লিখেছেন এ কে এম জামীর উদ্দীন
সময়টা শুক্রবার রাত। ২০০৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। আমার এখনও সেইসব প্রহরগুলো স্পষ্ট মনে আছে। প্রচণ্ড অস্থিরতায় ভুগছি। ওই দিন অফিসে থাকার সময় বুঝতে পারছিলাম ভয়ঙ্কর কিছু হতে যাচ্ছে। কারণ, আমাদের প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে কমেছে। সবকিছু বোঝার পরও আমার স্বপ্নের কর্মস্থল যে আর থাকবে না তা মানতে পারছিলাম না। নিজ অফিসের সর্বশেষ খবর জানার জন্য রাতভর গণমাধ্যমের খবরগুলোতে চোখ রাখছিলাম। সহকর্মীদের মোবাইল ফোনে ম্যাসেজ পাঠাচ্ছি, আমাদের ভবিষ্যৎ কি তা অনুধাবন করার জন্য। শনিবার ও রোববারের সাপ্তাহিক ছুটি শেষ হওয়ার পর অফিসে গিয়ে বুঝলাম, সব শেষ হয়ে গেছে।
লেম্যান ব্রাদার্সের কর্মী নাতালিয়া রোগোফ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এভাবেই নিজের নির্মম অভিজ্ঞতাগুলো তুলে ধরেছেন ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির কাছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চতুর্থ বৃহৎ বিনিয়োগকারী ব্যাংক লেম্যান ব্রাদার্স ২০০৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে। ওই সময় ব্যাংকটির ঋণ ও আমানতের পরিমাণ ছিল এক হাজার ২৫৮ বিলিয়ন ডলার। এর আগের বছর ব্যাংকটির নিট আয় ছিল চার দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ৩৫ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা। ১৮৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া কোম্পানিটিতে কাজ করতেন ২৫ হাজারের বেশি কর্মী। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৩০-এর মহামন্দার ঝড় সামাল দিয়েও প্রতিষ্ঠানটি টিকে ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালের মন্দায় সে আর দাঁড়াতে পারেনি।
শুধু লেম্যান ব্রাদার্স নয়, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার শত শত ব্যাংক ওই মন্দায় বন্ধ হয়ে যায়। সংকট শুরু হওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ এসব ব্যাংকগুলোকে মূলধন বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছিল। কিন্তু, এতে কর্ণপাত করেনি তারা। উল্টো দাবি করেছিল, ‘আমরা চমৎকার আছি, এর কোনো দরকার নাই। আমাদের ব্যালেন্স শিট পাথরের মতো শক্ত।’
মন্দায় কেন সঙ্কটে পড়ে ব্যাংক? কোনো একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে এটা বোঝার জন্য। মন্দার সময় মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। ফলে ওই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য কেউ কেনে না। এতে প্রতিষ্ঠানটি শ্রমিকদের ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়। একইসঙ্গে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে প্রতিষ্ঠানটির মালিক। কারখানা ও গুদামের মাসিক ভাড়া দেওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে প্রতিষ্ঠানটির মালিক। অন্যদিকে দেখা যায় স্থাপনার মালিক বা বাড়িওয়ালাও ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ওই ভবন তৈরি করেছিল। যেহেতু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক বা ভাড়াটিয়া ভাড়া দিতে অক্ষম, ফলে বাড়িওয়ালাও আর ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না। কিন্তু, আমানতকারীদের স্থায়ী সঞ্চয়ের (ফিক্সড ডিপোজিট স্কিম) বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে মাসিক মুনাফা দিতে হয়। এতে বড় রকমের সঙ্কটে পড়তে হয় ব্যাংকগুলোকে।
করোনাভাইরাসের বিস্তৃতির জের ধরে ইতিমধ্যে নতুন করে আরেকটি অর্থনৈতিক মন্দা দুনিয়া জুড়ে শুরু হয়েছে। ২০০৮ সালের মন্দার শিক্ষা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো শুরু থেকেই সতর্ক। সংকট এড়াতে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সদস্যভুক্ত দেশের ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছে। গতবছর ব্যাংকগুলো যে লাভ করেছে এর কোনো ভাগ (ডিভিডেন্ড) আপাতত তাদের পরিচালক বা বিনিয়োগকারীদের দেবে না। এর মাধ্যমে বাড়ানো হবে মূলধন।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের মিনেপলিস (যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা রাজ্যের একটি অঞ্চল) ব্রাঞ্চের প্রধান নির্বাহী নিল কাশকারি ১৬ এপ্রিল ব্রিটিশ গণমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে একটি প্রবন্ধ লিখেন। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোকে এখনই কমপক্ষে ২০০ বিলিয়ন ডলারের মূলধন জোগানোর জন্য তিনি আহ্বান জানিয়েছেন। এর মাধ্যমে চলমান মন্দার ঝড় সামাল দিতে পারবে ব্যাংকগুলো।
