ডঃ শোয়েব সাঈদ
মন্ট্রিয়ল, গত মাঝরাতে জানতে পারলাম মন্ট্রিয়লের বাসিন্দা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের একই পাড়ার এক ছোট ভাইয়ের স্ত্রী করোনায় আক্রান্ত। দুইদিন আগেই ওর সাথে কথা হল, সব ঠিকঠাক ছিল। ভাবলাম সকালে উঠেই কথা বলব। করোনাতাড়িত আমাদের প্রতি দিনকার রুটিন হচ্ছে নিউ ইয়র্ক বা টরেন্টো বা দেশে পরিচিত কারো না কারো করোনাজনিত বা অন্য কোন কারণে মৃত্যু সংবাদে একটু একটু করে সংকোচিত হওয়া। গতরাতেই বাকসু ‘র সাবেক ভিপি টরেন্টো অভিবাসী ফায়েজুল ভাই আর মন্ট্রিয়লের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সেলিম জুবেরি’র সাথে কথা হচ্ছিল করোনায় টরেন্টোর মুরব্বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট সালাম সাহেবের চলে যাওয়া নিয়ে। সকালে উঠে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের সেই ছোট ভাইটির সাথে কথা বলার আগেই চোখে পড়ল এক জানাজায় হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি। জানাজায় লাখো মানুষের উপস্থিতি বাংলাদেশে কমন চিত্র। কিন্তু লকডাউনের এই দুঃসময়ে চমকে উঠে থমকে যেতে হল। আঁতকে উঠে অনেকবারই থমকে যেতে হয়েছিল রাজধানীর কাওরান বাজারের মনুষ্য ব্যস্ততা দেখে। ভাবছিলাম একই সমস্যায় স্থানভেদে মানুষের চিন্তা, চেতনায়, প্রতিক্রিয়ায় কতোনা বৈপরিত্য। যে দেশে দু কোটি মানুষের দিনের আয় দিনেই ব্যয় করতে হয়, সেভিংস থাকেনা, তাঁদের চলার পথ হয়তোবা একটু বেপরোয়া, কিন্তু বিপদটা তো সেখানে যখন বেপরোয়ার পরিণতিতে বিপর্যয় আমন্ত্রিত। কোভিড-১৯ এর আঘাতে বিশ্বময় এখানে সেখানে ঝরে পড়া জীবনের পরাজয় দেখে আর বাংলাদেশে সরকারের নির্দেশ অমান্যের উৎসব দেখে ভয় হচ্ছিল মানবতা, মানুষ আর ধর্মকে একসাথে হৃদয় দিয়ে ধারণ করাতে আমাদের অক্ষমতার পরিণতি নিয়ে। জন্মশহর/জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেংচি কাটার হিড়িক দেখে এই বিষয়টি নিয়ে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। জাতির এই ক্লান্তি লগ্নে, বৈশ্বিক এই সংকটে ধর্মের তীর্থ কেন্দ্রগুলো যেখানে বিরানভুমি, সেখানে এই ভেংচি কিংবা ক্ষোভের বিপক্ষে বলার তো কিছু নেই।
যাক ফিরে আসি মন্ট্রিয়লে পাড়ার ছোট ভাইটির স্ত্রীর বিষয়ে। করোনা আক্রান্ত বউকে একরুমে আইসোলেশনে রেখে অন্যরুমে বাচ্চারা সহ তাঁর অবস্থান। পুরো পরিবার যেহেতু কোয়ারেন্টাইনে আছে, ফোন দিয়ে জানতে চাইলাম এই মুহূর্তে তাদের কি কি লাগবে? এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবারের অন্য সবার সংক্রমণের হাত থেকে বেঁচে থাকা আর করোনা আক্রান্ত মানুষটির সেরে উঠা। বাসাটি নির্ভুলভাবে জীবাণুমুক্ত রাখার কিছু প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিসহ কিছু কেনাকাটা করে চলে গেলাম ওর বাসায়। জিনিসগুলো দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে থেকে ফোনে খোঁজখবর, কথোপকথন সেরে ফিরে এলাম। প্রজন্মের এই ক্রান্তিকালে বিপদটি যারা স্পর্শ করে ফেলেছেন তাঁদের অনুভব আর যারা এখনো স্পর্শ করেনটি তাঁদের অনুভবে আকাশ পাতাল ফারাক। সরকারের নির্দেশ মেনে বাসায় থাকা এই ভাবীটির আক্রান্ত হবার তেমন কোন কারণ ছিলনা, একবার শুধু একজন প্লামার বাসায় এসেছিল কাজ করতে, উনি প্লামারের কাছাকাছি থেকে এটা সেটা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। সুতরাং বুঝতেই পারছেন আক্রান্ত হবার কতো চোরাগলি এখানে সেখানে লুকিয়ে আছে আমরা যা ধারনাও করতে পারি না। লক ডাউনের মত পরিস্থিতিতে অনেকদিন পর মন্ট্রিয়লে কিছুক্ষণ ড্রাইভ করলাম। বছর দশেক হল এই শহরে। কানাডার দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শহরটিকে বলা হয় উৎসবের শহর; আইস হকি, জাজ উৎসব, ফর্মুলা ওয়ান রেস, সার্কাসের এই শহরটি মূলত ইউরোপীয় ধাঁচের। সামারের পুরো সময়টিতে শহরটি থাকে উৎসবের সাঁঝে। উৎসব আর মেলা বসে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কজুড়ে। অথচ এখন এটি একটি মৃত নগরী, প্রয়োজন ছাড়া রাস্তায় গাড়ীও তেমন নেই। মানুষজন যার যার বাসায় কিন্তু বাসার সামনে কোন কোলাহল নেই, সুনসান নীরবতা চারিদিকে, পার্কগুলো জনমানব শুন্য। মনে হচ্ছিল ভাইরাস নিয়ে দেখা মুভিগুলোর নিষ্প্রাণ একটি শহর এটি। দোকানপাট থেকে শুরু করে সর্বত্রই সরকারের নির্দেশ মেনে চলার সহজাত প্রবৃত্তি। মন্ট্রিয়ল চার্চের শহর, শত শত চার্চের সমাহার। না, এই জরুরী অবস্থায় সরকারের নির্দেশ অমান্যের কথা কোন চার্চ চিন্তাও করতে পারেনা। আমার বাসার কাছেই, শিখদের স্বর্ণ মন্দির স্টাইলের গুরুদোয়ারা। বিশাল এই কমপ্লেক্স এখন প্রার্থনার জন্যে বন্ধ, শুধু দিনরাত মানুষের জন্যে খাবার তৈরি আর যাদের প্রয়োজন নিরাপদে তাঁদের কাছে পৌঁছে দেবার ব্যস্ততা। ধর্ম এখানে মানবতায় বিলীন।
আজ সকালেই চোখ পড়ল সিএনএনের একটি খবরে। নিউ ইয়র্কে একজন বাংলাদেশী ট্যাক্সি ড্রাইভারের করোনায় মৃত্যু আর হার্ভাডে অধ্যয়নরত তাঁর সন্তানের উপর বিস্তারিত এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে মানুষের গল্প, মানবতার গল্প, একজন বাবার মাথা থেকে পায়ে ফেলা ঘামের প্রতি বিন্দুতে সৃষ্ট তপস্যার গল্প। এই গল্প সন্তানকে শিক্ষার আলোতে উদ্ভাসিত করার গল্প আর গল্পের নায়ক মোহাম্মদ জাফর উঠে এসেছেন এমন এক সমাজ থেকে যে সমাজে এই ২০২০ সালেও তীর ধনুক আর চাপাতির লড়াইয়ে প্রতিপক্ষের কর্তিত পা নিয়ে আনন্দ মিছিল করা হয়, জাতীয় সংকটে রাষ্ট্রের আদেশ নির্দেশের তোয়াক্কা না করেই হাজার হাজার মানুষেকে বিপদের মুখে ফেলা হয়। মোহাম্মদ জাফর ভাগ্যান্বেষণে নিউ ইয়র্কে এসেছিলেন ১৯৯১ সালে। দেশে পিতামাতার প্রতি দায়িত্বপালন, বিয়ে এবং পরবর্তীতে তিন সন্তানের এই জনক কঠিন পরিশ্রমের এক পর্যায়ে হলুদ ক্যাব চালাতে শুরু করেন নিউ ইয়র্কে। সন্তানদের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর সব ব্যবস্থা করেন। হার্ভাডে অর্থনীতি আর ইতিহাসের ডাবল বিষয়ে অধ্যয়নরত ছেলে মাহতাবের পথ ধরে সাফল্যের একই পথে হাঁটছেন মেয়ে সাবিহা। ২০১৬ সালে মাহতাব সাবিহার মা ক্যান্সারে মারা যাবার পর মাহতাব আর সাবিহা তাঁদের আরেক ভাইকে নিয়ে আবারো হারালো প্রিয়জন; তাঁদের বাবাকে পহেলা এপ্রিলে করোনার করাল গ্রাসে। স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে জাফরের মত লাখ লাখ ইমিগ্রেন্ট, সন্তানদের পেছনে সাধ আর সাধ্যের সবটুকু ঢেলে দিয়ে। সন্তানদের মেধার আলোতে যুক্তরাষ্ট্র আলোকিত হলেও ভাগ্যের পরিহাসে সন্তানদের সাফল্যের শেষ হাসিটুকুতে তৃপ্ত হবার সুযোগ পাবার আগেই প্রিয় সন্তানদের এতিম করে এদের চলে যেতে হয় পরপারে। জাফরদের এই গল্প শুধু একজন মানুষের গল্প নয়, সমাজ আর সভ্যতা বিনির্মাণের গল্প যার ইমপ্যাক্ট বৈশ্বিক।