লিখেছেন সুদীপ্ত সালাম
কাফনে মোড়া লাশের পাশে হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছেন ওয়ালীউল্লাহ। কেতাদুরস্ত এই মানুষটি কখনো এভাবে মাটিতে বসেন না। নাকি বসেছেন, কবে? মনে করা হয় না। সকল চিন্তা মিলিয়ে যায় কোনো এক কৃষ্ণগহবরে। এমন বারবার হচ্ছে। কোনো বিষয় তার চিন্তায় জায়গা করে নিতে পারছে না। এই যে তিনি তাকিয়ে আছেন, দেখলে মনে হবে তার দৃষ্টি ওই জোনাকি পোকার ভিড়ে নিবদ্ধ। আসলে তিনি কোথাও তাকিয়ে নেই। চিন্তার মতো তার দৃষ্টিতেও কোনো কিছু ঠাঁই পাচ্ছে না। কিছু দূরে কুপির আলোয় পৌরসভার দুই শ্রমিক মাটি খুঁড়ছে। খননের কাজ তদারকি করছে হামিম। কবরের দৈর্ঘ্য হতে হবে লাশের উচ্চতা থেকে একটু বেশি এবং গভীরতা হবে লাশের দৈর্ঘ্যের অর্ধেক। সেখানে দাফন করা হবে ওয়ালীউল্লাহর পাশে পড়ে থাকা লাশটিকে। ভোর হতে বেশি বাকি নেই। রাতের ক্যানভাস থেকে চুইয়ে চুইয়ে কালি ঝরে পড়ছে। বেরিয়ে আসছে আকাশের কালচে নীল রং। সূর্য উঁকি দেওয়ার আগেই কায়েসের দাফন সম্পন্ন করতে হবে। চোখ-ঝাঁঝালো সাদা কাপড় দিয়ে পুঁটলি করা লাশটি যখন জীবন্ত ছিল, তাগড়া যুবক ছিল, তখন সবাই তাকে কায়েস বলেই চিনতো। কাওরাইদের সম্মুখযুদ্ধে শহিদ হওয়ার পর কেউ তাকে চেনে না। তাকে চিনতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে স্বয়ং তার বাবা ওয়ালীউল্লাহ! ছোটভাই হামিমও কাউকে বলতে পারেনি, কায়েস আমার ভাই!
খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শেষ। কায়েসের নিথর দেহ কবরে নামানোর পালা। হামিম বাবার কাছে ফেরে; কিন্তু কিছু বলতে পারে না। বলবে, নাকি নিজেরাই ধরাধরি করে লাশ কবরে নামাবে? সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর অস্পষ্টভাবে ‘আববা!’ শব্দটি উচ্চারণ করে সে। একটুও না নড়ে, দৃষ্টি না ফিরিয়ে ওয়ালীউল্লাহ বলেন, ‘তোমরাই দাফন সম্পন্ন করো।’ কণ্ঠ খুবই স্বাভাবিক ও দৃঢ়। যেন নির্দেশ দিলেন। হামিম বুঝে যায় আর কথা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। সে ইশারায় শ্রমিকদের হাত লাগাতে বলে। ওরা তিনজন মিলে লাশটি কবরে নামায়। কবর থেকে উঠে কাঁদতে শুরু করে হামিম। কান্নার শব্দে ভেঙে চুরচুর হয়ে যায় ভয়ের জমাট নীরবতা। আর এই প্রথম ওয়ালীউল্লাহর চোখদুটো নড়ে ওঠে। মেজো ছেলের দিকে তাকান তিনি। ‘ভাইয়া!’ ‘ভাইয়া!’ বলে হামিম কাঁদছে, তাকে সান্তবনা দেওয়ার চেষ্টা করছে শ্রমিকেরা। ওয়ালীউল্লাহ বসেই থাকেন। তার চোখে অশ্রম্ন নেই। এই গোরস্তানে তিনিও যেন একটি লাশ।
পৌরসভার সচিব ওয়ালীউল্লাহ কখনো ভাবেননি, এমন দিনও আসবে। নিজ হাতে আদরের বড় ছেলের লাশটিকে গোসল করিয়েছেন তিনি। কাফনে ঢেকেছেন ওই ফুটফুটে মুখ। মর্গের বারান্দায় নিজেই পড়িয়েছেন জানাজা। কেউ তাকে কাঁদতে দেখেনি। কিন্তু তিনি কেঁদেছেন, গোসল করানোর সময়। ওই একবারই। কাঁদতেন না হয়তো, ছেলের কপালের বাঁ পাশে বুলেটের ক্ষতটিই না তার ঘনীভূত কান্নাকে উসকে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে রাববুল আলামিনের কাছে এই হত্যাসহ সকল হত্যা ও নির্যাতনের বিচার চেয়েছেন তিনি। নিজের সারাজীবনের নেক আমলের বিনিময়ে ছেলের আত্মার শান্তি কামনা করেছেন এই বৃদ্ধ বাবা।