এখন পর্যন্ত আমরা ইউরোপ-আমেরিকার উদাহরণই টেনেছি। মন্দার ঢেউ আমাদের দেশেও উথলে পড়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই মন্দা মোকাবেলায় কতটুকু প্রস্তুত? প্রথমেই একটা বিষয় পরিষ্কার হতে হবে, তা হচ্ছে কোন পরিস্থিতিকে আমরা মন্দা বলবো। ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ডের (আইএমএফ) ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বৈশ্বিক জিডিপির প্রবৃদ্ধি দুই দশমিক পাঁচ শতাংশের নিচে গেলে তা মন্দা হিসেবে বিবেচিত হয়। সংস্থাটি বলছে, এই বছর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি তিন শতাংশ কমবে। যা গতবছর ছিল দুই দশমিক নয় শতাংশ।
মন্দা আঘাত হানায় চলতি বছর আমাদের দেশের জন্য আইএমএফের পূর্বাভাস হচ্ছে মাত্র দুই শতাংশ প্রবৃদ্ধি। অথচ গত কয়েক বছর ধরে আমাদের এই প্রবৃদ্ধি ছিল সাত শতাংশের উপরে। অর্থাৎ, মন্দার কবলে আমরাও পরছি।
মন্দার প্রথম দিকের আঘাত মোকাবিলার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব বর্তায় যেকোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর। কারণ, এই সময় অর্থনীতিকে গতিশীল রাখার জন্য টাকার যোগান দিতে হয় ব্যাপকভাবে। এর মাধ্যমে চাকরিহারা মানুষ নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মসূচির ওপর ভিত্তি করে সরকারকে নিতে হয় প্রণোদনা প্যাকেজ।
এসএমই, রপ্তানি, শিল্প ও সেবাসহ বিভিন্ন খাতের জন্য ইতিমধ্যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও এখন সংকটে। তারাও এই ধরনের সুবিধা চাইতে পারে। কিন্তু, ব্যাংকগুলোই তো অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে প্রধান ভূমিকা পালন করে। সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য তাদেরকে যদি এখনই প্রস্তুত করা যায়, তাহলে তাদেরকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার প্রয়োজন হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদন পাওয়া তফসিলি ব্যাংকের সংখ্যা এখন ৫৯। ব্যাংক খাতের সক্ষমতা বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জরুরি ভিত্তিতে কিছু ব্যবস্থা এখনই নেওয়া উচিৎ।
ব্যাংকগুলো ২০১৯ সালের মুনাফা থেকে কোনো ডিভিডেন্ড আপাতত তাদের পরিচালক বা বিনিয়োগকারীদের যাতে দিতে না পারে এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শিগগির ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ। এর মাধ্যমে অন্তত তিন হাজার কোটি টাকা আপদকালীন মুহূর্তের জন্য ব্যাংকগুলো মূলধন হিসেবে রাখতে পারবে। পাশাপাশি ব্যাংক উদ্যোক্তারা যাতে আরও মূলধন যোগান দিতে পারে সেজন্য তাদের প্রস্তুত করতে হবে।
ব্যাংকের জনপ্রতি পরিচালক এককালীন হয়তো ৩০ বা ৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু প্রতিবছর ডিভিডেন্ড নেওয়ার মাধ্যমে মূল বিনিয়োগের অনেকগুণ বেশি মুনাফা ইতিমধ্যে তারা ভোগ করেছেন। ডিভিডেন্ড বন্ধ করে দেওয়ার এই কাজটি বেশ কঠিন। কেননা ব্যাংকের পরিচালকরা এতোটাই শক্তিশালী, নিজেদের স্বার্থে তারা সরকারকে চাপ দিয়ে ইতিপূর্বে খোদ ব্যাংক কোম্পানি আইন পর্যন্ত সংশোধন করিয়েছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সেই কঠিন কাজটি এবার করতে হবে। কারণ আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ গত ১৪ এপ্রিল ওয়াশিংটনে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ১৯৩০-এর মহামন্দার পর এবারের সংকট সবচেয়ে ভয়ংকর।
ডিভিডেন্ড না দেওয়ার ব্যাপারে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) থেকেও আমরা উদাহরণ টানতে পারি। কারণ, দেশটি ইতিমধ্যে সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মনিটরি পলিসি করার সময় ভারতের মূল্যস্ফীতি বা প্রবৃদ্ধি বিষয়গুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে। সুতরাং মন্দা নিয়ে তাদের গৃহীত ব্যবস্থাগুলো বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।
