ভোরের আলো ডেস্ক:
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত খুনি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদ ফাঁসি কার্যকর হওয়ার আগে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। দীর্ঘ সময় ধরে গোয়েন্দাদের নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে ঘটনার আদ্যোপান্তসহ অনেক অজানা তথ্য। যেখানে এমন অনেক বিষয় আছে, যা আগে কোনোদিন কারও জানা ছিল না।
তার জিজ্ঞাসাবাদের পুরো বক্তব্য অডিও-ভিডিও আকারে ধারণ করা হয়েছে; যার ওপর ভিত্তি করে বিশেষ ডুকুমেন্টারি তৈরি করা হচ্ছে। তাকে গ্রেফতারের সঙ্গে প্রথম থেকে যুক্ত থাকা সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা জবানবন্দি নিয়ে বই লেখার কাজেও হাত দিয়েছেন।
এছাড়া খুনি মাজেদের বক্তব্য যাচাই-বাছাই করতে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ চলমান রয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রটি জানিয়েছে, পুরো প্রক্রিয়া শেষ হলে এটি জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে; যা হবে ইতিহাসের বড় একটি দলিল। ইতোমধ্যে সরকারের উচ্চপর্যায়কে সবিস্তারে জানানো হয়েছে।
সূত্র বলছে, জিজ্ঞাসাবাদে মাজেদ অভাবনীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরিকল্পনা থেকে পরবর্তী সময়গুলোর ধারাবাহিক বর্ণনা দেন মাজেদ। এমনকি পলাতক জীবনে বাংলাদেশ থেকে কারা কীভাবে তাকে সহায়তা দেয়াসহ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করেছেন, তাদের নাম-পরিচয়ও তিনি অকপটে স্বীকার করেন। তবে মাজেদের স্বীকারোক্তি ও জিজ্ঞাসাবাদ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত অতি গোপনীয় এবং স্পর্শকাতর হওয়ায় এখনই তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে না। অধিকতর যাচাই-বাছাইসহ আরও কিছু কাজ সম্পন্ন করার পর যথাসময়ে তা প্রকাশ করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জিজ্ঞাসাবাদ সংশ্লিষ্ট একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ১৫ আগস্ট কিলিং মিশন বাস্তবায়নের বহু আগে থেকেই আবদুল মাজেদ ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাতায়াত করতেন। সেরনিয়াবাদের ছোট ছেলে নাসেরের সঙ্গে বাড়ির লনে নিয়মিত ব্যাডমিন্টন খেলতেন। এ কারণে খুনি চক্র মাজেদকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি রেকি করার বিশেষ দায়িত্ব দেয়। ব্যাডমিন্টন খেলার ছলে তিনি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যসহ বাড়ির লোকজনের ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখতেন।
সূত্র আরো জানায়, মাজেদ মূলত ভারতে আত্মগোপনে থাকলেও বছরের বড় একটা সময় থাকতেন ইউরোপ-আমেরিকায়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়ো অঙ্গরাজ্যে ছেলের বাড়িতে তার দীর্ঘ সময় কাটে। আমেরিকায় বসবাসকারী মাজেদের ছেলের নাম রিফাত মোরশেদ চৌধুরী। তিনি সেখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণা করছেন। রিফাত চৌধুরী আমেরিকা যাওয়ার আগে বাংলাদেশ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (ইইই) স্নাতক ডিগ্রি নেন। কিন্তু বুয়েটে পড়াকালীন কেউই তার পিতার পরিচয় জানতে পারেননি। জার্মানি, ফ্রান্স ও লিবিয়াতেও তিনি আত্মগোপনে ছিলেন দীর্ঘদিন।
সূত্র জানায়, মাজেদের চার মেয়ের মধ্যে একজন পেশায় চিকিৎসক। তিনি বর্তমানে ঢাকাতেই থাকেন। চাকরি করেন মিরপুরে একটি বেসরকারি সংস্থায়। তার স্বামীও ডাক্তার। কর্মরত আছেন মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতালে।
সূত্র জানায়, মাজেদ শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নয়, কারাগারে চার নেতা হত্যার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। এ দুটি ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডে তিনি সঙ্গী হিসেবে পান আরেক পলাতক খুনি রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনকে। বিদেশে আত্মগোপনে থাকার সময় রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের সঙ্গেও মাজেদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।
মাজেদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে মোসলেহ উদ্দিনের খোঁজে ব্যাপক অনুসন্ধান তৎপরতা চালাচ্ছেন গোয়েন্দারা। ইতোমধ্যে মোসলেহ উদ্দিনের পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের ছেলে সাজিদুল ইসলাম খান বর্তমানে নরসিংদীতে বসবাস করেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, বহু বছর ধরে পরিবারের সঙ্গে তার বাবার কোনো ধরনের যোগাযোগ নেই। তিনি বেঁচে আছেন কিনা তাও তারা জানেন না।
মাজেদের সন্ধান ও পরবর্তী গ্রেফতার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে বিষয়টির সঙ্গে শুরু থেকে সংশ্লিষ্ট একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের জুন-জুলাইয়ের দিকে ইউরোপের একটি দেশে তার (মাজেদ) অবস্থান শনাক্ত করা হয়। এরপর আমেরিকায় ছেলের বাড়িতে মাজেদের অবস্থানের বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত হন গোয়েন্দারা। মূলত আমেরিকা থেকেই তার ওপর নিবিড় নজরদারি শুরু হয়। এক পর্যায়ে ভারতের কলকাতায় তার অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হয়। এরপরই তাকে গ্রেফতারের জন্য কঠোর গোপনীয়তায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগ ও গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু হয়। ভারতের গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পরই কলকাতায় হাজির হয় বাংলাদেশের একটি চৌকস গোয়েন্দা প্রতিনিধি দল। তারাই মাজেদকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
সূত্র বলছে, মাজেদের গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে বই লেখা শেষ হলেই পুরো বিষয়টি প্রকাশ করা হবে। তখন বঙ্গবন্ধু হত্যকাণ্ডের অনেক অজানা চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা যাবে। মুখোশ উন্মোচিত হবে ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ডদের।
(ভোরের আলো/ফআ)