করোনা প্রলয় প্রথম যখন নেমে আসে, নিউইয়র্ক নগর তখন অনেকটাই অপ্রস্তুত। করোনাভাইরাসের বিপদকে শুরুতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের নেতারা পাত্তা দেননি। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে বাস্তবতার মুখোমুখি হলেও দ্রুত কোন সিদ্ধান্ত নেননি। স্কুল খোলা থাকবে কি না, এ নিয়েও সিদ্ধান্ত আসতে দেরি হয়েছে। মধ্য মার্চ থেকে পরিস্থিতি নাজুক হয়ে ওঠে। কোনো কিছু বোঝার আগেই বিশ্বের সবচেয়ে কোলাহলের নগর নিউইয়র্ক মৃত্যুপুরীর রূপ ধারণ করে। শুরুর ধাক্কায় আক্রান্ত হন নগরের সম্মুখসারির পেশার বেশ কিছু মানুষ। এই পেশায় যেমন রয়েছে চিকিৎসক–নার্স, তেমনি পুলিশ–ট্রাফিক পুলিশসহ নানা পেশার মানুষ। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময় নিউইয়র্ক পুলিশের ট্রাফিক বিভাগে বাংলাদেশিরা বেশ দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন।
নিউইয়র্ক নগরের তিন হাজার ট্রাফিক এজেন্টের মধ্যে বাংলাদেশি আমেরিকানের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। অথচ বলা হয়, বহু জাতিগোষ্ঠীর এই নগরে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিনের সংখ্যা এখনো মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশেরও কম। তবে নিউইয়র্কের ট্রাফিক বিভাগের প্রায় ১৫ শতাংশই এখন বাংলাদেশি। পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রতিবছরই যোগ দিচ্ছেন নতুন নতুন বাংলাদেশি আমেরিকান।
কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার মধ্যেও রোদ–বৃষ্টি উপেক্ষা করে ট্রাফিক পুলিশ শৃঙ্খলায় রেখেছেন নগরের ট্রাফিক ব্যবস্থা। কিছু বোঝার আগেই আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। তাদের অজান্তেই ভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে পরিবার–পরিজন ও কমিউনিটিতে।নিউইয়র্ক ট্রাফিক বিভাগ ২০ এপ্রিল পর্যন্ত হারিয়েছে তাদের সাত সদস্যকে। অন্যদিকে, এনওয়াইপিডি হারিয়েছে তাদের ২৯ জন চৌকস অফিসার।
নিউইয়র্ক ট্রাফিক বিভাগের বাংলাদেশি আমেরিকানরা করোনায় ইতিমধ্যে হারিয়েছে তাদের পিতৃসম মোহাম্মদ চৌধুরীকে। নগরের তৃতীয় শীর্ষ পদে জীবনের উজ্জ্বল ৩০টি বছর কাজ করেছেন বাংলাদেশ থেকে আসা এই অভিবাসী।
ট্রাফিক বিভাগের রয়েছে শক্ত ইউনিয়ন। কমিউনিকেশন ওয়ার্কার অব আমেরিকা (সিডব্লিউএ) লোকাল ১১৮২ নামের এ ইউনিয়ন রাজ্যের এসব কর্মজীবীর শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে পরিচিত।
লকডাউনে নগরের অন্যতম জরুরি এই বিভাগের ইউনিয়নের প্রশাসক রিকি মরিসন ও অন্যতম নির্বাচিত নেতা সৈয়দ উতবার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। মোহাম্মদ চৌধুরীর মৃত্যুতে শোকবিহ্বল এই ইউনিয়ন নেতারা জানালেন নিজেদের কর্মীদের নিরাপত্তা ও সর্বশেষ খোঁজখবর।
সৈয়দ উতবা (৩৮) সুনামগঞ্জের ছেলে। ছয় বছর ধরে নিউইয়র্কের ট্রাফিক বিভাগে কাজ করছেন। দুই বছর ধরে নির্বাচিত নেতা। কঠিন এই সংকটকালে বাংলাদেশি আমেরিকান ট্রাফিক পুলিশ ও তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বাংলাদেশি ট্রাফিক এজেন্টদের প্রিয় এই কর্মকর্তা বলেন, শুরুতে গ্লাভস বা মাস্ক ছাড়াই ট্রাফিক এজেন্টদের কাজ করতে হয়েছে। এতে শুরুতে বেশ বিপর্যয় ঘটে গেছে। অনেকে নিজের অজান্তে আক্রান্ত হয়েছেন, ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে তাদের ঘরেও। শতাধিক বাংলাদেশি ট্রাফিক এজেন্ট করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে তিনি মনে করেন। অনেকেই সেরে উঠেছেন। অনেকেই সেরে উঠার লড়াই করছেন। পরিবার ও স্বজনের মৃত্যুর মত দুঃখজনক ঘটনাও ঘটেছে।
লকডাউনের নগরে নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে রেখে কাজ করে যাচ্ছেন সৈয়দ উতবা। জানালেন, লকডাউন শুরু হলেও ট্রাফিক এজেন্টদের কাছে কোনো নির্দেশনা ছিল না। লোকজন কাজে গেছেন। ইউনিয়নের পক্ষ থেকে দ্রুত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। করোনায় ঝুঁকিতে পড়তে পারেন—এমন এজেন্টদের ঘর থেকে কাজ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সড়কে কাজ করা এজেন্টদের গ্লাভস, মাস্ক ও সেনিটাইজেশন সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়।
সৈয়দ উতবার কাছ থেকে জানা গেল ভিন্ন সমস্যার কথা। বললেন, যারা শুরুতেই আক্রান্ত হয়েছেন, যারা ঘরে সুস্থ হওয়ার সংগ্রাম করছেন—এমন কোন কোন এজেন্টের পরিবারের অন্য সদস্যরাও সংক্রমণের শিকার হয়েছেন। এখনো হচ্ছে। এসব লোকজনের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার লোকজনের সংকট দেখা দেয়। দিনে–রাতে নিজে এসব অনেক স্বদেশির বাসায় গিয়ে খাদ্যসহ নানা সাহায্য পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি। ইউনিয়নের সংগ্রহ করা এন-৯৫ মাস্ক, গ্লাভস পৌঁছে দিচ্ছেন।
ব্রঙ্কসে বসবাসরত করোনায় আক্রান্ত এক বাংলাদেশি ট্রাফিক এজেন্ট জানালেন, এমন কঠিন সময় কখনো আসবে মনে হয়নি। এই নগরে অনেক আত্মীয়স্বজন থাকলেও সংকটের সময় কেউ আসতে পারছে না। একজন সৈয়দ উতবা নিজের ও পরিবারকে ঝুঁকিতে ফেলে ছুটে এসেছেন খাবার নিয়ে। অন্যান্য অপরিহার্য সামগ্রী নিয়ে।
স্ত্রী ও ঘরে থাকা চার সন্তান নিয়ে নগরীর ব্রঙ্কসে থাকেন উতবা। আশপাশে লোকজন মারা যাচ্ছে। একের পর এক পরিচিত লোকজন মারা যাচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্স আর সাইরেনের আওয়াজে ভীতিকর সময়েও উতবা ছুটে যাচ্ছেন বিপদাপন্ন সহকর্মীর প্রয়োজনে। এভাবেই করোনা–যুদ্ধে একজন সাধারণ জরুরি কর্মজীবীও অসাধারণ হয়ে ওঠেন। প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই আমার কাজ। সতীর্থ সহকর্মীদের বিপদের সময়ে নিজের ও পরিবারে চিন্তা আসে ঠিকই। কিন্তু এই চিন্তা নিজের এগিয়ে যাওয়াকে থামাতে পারে না।’
জ্যাকসন হাইটসের পথে গাড়ি চালাতে চালাতে সৈয়দ উতবা ফোনে আনিসুল হকের কবিতা থেকে আবৃত্তি করে শোনালেন—
জানি, মানুষ পরাজিত হবে না।
জানি, মানুষ অনেক মৃত্যুর দামে কিনে নেবে জীবন।
আবার জন্মাবে মানুষ। আবার মানুষ মানুষের কাছে আসবে।
আবার মানুষ মানুষকে বুকে টেনে নেবে।
ট্রাফিক ইউনিয়নের প্রশাসক রিকি মরিসন প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো ট্রাফিক এজেন্ট বা তাদের পরিবার প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন। তারা সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছেন। এরপরও যেকোনো বাস্তবতায় তাদের সঙ্গে যেন যোগাযোগ করা হয়—প্রথম আলোর মাধ্যমে এই আহ্বান জানালেন তিনি।
তথ্য সূত্র: প্রথম আলো