ভারতের নরেন্দ্র মোদী সরকার এখনও শিল্প ও সেবা খাতের জন্য প্রণোদনা নিয়ে হাজির হয়নি। কারণ, তাদের প্রস্তুতি পর্ব শেষ হয়নি। কিন্তু আরবিআই একদিকে নিজেকে যেমন প্রস্তুত করে ফেলেছে, তেমনি ব্যাংকগুলোর সক্ষমতাও বাড়াচ্ছে। যাতে অর্থনৈতিক মন্দার ঝড় সামাল দেওয়া যায়। একইসঙ্গে সরকারের অর্থনৈতিক প্যাকেজও বাস্তবায়ন করা যায়।
১৯ মার্চ থেকে আরবিআই-এর ১৫০ জন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাকে সম্পূর্ণ আলাদা করে একটি হোটেলে রাখা হয়েছে। তাদের জন্য খাবার প্রস্ততকারকসহ অন্যান্য সেবায় নিয়োজিতরাও বাইরের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, এসব কর্মকর্তাদের করোনাভাইরাস মুক্ত রাখা। যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে আর্থিক খাত নিরবিচ্ছিন্নভাবে চালু রাখার মতো ব্যবস্থা তারা নিতে পারবেন।
কিন্তু আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনও এ ধরনের কোনো উদ্যোগই নেয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরি পলিসি, পেমেন্ট সিস্টেমস বা ব্যাংকিং নীতি ও প্রবিধি বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন, তাহলে আর্থিক খাতের পরিস্থিতি সঙ্কটাপন্ন হয়ে উঠতে পারে।
গত ২৭ মার্চ আরবিআই-এর গভর্নর শক্তিকান্ত দাশ গণমাধ্যমের সামনে মন্দা মোকাবিলায় তিন লাখ ৭৪ হাজার কোটি রুপি ব্যাংকগুলোকে সরবরাহ করার ঘোষণা দিয়েছেন।
ভারতীয় ব্যাংকগুলোর ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) ১০০ শতাংশীয় পয়েন্ট কমিয়ে তিন শতাংশ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে এক লাখ ৩৭ হাজার কোটি রুপি বাজারে সরবরাহ করা হবে।
আমানতকারীদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য মোট আমানতের একটা অংশ নগদ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখার পদ্ধতিকে সিআরআর বলা হয়।
লং টার্ম বা দীর্ঘমেয়াদী রেপো কার্যক্রমের (এলটিআরও) মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হবে আরও এক লাখ কোটি রুপি। এই অর্থ ফেরত দেওয়ার মেয়াদ সর্বোচ্চ তিন বছর। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নগদ অর্থের সংকট মেটাতে রেপো কার্যক্রমের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ধার দেয়।
এর বাইরে মার্জিনাল স্ট্যান্ডিং ফ্যাসিলিটির (এমএসএফ) মাধ্যমে সরবরাহ করা হবে আরও এক লাখ ৩৭ হাজার কোটি রুপি।
সিআরআরের পাশাপাশি আমানতকারীদের নিরাপত্তার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তাদের কাছে জমা টাকার একটি অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখতে হয়। এই পদ্ধতিকে এসএলআর বলা হয়। আর তা সংরক্ষণ করতে হয় সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ড কেনার মাধ্যমে।
গত ১৮ এপ্রিল শক্তিকান্ত আবারও গণমাধ্যমের সামনে হাজির হয়েছেন নতুন প্যাকেজ নিয়ে। এবার সেখানকার শ্যাডো ব্যাংকগুলোকে রক্ষার জন্য ৫০ হাজার কোটি রুপির এলটিআরও ঘোষণা করেছেন। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যেভাবে মনিটরিং করা হয় শ্যাডো ব্যাংকগুলোর ওপর আরবিআই-এর সেরকম নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু ভারতীয় অর্থনীতিকে গতিশীল রাখার ক্ষেত্রে এদের অবদান খুব একটা কমও নয়।
বাজারে টাকা সরবরাহ বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া এখন পর্যন্ত প্রধান ব্যবস্থা হচ্ছে সিআরআর এক দশমিক পাঁচ শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে চার শতাংশ করা। এর মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়েছে ১৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
মন্দা মোকাবিলায় সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রণোদনা ইতিমধ্যে ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে এর পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা পর্যন্ত গড়াতে পারে।
