রেন খেলা’র ছবিটি মন ভালো করে দেয়।
দুর্জয়ের বয়স যখন মাত্র দেড় মাস তখন তার চাচী তাকে অ্যাসিড খাইয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল। সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ। সুচিকিৎসায় বেঁচে যায় দুর্জয়। একটি ছবি আছে, আনন্দে হাততালি দিচ্ছে সে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার ঘোষণাই যেন সে করছে। নাকের নল, কণ্ঠের টিউব দুর্জয়কে দমাতে পারেনি।
হাওর এলাকার কিশোরী আসমার অপরাধ সে বিয়ে না করে পড়তে চেয়েছিল। বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এক দুর্বৃত্ত অ্যাসিডে ঝলসে দেয় আসমার মুখ। দুঃসময় কাটিয়ে ফিরেছেন তিনি। আসমা এখন গ্রামে-গঞ্জে পরিবার-পরিকল্পনা সম্পর্কে মানুষকে পরামর্শ ও সহযোগিতা করেন। দুই সন্তান ও স্বামীসহ তার ছবিটি অনুপ্রেরণা যোগায়। তার গল্প বলতে গিয়ে হাওর এলাকার একটি ল্যান্ডস্কেপ ব্যবহার করেছেন আলোকচিত্রী। বলতে চেয়েছেন, অ্যাসিডের শিকার হওয়ার পর আসমাকে নৌকায় করে হাসপাতালে নিতে প্রায় দুঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু অসচেতনতার কারণে অ্যাসিডের প্রতিক্রিয়া রোধে কেউ পানির ব্যবহার করলো না!
অ্যাসিডদগ্ধ ছোট্ট শিমার কানে ফুল গুঁজে দিচ্ছে অন্য এক শিশু। আরেকটি ক্যাপশনহীন ছবিতে তাদের দুজনকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখা যায়। শিশুদের মন নিষ্পাপ ও নির্ভেজাল। শিমা দেখতে কেমন তা তার বন্ধুর কাছে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত। অ্যাসিড-আক্রান্তদের প্রতি গোটা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি যদি এমন হতো! শিমার বাবা শিমা ও তার মাকে অ্যাসিড দিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল।
কিশোরী নীলা নাচতে ও গাইতে ভালোবাসতো। বিয়েতে রাজি না হওয়ায় তাকে অ্যাসিডদগ্ধ হতে হয়। সেসময়ের ছবি তো আছেই, আছে চার বছর পরের ছবিও। ততদিনে নীলার মুখে হাসি ফিরেছে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি সাজছেন। মার সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবিটিও আশাজাগানিয়া।
হাসিনার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। সদা হাস্যোজ্জ্বল এই অ্যাসিড-আক্রান্ত তরুণী। বর্ণিল রঙের শাড়ি পরেন, খোঁপায় থাকে ফুল। ঝগড়ার জের ধরে তার মুখে অ্যাসিড মারে তাদেরই বাড়ির কাজের লোক। তবে অ্যাসিড দমাতে পারেনি হাসিনাকে। তিনি এখন সরকারি চাকরি করেন। হাসিনার একটি পোরট্রেট স্মৃতিতে থেকে যায়, তার গায় বড় বড় ফুল আঁকা পোশাক, বাতাসে উড়ছে তার খোলা চুল। ছবিটিতে তার আত্মশক্তির প্রকাশ ঘটেছে।
সাধারণ মানুষে ঘেরা মনির উজ্জ্বল মুখের ছবি দিয়ে শেষ হয়েছে বইটি। অর্থাৎ বইটির শিরোনামের প্রতি সুবিচার করা হয়েছে শুরু থেকে শেষতক।
যেহেতু বইটি একটি এনজিও বের করেছে— স্বাভাবিকভাবেই বইটিতে রাখা হয়েছে ওই এনজিও’র নানা কার্যক্রম ও সফলতার ছবি। এই প্রচারণামূলক ছবিগুলো জীবনের গানে বেসুরা মনে হয়েছে। বইটির দুর্বলতা ওখানেই। তারপরও অ্যাসিড সার্ভাইভার্স ফাউন্ডেশনকে ধন্যবাদ এমন একটি ব্যয়বহুল প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসায়। বইটি বিক্রির জন্য নয়, সংস্থার ওয়েবসাইট থেকে বিনামূল্যে মিলবে বইয়ের পিডিএফ সংস্করণ।
ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফির দুনিয়ায় ‘আনস্টপেবল : দ্য কারেজ উইদিন’ একটি অনন্য সংযোজন। আর চর্বিত চর্বনের ভিড়ে তো ভীষণ ব্যতিক্রম। বাংলাদেশে ফটোবুকের সংখ্যা হাতেগোনা। এমন একটি বই অন্য আরো বইয়ের অনুপ্রেরণা হোক।