কায়েস ভেবেছিল ক্লাসশেষে রুমটা একটু ফাঁকা হলে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলবে। কিন্তু রুম ফাঁকা হওয়ার আগেই সামনের বেঞ্চে থাকা মেয়েটি বেরিয়ে গেল। কায়েস ব্যাগটি কোনোমতে গুছিয়ে মেয়েটির পেছনে ছুটলো। আজ কথা না বলতে পারলে আর কখনো বলা হবে কিনা সন্দেহ। সিঁড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি নামতে গিয়েও পারলো না সে। ভীষণ ভিড়। নিচে কোনোমতে নেমে চারপাশে খুঁজেও মেয়েটির দেখা মিললো না। অডিটরিয়ামের দিকে যাবে বলে ঠিক করলো। এগোতেই রহমান সামনে এসে দাঁড়ালো,
– চল ক্যান্টিনে যাই, কথা আছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও রহমানের সঙ্গে ক্যান্টিনের দিকে হাঁটতে শুরু করে কায়েস। হাঁটতে হাঁটতেই মেয়েটির দিকে তার চোখ পড়লো। ওই তো খোলাচুলের মেয়েটি, বান্ধবীদের সঙ্গে কথা বলছে, হাসছে। আহ! কি নির্মল হাসি! মেয়েটির দিকে এগিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল; কিন্তু পারার উপায় নেই।
বুয়েটের মেধাবী ছাত্র কায়েস। ক্যাম্পাসের মেধাবী মুখ হওয়ার জন্য নয়, তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে তুখোড় দাবাড়ু হিসেবে। দাবায় তাকে হারানো প্রায় অসম্ভব। এ-সময়ের বিখ্যাত লেখক-চিন্তাবিদেরা আসেন তার সঙ্গে খেলতে। ইদানীং চোখ বন্ধ করে দাবা খেলার কৌশল রপ্ত করেছে সে। সেই কায়েস ওই মেয়েটির সামনে একেবারেই আনাড়ি ও অখ্যাত। অনেকবার চেষ্টা করেছে মেয়েটির নামটি অন্তত জিজ্ঞাসা করবে, পারেনি। মেয়েটিও কি বোঝে না! নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করে? কায়েসের দিকে সে কোনোদিন চোখ তুলে তাকায়ওনি। কায়েসের খ্যাতির যেন কোনো মূল্য তার কাছে নেই। নাকি মেয়েটি আশা করে কায়েসই একদিন দ্বন্দ্ব কাটিয়ে তার সামনে হাজির হবে? কায়েসের জন্য বোঝা মুশকিল।
রহমান ও কায়েস ক্যান্টিনে ঢোকে। সেখানে অপেক্ষা করছিল তাহের, গোলাপ ও রুবিনা। চেয়ার টেনে বসতেই গোলাপ শুরু করলো,
– দেশের অবস্থা ভালো না। ইয়াহিয়া ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছিল না? সেটি আদৌ হবে কিনা সন্দেহ।
– কেন! কায়েস যেন আকাশ থেকে পড়ে।
– কারণ ভুট্টো সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তার দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি অধিবেশনে যোগ দেবে না।
– শেখ মুজিবের প্রতিক্রিয়া কী? রহমান জানতে চাইলো।
– ভুট্টোর সিদ্ধান্তকে তিনি গণতন্ত্রবিরোধী বলেছেন। রুবিনা জানায়।
– ওদের কাছ থেকে গণতন্ত্র আশা করাটাই ভুল। তাহের বললো।
– তাহলে সবকিছু এখন অধিবেশনের ওপর নির্ভর করছে? রহমান যেন আশার আলো খুঁজছে।
– আমার মনে হয় না অধিবেশন হবে। অধিবেশন নিয়ে টালবাহানা তো অনেকদিন ধরেই চলছে। গোলাপ আশা ছেড়ে দিয়েছে।
– আমার মনে হয় শেখ মুজিবেরও বিকল্প পরিকল্পনা আছে। তিনি সহজে ছেড়ে দেওয়ার লোক নন। কায়েস একটু থেমে আবার বলে, ‘আমার মনে হয় তিনি সকল নিয়মতান্ত্রিক পথ অবলম্বন করতে চাইছেন। দেয়ালে পিঠ থেকে গেলে তিনিও আঙুল বাঁকা করবেন।’ রুবিনা কায়েসের কথায় সায় দেয়।
– আমাদের কী করা উচিত? হাত গুটিয়ে বসে থাকবো? রহমান জানতে চায়।
– যে-কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় মানসিকভাবে তৈরি থাকতে হবে। গোলাপ একটু থেমে আবার বলে, ‘প্রয়োজনে সশস্ত্র যুদ্ধেও ঝাঁপিয়ে পড়তে হতে পারে!’