চলতি বছর সরকারের রাজস্ব আহরণ এমনিতেই কম। সাধারণত বছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) সরকার রাজস্ব সংগ্রহের জন্য বড় রকমের কর্মসূচি হাতে নেয়। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এবার তা করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া যারা কর দিবে তারাও তো সংকটে। ফলে রাজস্ব আহরণে এবার ধ্বস নামবে। খরচ মেটানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে সরকারকে।
উপায় ও উপকরণ আগাম পদ্ধতি ব্যবহার করে সরকার ঋণ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। নিয়ম অনুযায়ী আমাদের সরকার সর্বোচ্চ ৬ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারে এই পদ্ধতিতে। আরবিআই ইতিমধ্যে ঋণের এই সীমা অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসের জন্য এক লাখ ২০ হাজার কোটি রুপি করেছে, যা গতবছরের একই সময় ছিল ৭৫ হাজার কোটি রুপি।
মন্দা মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যাপক অর্থ সরবরাহ করতে হবে বাজারে। কিন্তু এই অর্থের কীভাবে সংস্থান হবে তা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কি পরিকল্পনা, তা এখনও জানে না সবাই। এখন পর্যন্ত সরকারি ঘোষণার বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটার পর একটা প্রজ্ঞাপন জারি করে যাচ্ছে। অথচ সরকারের ঘোষণার আগেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মসূচি আসা উচিৎ ছিল। আর এতে ঘোষণা থাকতে পারতো সুনির্দিষ্টভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সরকারকে কতো টাকা জোগান দেওয়া হবে। আরবিআইসহ বিশ্বের অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিন্তু তা-ই করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কারো আজ্ঞাবাহী প্রতিষ্ঠান না। এটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান।
কৃষি, রপ্তানি খাত এবং হতদরিদ্র মানুষের কাছে ঋণ সরবরাহ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু এগুলো যথেষ্ট নয়।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এখন সর্বোচ্চ ২৮ দিনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপোর মাধ্যমে ঋণ সুবিধা পায়। কিন্তু সরকারের অধিকাংশ আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় যে ঋণ কর্মসূচি, তার মেয়াদ কমপক্ষে এক বছর বা তার বেশি। ফলে ব্যাংকগুলোর দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দরকার। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো এখানে তিন বছর মেয়াদী এলটিআরও-এর মতো কোনো কর্মসূচি নেওয়া যায় কিনা তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভেবে দেখা উচিৎ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কিছু কর্মকর্তা এখন রাত-দিন পরিশ্রম করছেন সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রজ্ঞাপন প্রণয়নের জন্য। কিন্তু বড় সমস্যা হচ্ছে সমন্বয়হীনতা। মন্দা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য মনিটরি পলিসিসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোর মেধাবী কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে একটা টিম করা উচিৎ ছিল। এর মাধ্যমে আর্থিক খাতের ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করার পাশাপাশি উদ্ভাবনী প্যাকেজ নিয়ে হাজির হতে পারতো এই টিম। আরবিআই-এর মতো আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হয়তো খুব বেশি বিশেষজ্ঞ নাই। কিন্তু যা আছে তাও কম নয়। মন্দা মোকাবিলায় তাদের যথাযথভাবে কাজে লাগানো উচিৎ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের উচিৎ গণমাধ্যমের সামনে এসে শিগগির জাতির সামনে বক্তব্য দেওয়া। যেভাবে শক্তিকান্ত ভারতীয়দের সামনে এরই মধ্যে দুবার এসেছেন। ফজলে কবিরের বক্তব্যে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ থাকা উচিৎ কোন খাত থেকে কীভাবে সরকার ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকার জোগান দিবে। এতে করে এই দুর্দিনে মানুষ আরও আশ্বস্ত ও আত্মবিশ্বাসী হবে।
লেখক: সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার