ভোরের আলো ডেষ্ক: নিউ ইয়র্ক এখন ভৌতিক নগরী। রাস্তাঘাটে মানুষ নেই। আছে ভীতি। অদৃশ্য এক ভাইরাস নিয়ে ভয়াবহ আতঙ্ক। রাস্তাঘাট ফাঁকা। ফুটপাত খাঁ খাঁ করছে। সড়কগুলো দেখলে মনে হয়, মৃত্যুদূত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর শোনা যায় সাইরেনের শব্দ।
যখন এই মহামারির শেষ হবে, তখন হয়তো কিছু চেনা মানুষ বেরিয়ে আসবেন, দেখা হবে আবার। আবার অনেক মানুষ আছেন, যাদেরকে আর কখনো দেখতে পাবেন না পরিচিতজন। শুধু নিউ ইয়র্কেই একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ মারা গেছেন। ২০০১ সালের ৯/১১ এর সন্ত্রাসী হামলায় এই শহর যে পরিমাণ মানুষকে হারিয়েছে তার কমপক্ষে চারগুন মানুষ মারা গেছেন এরই মধ্যে। তবে এবার যেসব মানুষ মারা গেছেন তাদেরকে শনাক্ত করা গেছে। এসব মৃত্যু পরিবারগুলোকে শোকসাগরে ভাসিয়ে গেছে। তাদের কাহিনী মানুষের কাছে জানানোর এক দায়িত্ব সাংবাদিকদের ওপর এসে বর্তায়।
এমন কাহিনীর একটি নাম মোহাম্মদ জাফর।
তিনি একজন বাংলাদেশি অভিবাসী। একজন পিতা। সন্তানদের সর্বোচ্চ শিক্ষা দেয়ার জন্য তিনি চালাতেন একটি হলুদ ক্যাব। মার্কিন স্বপ্ন পূরণের জন্য সব কিছু করার চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু গত ১লা এপ্রিল মারা যান জাফর। ব্রোঙ্কসের গান হিল রোডের কাছে একটি এপার্টমেন্টে তিন সন্তানকে করে গেছেন এতিম। তার চলে যাওয়া শুধুই একটি ট্রাজেডি। আপনি যদি নিউ ইয়র্কে গিয়ে থাকেন, তাহলে হয়তো তার ক্যাবে চড়ে থাকবেন। কিন্তু কখনো ভাবেননি গাড়ির ভিতরে সামনের দিকের গ্লাসে যে মানুষটিকে দেখা যাচ্ছে, তিনি কেমন। তিনি একজন দয়ালু মানুষ। মেয়ে ছাবিহা দ্বিতীয় গ্রেডে পড়ে। তাকে তিনি ম্যানহাটানের আপার ওয়েস্ট সাইডে অবস্থিত অভিজাত ট্রিনিটি স্কুলে নামিয়ে দিয়ে তবেই নিজের দিনের কাজ শুরু করতেন। তারপর সারাদিন গাড়ি চালাতেন। যখন মেয়ের ছুটি হতো, তাকে নিয়ে বাসায় ফিরতেন।
তার কঠোর কাজের এই ধারা প্রবাহিত হয়েছিল পরিবারের মধ্যে। তার ছেলে মাহতাব এখন অভিজাত হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি ও ইতিহাসের মতো ডাবল সাবজেক্টে পড়াশোনা করছেন। ভাই মাহতাবের পথ অনুসরণ করছিল ছাবিহা। পিতার সম্পর্কে মাহতাব শিহাব বলেছেন, তিনি সারাটা জীবন কাজ করেছেন। সবকিছু ত্যাগ করেছেন। তার কোনো চাকরি ছিল না। তিনি ম্যাকডোনাল্ডসে কাজ করেছেন। ডেলিভারিম্যান হিসেবে খাবার সরবরাহ দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি একজন ক্যাব চালক ছিলেন। কিন্তু সব সময়ই চেষ্টা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে এবং বাংলাদেশে তার পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজন মেটাতে। সবাই যেন সবকিছু ঠিকঠাক মতো পায়, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করতেন তিনি। এ জন্য তিনি বার বার নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিজন অভিবাসীর কাহিনী এই একই রকম। তাদের জীবনের পরিবর্তন একই রকম। তারা সবাই কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উন্নত জীবন গড়ে তোলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান। ভাবেন, তাদের সন্তানরা উন্নত জীবন পাবে। মোহাম্মদ জাফরের আমেরিকা কাহিনী শুরু হয়েছিল ১৯৯১ সালে। ওই সময় তিনি বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা পাড়ি জমান। কুইন্সে জ্যাকসন হাইটসে অন্য অভিবাসীদের সঙ্গে ঠাসাঠাসি করে একটি এপার্টমেন্টে বসবাস শুরু করেন। সেখানেই অর্থ জমা করতে থাকেন। দেশে পিতামাতার কাছে পাঠাতে থাকেন তা। এরপর ফিরে যান বাংলাদেশে। বিয়ে করেন মাহমুদা খাতুনকে। নিউ ইয়র্কে ফেরার আগেই তাদের প্রথম সন্তান মাহবুব রবিনের জন্ম হয়। ২০০০ সালে এলমহার্স্ট হাসপাতালে জন্ম হয় মাহতাব শিহাবের। এখন করোনা ভাইরাসের গ্রাউন্ড জিরো হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এই হাসপাতাল। মাহতাব বলেন, বাবা সব সময় এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করতেন যে, আমরা কেন যুক্তরাষ্ট্রে। এখানকার সুযোগ সুবিধাটুকু নিয়ে আমাদেরকে বড় মানুষ হতে হবে। আমাদের এ দেশটার প্রতি কতটুকু কৃতজ্ঞ হতে হবে।
মোহাম্মদ জাফরের সন্তানরা তাদের শিক্ষাজীবন শুরু করেন ব্রোঙ্কসে পিএস ৯৫ থেকে। তবে তিনি শুনতে পান ‘প্রিপ ফর প্রিপ’ নামে একটি অলাভজনক রিক্রুটমেন্ট চলছে। এর অধীনে নিউ ইয়র্ক সিটির কম আয়ের শিশুদের চমৎকার দক্ষতা অর্জনের জন্য কাজ করে, প্রস্তুত করে ব্যয়বহুল প্রাইভেট স্কুলের জন্য। তারপর ট্রিনিটি স্কুলে ৭ম গ্রেডে পড়াশোনা শুরু করেন মাহতাব। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন সহপাঠী উইল ক্রামার। একই সঙ্গে তার সঙ্গে ডিবেট ক্লাবের একজন পার্টনার হয়ে ওঠেন ক্রামার। ক্রামারের কন্ঠে তাই শোনা যায়, মাহতাব একজন চমৎকার, সবার প্রতি দয়ালু মানুষ।
এই পরিবারটিতে প্রথম ট্রাজেডি আঘাত করে ২০১৬ সালে। ওই বছর ক্যান্সারে মাহতাব, ছাবিহার মা মাহমুদা মারা যান। পরের বছরই জীবনের সরল দোলক দুলতে দুলতে অন্যপ্রান্তে চলে যায়। ওই বছর হার্ভার্ডে পড়ার সুযোগ পান মাহতাব আর তার ছোট্ট বোনটি ট্রিনিটির মতো অভিজাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিন্ডারগার্টেনে পড়ার সুযোগ পায়। তাদের এই গর্বের যেন শেষ ছিল না। তাদের ভবিষ্যত যেন আলোকিত হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই আলো বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। আবার ট্রাজেডি আঘাত করে এই পরিবারে।
এই মার্চে বন্ধ হয়ে যায় হার্ভার্ড। মাহতাব ফিরে আসেন ঘরে। ততক্ষণে তার পিতা মোহাম্মদ জাফর সেলফ- কোয়ারেন্টিনে চলে গেছেন। শুধু একবার এপার্টমেন্ট থেকে বের হতেন এ জন্য যে, তার ট্যাক্সি চালানোর কাজটা যাতে টিকে থাকে। কয়েক দিন পরে তিনি হাল্কা জ¦র নিয়ে ফিরে যান বাসায়। তারপর শুরু হয় মারাত্মক শ^াসকষ্ট। তার ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারা তাকে নিয়ে যান মন্টিফিওরে মেডিকেল সেন্টারে। মাহতাব বলেন, সেখানে এক সপ্তাহ তাকে রাখা হয় ভেন্টিলেটরে। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। কিন্তু তারপর হঠাৎ করে মারা যান মোহাম্মদ জাফর। এ সময় তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৬ বছর।
এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যখন তা শুনতে পেলেন তার বন্ধুমহল তারা দ্রুত ছুটে এলেন পরিবারটির পাশে। মাহতাবের বন্ধু উইল ক্রামার ‘গো ফান্ড মি’ প্রচারণায় সহায়তা করলেন। তাতে সব সম্প্রদায়ের মানুষ কম-বেশী যে যা পারেন জমা দিয়েছেন। মাহতাব বলেন, প্রিপ ফর প্রিপ থেকে ট্রিনিটি এবং হার্ভাড সব জায়গা থেকে সহায়তা এসেছে। তারা বুঝতে পেরেছে আমরা কি কঠিন আর্থিক সঙ্কটের মুখে। পিতামাতা ছাড়া কি করে আমরা এই যুক্তরাষ্ট্রের মতো জায়গায় লড়াইয়ে টিকে থাকবো! ভয় হয় সামনে তাকালে! কার মুখের দিকে তাকাবো! মা চলে গেলেন! বাবা ছিলেন বটগাছ হয়ে। তিনিও চলে গেলেন। এখন আমাদের মাথার ওপর খোলা আকাশ। বলতে বলতে চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে থাকে মাহতাবের।
কয়েকদিনের মধ্যেই ওই তহবিলে সংগ্রহ হয়েছে আড়াই লাখ ডলার। এ সম্পর্কে মাহতাব বলেন, এই কঠিন সময়ে এটা আমাদের কাছে আশীর্বাদ। এটা আমাদের প্রাণশক্তি। এর মধ্য দিয়ে আন্তঃসম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থাটা আরো বেড়ে গেল। এটাই প্রমাণ হলো, সঙ্কটের সময় আমরা সবাই সর্বোচ্চ দিয়ে একত্রিত হই। সামনের দিনগুলো আরো কঠিন হবে। একজন পিতা বা মাতার অভাব তো অন্য কাউকে দিয়ে পূরণ হয় না।
তবে এখন একটি সত্যকে অস্বীকার করা যাবে না। তা হলো, যেহেতু মোহাম্মদ জাফরের সন্তানরা এতিম, তাই তারা একা নন। তাদের পাশে সবাইকে দাঁড়াতে হবে। তার পিতা নিউ ইয়র্কে হলুদ ক্যাব ঠেলে যে সুযোগ, সুনাম কামিয়েছেন, তাই হয়তো সামনের দিনে তাদের জন্য সহায়ক হবে। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে মাহতাব বলেন, বাবা নিজে এতটা পরিশ্রম করেছেন, কিন্তু তার একটুও সুফল তিনি ভোগ করেননি। আমি আর আমার ভাই আমাদের নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ার দিকে মন দিয়েছি। আমরা জীবন গড়ার স্বাধীন পথ পেয়েছি। এই পথ নির্মাণ করে দিয়েছেন আমাদের পিতা, গর্বিত পিতা মোহাম্মদ জাফর।