– যুদ্ধ! রুবিনা বিস্ময় প্রকাশ করে।
– হ্যাঁ, যুদ্ধ! তোরা কি মনে করিস ওই হারামিরা এমনি এমনি আমাদের হাতে আমাদের অধিকার তুলে দেবে! দেবে না – কক্ষনো দেবে না! লড়াই করেই আমাদের তা আদায় করে নিতে হবে। গোলাপের এই ব্যাখ্যার পর কেউ আর কোনো কথা বলে না।
রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেছে। ১ মার্চ দুপুরের মধ্যে এ-খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লো। দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড়। হরতালের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। পড়া ও দাবা গুটিয়ে কায়েস গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে ফিরে এলো।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই কায়েস নিজেকে দেশের জন্য তৈরি করতে শুরু করে। সবার মতো সেও বুঝে যায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। সীমান্তবর্তী ধোবাউড়া উপজেলায় যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে কায়েস। ২৫ মার্চ রাত থেকে শুরু হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাঙালিরাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শুরু করে। এ-সময়ই কায়েস স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেয়। কেউ তাকে যুদ্ধে যেতে বাধা দেয়নি। বাবা ওয়ালীউল্লাহ ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘যাও বাবা, আমাদের জন্য চিন্তা করো না, আমি তো আছি।’ ছোট ভাইবোনগুলো চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরে, সবাইকে আদর দিয়ে এবং মাকে সালাম করে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় কায়েস। তার আর ঘরে ফিরে আসা হয়নি।
তার দাবা ও প্রকৌশল দুটোই কাজে লাগতে থাকে মুক্তির সংগ্রামে। বেশ কয়েকটি অপারেশনে অংশ নিয়ে মেধা ও বীরত্বের স্বাক্ষর রাখে সে। নষ্ট অস্ত্র সচল করতেও তার জুড়ি নেই। একবার তো একটি ভাঙা স্টেনগানের সঙ্গে অন্য যন্ত্রাংশ জুড়ে দিয়ে অভিনব এক মেশিনগান তৈরি করে ফেললো!
১৪ জুন, ১৯৭১। ঘন আখক্ষেতের ঠিক মাঝখানে গোল করে কাটা হয়েছে আখ, যাতে বসে যুদ্ধের পরিকল্পনা করা যায়। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। শুধু পাখিরাই আকাশ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের এই ডেরা দেখতে পায়। দুপুরে সেখানে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে কায়েসসহ আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। একদিকে শিবনাথ তার বউয়ের কথা মনে করে নীরবে কাঁদছে। কায়েস এই অশ্রম্নর কারণ জানে না। শাকিরুলই জানালো, শিবনাথ খবর পেয়েছে তার পোয়াতি বউ আর বেঁচে নেই। বড় নির্মম সেই মৃত্যু, বীভৎস সেই মৃত্যুদৃশ্য! শিবনাথের বউ সাত মাসের গর্ভবতী ছিল। মিলিটারিরা রাতে তার বাড়িতে হামলা চালায় এবং দুজন সেনা মিলে সারারাত বউটার ওপর নির্যাতন চালায়। বউটি নাকি হাতজোড় করে বারবার বলেছে যে সে পোয়াতি। কিন্তু পশুগুলো নিস্তার দেয়নি। সকালে মিলিটারিরা চলে গেলে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয় শিবনাথের বউ। পরে পাশের বাড়ির লোকেরা দরজা ভেঙে দেখে সে ফাঁসিতে ঝুলছে। ঘরের বাতায় কাপড় পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দেয় সে। আর মৃত মায়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসে নাড়ির সঙ্গে ঝুলছিল মৃত নবজাতক! শিবনাথের দিকে তাকায় কায়েস। ওকে বুকে জড়িয়ে সান্তবনা দিতে ইচ্ছে করে তার; কিন্তু তা করে না। কাঁদুক, কান্নাই পারে শিবনাথের বুকের পাথরটিকে ক্ষয় করতে।
বাদল জানালো, তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের জনগণ ও সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। কায়েস জানতে চায় বঙ্গবন্ধুর কোনো খবর আছে কিনা। বাদল জানায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর মুক্তির জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছেন। শাকিরুল বলে, ‘শি ইজ অ্যান আয়রন উইমেন!’ কায়েস যোগ করে, ‘এই লৌহমানবীর একটি বিশাল হৃদয়ও আছে। এখন পর্যন্ত আমাদের প্রায় ৫৮ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছেন তিনি।’ ঠিক এমন সময় খসখস শব্দ পেয়ে সবাই অস্ত্রহাতে সতর্ক অবস্থান নিল। কে বা কারা যেন আসছে। খসখস শব্দ কাছাকাছি এসে থেমে যায়। পরিচিত কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘আমি, বাচ্চু!’ কায়েসেরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে অস্ত্র নামিয়ে রাখে। শাকিরুল বললো, ‘আয়!’
দবির মাঝির ছোট ছেলে বাচ্চু। বাচ্চু তাদের জন্য খাবারসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনা-নেওয়া করে। অনেক সময় অস্ত্রও বহন করে। শিশু বলে তাকে পাকিস্তানি সেনারা সন্দেহও করে না। বাচ্চু দৌড়ে এসেছে। একটু জিরিয়ে নিয়ে জানালো, মিলিটারিরা বশির চেয়ারম্যানকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে! রাজাকারদের মাধ্যমে মিলিটারিরা জেনে গেছে যে, বশির মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়। কায়েসরা অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। পরিকল্পনা করার সময় নেই। ত্বরিত সিদ্ধান্ত না নিলে বশির চেয়ারম্যানকে আর জীবিত পাওয়া যাবে না। কায়েসরা ডেরা থেকে বের হয়।
জয়ধরখালী গ্রামে অস্থায়ী ক্যাম্প বসিয়েছে সেনারা। সিদ্ধান্ত হলো, ক্যাম্পে হামলা করা হবে। সাত-আটজনের দলটি ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছায়। এটি একটি টিলা এলাকা, কয়েকটি টিলার পাদদেশে সেনা-ক্যাম্প। টিলায় পজিশন নিয়ে কায়েসরা হাতবোমা দিয়ে হামলা শুরু করে, ওদিক থেকেও শুরু হয় পালটা আক্রমণ। একটু পরই বোঝা গেল, পাকিস্তানিদের তুলনায় তারা সংখ্যায় অনেক কম। অপারেশনটা যতটা সহজ হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল তার ঠিক উলটো হলো। খাকি পোশাকের সেনাদের সঙ্গে লড়াই করে বেশিক্ষণ টেকা গেল না। গোলাবারুদও প্রায় শেষ। কায়েসের সঙ্গীরা পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কায়েস চাল ফিরিয়ে নিল না। শেষ পর্যন্ত খেলা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। শিবনাথ কায়েসের সঙ্গে থাকে, বাকিরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। শিবনাথের ঠিক কণ্ঠনালিতে একটি গুলি লাগে। ফোয়ারার মতো তার গলা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। একা কতক্ষণ পারা যায়! একসময় একটি বুলেট কায়েসের পাঁজরের এপার-ওপার হয়ে যায়। গুলি খেয়ে টিলা থেকে গড়িয়ে পড়ে সে। নিথর পড়ে থাকে তার শরীর। পাক সেনারা যখন নিশ্চিত হয় যে, সে আর বেঁচে নেই তখন তাকে টেনেহিঁচড়ে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। কিন্তু তখনো তার দেহে প্রাণ আছে। ক্যাম্পের তাঁবুর সামনে যখন কায়েসকে ছুড়ে ফেলা হয় তখন তার মুখ থেকে ‘আববা!’ শব্দটি বেরিয়ে আসে। পাক হায়েনারা তখন বুঝে ফেলে ‘এ মুক্তি আভি বি জিন্দা হ্যায়।’ এরপর শুরু হয় পাশবিক নির্যাতন। কায়েসের দেহ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অবশিষ্ট প্রাণটুকু বের করে ফেলার উল্লাসে মাতে তারা। অনেক প্রশ্ন করা হয় তাকে, কোনো কথাই কায়েসের কানে ঢোকে না। বোধশক্তি হারিয়েছে অনেক আগেই। রক্তাভ চোখদুটি খোলা, কিন্তু তাতে দৃষ্টি নেই। চলচ্চিত্রের মতো তার সামনে ভেসে ওঠে কিছু অস্পষ্ট দৃশ্য – দ্রুত একটির পর একটি, খোলাচুলের মেয়ের মুখ, জায়নামাজে বসা আববা, বড় রুই মাছ কাটতে বসা মা, ছোটভাই লিটু ও লাইজুর ঝগড়া এবং একটি লাল-সবুজ পতাকা।
ক্যাম্পের ইনচার্জ যখন বুঝতে পারে এর কাছ থেকে আদায় করার কিছু নেই, তখন তার কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে দেয়। গুলির শব্দটি অনেকক্ষণ টিলা এলাকায় দৌড়ে বেড়ায়।
পরদিন কায়েসের লাশ হাসপাতালের মর্গে চালান করা হয়। দায়িত্বে থাকা কর্নেলকে সিদ্দিক রাজাকার বলেছে, লাশের চেহারার সঙ্গে পৌর সচিব ওয়ালীউল্লাহর বড় ছেলে কায়েসের মিল রয়েছে। নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, কারণ নির্যাতনের পর চেহারা আর চেহারা নেই – যেন দগদগে মাংসপি-।
ওয়ালীউল্লাহ ছেলের শহিদ হওয়ার সংবাদটি যখন পান, তখন নিজের দফতরে দৈনন্দিন কাজ করছিলেন। খবরটি পাওয়ার পর কিছুক্ষণ পাথরের মতো নিশ্চুপ ও অনড় হয়ে থাকেন। পরে নিজেকে সামলে জরুরি কাজগুলো সেরে বাসার দিকে রওনা হন। রিকশা নেওয়ার কথাও তিনি ভুলে যান। হাঁটতে থাকেন তার চিরচেনা শহরের পথ ধরে। তাকে দেখে রিকশাচালক, দোকানদার, পরিচিতজনেরা সালাম দেয়, তিনি খেয়াল করতে পারেন না। কলের পুতুলের মতো তিনি হেঁটে চলেন।
বাড়িতে ঢুকে কারো সঙ্গে কথা বলেন না। নিজের ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেন। উড়োখবর বাড়িতেও এসেছে। বাড়িতে একদফা চাপাকান্নার ঝড় বয়ে গেছে। ওয়ালীউল্লাহর আচরণে বাড়ির অন্যরা এখন অনেকটাই নিশ্চিত – কায়েস আর নেই। অনেক ডাকাডাকির পরও ওয়ালীউল্লাহ দরজা খুললেন না। ভেন্টিলেটরের ফোকর দিয়ে দেখা গেল তিনি জায়নামাজে বসে আছেন। এভাবে রাত পার করে দিলেন তিনি। পরদিন সকালে হামিম দরজার কাছে এসে জানায়, আমানুল চাচা এসেছে। সিদ্দিক রাজাকারের ডানহাত, শান্তি কমিটির সদস্য। এর দশ-পনেরো মিনিট পর দরজা খোলেন ওয়ালীউল্লাহ। খুবই স্বাভাবিক তার অবস্থা। ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরেছেন, চোখে সুরমা, সুন্দর করে আঁচড়ানো দাঁড়ি ও চুল। মাথায় সাদা টুপি। তাকে দেখে বোঝার উপায়ই নেই তিনি তার বড় ছেলেকে চিরদিনের জন্য হারিয়েছেন। প্রতিদিন বাড়ি থেকে যেভাবে পরিপাটি হয়ে বের হন, ঠিক সেভাবেই তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল আমানুল। ওয়ালীউল্লাহকে দেখে উঠে দাঁড়ালো এবং সালাম দিলো। সালামের উত্তর দিয়ে তিনি একটি চেয়ার টেনে বসলেন। আমানুল নিজের চেয়ারে ফিরে গিয়ে কথা শুরু করলো,
– সার, আফনে কিরুম আছুইন?
– ভালো। আপনাদের খবর কী? অবস্থা স্বাভাবিক রাখেন ওয়ালীউল্লাহ।
– আমগর আর অবস্থা! দেশের অবস্থা তো স্যার আফনেই দেখতাইন পারতাছুইন। নিজেগর কথা ভাইববার সময় আর কই পাইয়াম! পাকিস্তান ও ইসলামের খেদমত কইরবার চেষ্টা করতাছি …
– তা সকাল সকাল আমার এখানে কী মনে করে? ওয়ালীউল্লাহ প্রসঙ্গ বদলান।
আমানুল জানায়, ওয়ালীউল্লাহকে একবার হাসপাতালের মর্গে যেতে হবে। কর্নেল সাহেবের আদেশ। সে আর বিস্তারিত কিছু জানায় না। চা-বিস্কুট শেষ করে বিদায় নেয়। আমানুল না জানালেও ওয়ালীউল্লাহ জানেন, কেন তার ডাক পড়েছে।
ইতোমধ্যে বাড়ির সবাই নিশ্চিত – তাদের সবার প্রিয় কায়েস আর নেই। বাড়িতে আবার কান্নার রোল পড়ে যায়। কান্না নেই শুধু ওয়ালীউল্লাহর। বড় ঘরে দরজা বন্ধ করে কাঁদছেন কায়েসের মা। দরজার কাছে গিয়ে ওয়ালীউল্লাহ স্ত্রীর উদ্দেশে বলেন,
– কায়েসের মা, মনে জোর রাখো! কান্না থামাও! সবাই যদি জানে মর্গের ওই লাশ কায়েসের তাহলে বিপদ হবে। সিদ্দিক রাজাকার এমনিতেই ওতপেতে আছে। সে যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে তাহলে মিলিটারি নিয়ে এসে পুরো বাড়িতে তা-ব চালাবে। শান্ত হও, কায়েসের জন্য দোয়া করো।
তার কথা কাজে দেয়। কায়েসের মায়ের কান্না গোঙানিতে রূপ নেয়। তারপর তিনি বাড়ির সবাইকে শান্ত হতে এবং আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখতে বলেন। সবাইকে শিখিয়ে দেন, কেউ জিজ্ঞাসা করলে যাতে বলা হয়, কায়েস ঢাকায়। একটু থেমে আরো বলেন, ‘সবাই বলবে, জয়ধরখালীর যুদ্ধে যে মারা গেছে সে কায়েস না।’ শেষের কথাটি বলতে গিয়ে তার কণ্ঠ ধরে আসে। কিন্তু তারপরও তিনি নিজের দুর্বলতা কাউকে বুঝতে দেন না। তিনি জানেন, এ-কথা সত্য নয়। কায়েসই শহিদ হয়েছে, মর্গে পড়ে থাকা লাশটিও কায়েসের। জীবনে এই প্রথম তিনি মিথ্যার আশ্রয় নিলেন। নিতে হলো। কারণ একটি মিথ্যা কায়েসের অজ্ঞাত লাশকে পরিচয় দেবে, আর সত্য দেবে আরো মৃত্যু, আরো নির্যাতন। তিনি শুধু কায়েসেরই পিতা নন, ক্রন্দনরত এই ছেলেমেয়েদের কথাও তাকে ভাবতে হবে। তারপর মেজো ছেলে হামিমকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন। কায়েসের মাকে বলে যাওয়া হলো না।
মর্গের বাইরের নড়বড়ে বেঞ্চটিতে বসে আছেন ওয়ালীউল্লাহ ও হামিম। দেড় ঘণ্টা আগে তাদের ওখানেই অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। লাশের গন্ধ ভেসে আসছে। সহ্য করতে না পেরে শার্টের এক কোনা দিয়ে নাকের ছিদ্র চেপে রেখেছে হামিম। ওয়ালীউল্লাহ ভাবলেশহীন। কী এক গভীর চিন্তায় তিনি নিমজ্জিত। তার নাকে গন্ধ ঘোরাফেরা করছে। একবার তো নিজেই গন্ধ টেনে নিলেন! কেন? তিনি কি গন্ধটাকে ভেঙে দেখছেন তাতে কায়েসের গায়ের গন্ধ আছে কিনা? কায়েসের গন্ধ তিনি ভালো করেই চেনেন। তার নামাজ পড়ার সময় কায়েস যখন নিঃশব্দে ঘরে ঢুকতো তখন তিনি তার গন্ধ দিয়েই বুঝতেন কায়েস এসেছে। কায়েসও তো অবাক হতো, ‘আববা আপনি বুঝলেন কীভাবে!’ ওয়ালীউল্লাহ তখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মৃদু হাসতেন। বাড়ির বড় ছেলে, তাকে নিয়ে বাবার কত উচ্চাভিলাষ! কত স্বপ্ন! সংসারের হালটাও কায়েস ধরবে, মা ও ভাইবোনদের দায়িত্ব নেবে …। এসব কথাই ভাবছিলেন তিনি। তার চিন্তায় চির ধরে এক পাকিস্তানি সেনার বুটের শব্দে। ওয়ালীউল্লাহ ও হামিম উঠে দাঁড়ায়। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কর্নেল মেহমুদ। মেহমুদ ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ শনাক্ত করা তার বাড়তি দায়িত্ব। সে সরাসরি ওয়ালীউল্লাহকে প্রশ্ন করলো, ‘আপহি ওয়ালীউল্লাহ হো?’ ওয়ালীউল্লাহ স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দেন, ‘জি হাঁ, ম্যাঁ হি …’ তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই হামিমকে দেখিয়ে কর্নেল প্রশ্ন করে,
– এহ কৌন হ্যা?
– এ মেরা বেটা, হামিম। ভয়ে হামিম ঘামছে।
– এতো আপকা বড়া বেটা নহি হ্যা? বড়া বেটা কঁহা হ্যা?
একটুও বিচলিত না হয়ে ওয়ালীউল্লাহ উত্তর দেন
– মেরা বড়া বেটা ঢাকা মেঁ হ্যা। ওহাঁ পে বোহ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তা হ্যা।
কর্নেল এই উত্তরটি আশা করেনি। ভ্রম্ন কুঁচকে লাশকাটা ঘরের দিকে ইঙ্গিত করে সে বলে,
– ম্যাঁ তো সুনা হ্যা আপকা বড়া বেটা এহাঁ পর হ্যা।
ওয়ালীউল্লাহ বুঝতে পারেন তাকে আরো দৃঢ়তা দেখাতে হবে, তিনি জোর দিয়েই বলেন,
– সবাল হি প্যাদা নহিঁ হোতা স্যার! মেরা বেটা ঢাকা মেঁ হ্যা, কাল রাত হি ফোন পে উসসে মেরি বাত হুই হ্যা।
মিথ্যাটা বলা গেল ঠিকই। কিন্তু ভয়ের একটি শিহরণ সারা শরীরে বয়ে গেল, কর্নেল যদি এখন কায়েসের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে চায়?
নাহ্, তা না করে কর্নেল বললো, ‘আইয়ে মেরে সাথ।’ হামিমকে বসে থাকতে বলে ওয়ালীউল্লাহ কর্নেল মেহমুদকে অনুসরণ করে লাশকাটা ঘরে ঢুকলেন।
ঘরটি খুব বড় নয়। আলো কম। দুর্গন্ধময়। চার-পাঁচটি লাশ স্ট্রেচারে পড়ে আছে। বাজারে থালায় যেভাবে মরা মাছ পড়ে থাকে। মেহমুদ একটি লাশের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে লাশের গায়ের ওপরে থাকা ময়লা-ছেঁড়া কাপড়টি সরালেন। কাপড়টি সরাতেই হু-হু করে উঠলো ওয়ালীউল্লাহর বুক! এই তো কায়েস! এই আমার কলিজার টুকরো! লাশের সারা গায়ে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের আস্তর। রক্তের সঙ্গে ধুলোবালি মিশে আছে। মুখের দিকে তাকানোই যায় না! চোখের গর্ত রক্ত দিয়ে পূর্ণ হয়ে আছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলেন ওয়ালীউল্লাহ। এতোক্ষণ তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছিল মেহমুদ। জানতে চাইলো,
– ইসে পহচানতে হ্যা আপ?
– জি নহিঁ। জোর দিয়ে অস্বীকার করলেন ওয়ালীউল্লাহ।
তার মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড স্থির চেয়ে রইলো মেহমুদ। তারপর আবার বললো,
– ওয়ালী সাব, আপ শিউর হ্যা?
ওয়ালীউল্লাহ একই উত্তরের পুনরাবৃত্তি করলেন।
আবারো কিছুক্ষণ ওয়ালীউল্লাহর দিকে তাকিয়ে থাকলো তরুণ কর্নেল। পরে ‘চলিয়ে’ বলে লাশকাটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ওয়ালীউল্লাহ তার পেছনে পেছনে বাইরে চলে এলেন। মেহমুদ বললো, ‘আপ লোগ যা সকতে হ্যা।’ যাওয়ার অনুমতি দিয়ে সে আর দেরি করলো না। হাসপাতালের লম্বা প্যাসেজ ধরে হাঁটা শুরু করলো।
– হুজুর সুনিয়ে? ওয়ালীউল্লাহ পেছন থেকে ডাকলেন। ডাক আশা করেনি মেহমুদ। সে ফিরে তাকালো, কিছু বললো না। ওয়ালীউল্লাহই বললেন, অজ্ঞাত লাশ দাফনের কাজ পৌরসভার। মেহমুদ যদি অনুমতি দেয় তাহলে এই অজ্ঞাত লাশটির দাফনের কাজ পৌরসভা করতে পারে।
কর্নেল মেহমুদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। কী যেন ভাবলো। তারপর ওয়ালীউল্লাহকে অবাক করে দিয়ে বললো,
– আপ কি মর্জি। আপ চাহে তো কর সকতে হ্যা। বলেই বুটের তীক্ষন শব্দ চারপাশে ছড়িয়ে দিতে দিতে সে চলে গেল। ওয়ালীউল্লাহ তার যাওয়া দেখছে, মেহমুদ ছোট হতে হতে প্যাসেজের শেষ বিন্দুতে মিলিয়ে যেতেই ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লেন তিনি। লাশকাটা ঘরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে উঁচু সিলিংয়ের দিতে তাকিয়ে রইলেন। হামিম এসে বাবার পাশে বসলো। সে জানতে চাইলো,
– আববা, ভিতরে কি ভাইয়ার লাশ …? ওয়ালীউল্লাহ সরাসরি উত্তর না দিয়ে হামিমের মাথাটা টেনে নিজের বুকে লাগালেন। হামিমের আর কিছু বুঝতে বাকি থাকলো না। বাবার বুকে মুখ রেখেই সে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। ওয়ালীউল্লাহ তাকে চুপ করতে বলেন এবং কান্নার শব্দ যেন কেউ শুনতে না পায় সেজন্য হামিমের মাথাটি আরো শক্ত করে নিজের বুকে চেপে রাখেন।
ভোরের সূর্য ফুটেছে। কিন্তু কোনো পাখি ডাকছে না, কুকুরেরও সাড়াশব্দ নেই। মানুষ নেই, কবর আর কবর। নরম আলো এসে পড়ছে ওয়ালীউল্লাহর মুখে। তার মুখ যেন পাথরে খোদাই করা ভাস্কর্য। কায়েসের দাফনকাজ শেষ। শ্রমিকেরা কবর ঘিরে ছোট বেড়াও করে দিয়েছে। কবরের একদিকে বসে এখনো কাঁদছে হামিম। ওয়ালীউল্লাহ এবার উঠলেন। এগিয়ে গেলেন কাঁচা কবরটির দিকে। দুই কদম হেঁটেই তার মনে হলো কতশত মাইল পথ যেন তিনি হেঁটেছেন, কতশত মাইল পথ যেন এখনো বাকি। কয়েক কদম দূরে কবর, কিন্তু মনে হচ্ছে যোজন যোজন দূরে। কবরের কাছে পৌঁছে তিনি আবার বসে পড়েন। কবরের মাথার দিকটায় হাত বোলান। যেভাবে কায়েসের মাথায় হাত বুলাতেন তিনি। এবার হামিমও বাবার চোখের অশ্রম্ন দেখলো। টপটপ করে অশ্রম্ন ঝরছে। আলোয় চারদিক পরিষ্কার হচ্ছে। ওয়ালীউল্লাহ উঠে দাঁড়ালেন এবং মোনাজাত ধরলেন। হামিম ও দুই শ্রমিকও তার পাশে দাঁড়িয়ে মোনাজাত ধরলো। নিঃশব্দ মোনাজাতে ওয়ালীউল্লাহ তার খোদার কাছে কী চাইলেন তা কারো জানা হলো না। মোনাজাত শেষে হামিমকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলেন তিনি।