ভোরের আলো ডেষ্ক: সরকারের দুই মন্ত্রীর ব্যর্থতায় করোনা পরিস্থিতি এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। স্বাস্থ্য ও বাণিজ্য খাতে এখন ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা। সব মহলে এখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। এই মন্ত্রীদের নিয়ে সমালোচনা ও বিতর্কের শেষ নেই।
অভিযোগ উঠেছে, সারা দেশের সিভিল সার্জন ও সিনিয়র চিকিৎসকদের পরামর্শ নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। চীনের উহানে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর যথেষ্ট সময় হাতে পেয়েও সেই সময়কে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
একইভাবে ব্যর্থ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। সরকারের সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর তিনি গার্মেন্ট মালিকদের নিয়ে বৈঠক করলেও সঠিক কোনো গাইডলাইন বা নির্দেশনা দিতে পারেননি। ফলে গণহারে গার্মেন্ট কারখানা খুলে রাখা, সে কারখানা বন্ধ করে শ্রমিকদের গ্রামে পাঠানো আবার মালিকপক্ষ কারখানা খুলে দিয়ে শ্রমিকদের ঢাকায় নিয়ে এসে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলেন।
গার্মেন্ট শ্রমিকদের মাধ্যমে করোনাভাইরাস গ্রামেগঞ্জে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে বক্তব্য আসে। এসব কারণে বাণিজ্যমন্ত্রীকে তিরস্কারও করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সমন্বয় করতে না পারায় গার্মেন্ট কারখানাগুলোয় চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।
দুই মন্ত্রীর এমন ব্যর্থতার কারণেই দেশে করোনাভাইরাসের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে- এমনটাই মনে করছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্টরা। তাদের এ ব্যর্থতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে তুমুল সমালোচনা।
করোনাভাইরাসের তৃতীয় স্তরে রয়েছে বাংলাদেশ। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে মানুষ থেকে মানুষে। ইতিমধ্যে বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদফতর সারা দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণাও দিয়েছে। এখন সংক্রমণের সংখ্যা যেমন প্রতিদিন বাড়ছে, তেমন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে।
এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামনের দিনগুলো কঠিন হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের জন্য তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে এখনই জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্য খাতের সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক ও বিএমএ নেতাসহ যারা কাজ করেছেন এবং এখনও করছেন তাদের নিয়ে ১৫ থেকে ২১ সদস্যবিশিষ্ট একটি ‘অ্যাকশন কমিটি’ গঠন করতে হবে। তাহলে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সহজ হবে। একটা সমন্বয়ও তৈরি হবে। অন্যথায় করোনাভাইরাসের কারণে দেশব্যাপী মহাবিপর্যয় আসতে পারে। যা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
একইভাবে সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির ব্যাপারে। তার দূরদর্শিতার অভাবে এবং গার্মেন্ট মালিকদের সঙ্গে সমন্বয়হীনতার কারণে গার্মেন্ট কারখানাগুলো খোলা রাখা-না রাখা নিয়ে যে বিভ্রান্তি ও শ্রমিকদের গ্রামে যাওয়া আবার ফিরে আসায় করোনা সংকটকে আরও গভীর করে তুলেছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী বাজার পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাসহ কোনো খাতেই সাফল্য দেখাতে পারেননি। সার্বিক পরিস্থিতিতে বাণিজ্যমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রণালয় এখন তীব্র সমালোচিত হচ্ছে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন বাণিজ্যমন্ত্রীর কর্মকান্ড ও যোগ্যতা নিয়ে।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বেহালদশা। এ মন্ত্রণালয়ের নানান কেনাকাটায় মিঠু সিন্ডিকেটসহ বিভিন্ন সিন্ডিকেটের কারণে মন্ত্রীরা বিভিন্ন সময়ে সমালোচিত হয়েছেন, বিতর্কিত হয়েছেন। স্বাস্থ্য খাতে ন্যূনতম শৃঙ্খলা আনতে পারেননি কোনো মন্ত্রীই। সর্বশেষ বর্তমান মন্ত্রী জাহিদ মালেকও মন্ত্রণালয়ে কোনো শৃঙ্খলা আনতে পারেননি। টানা সাত বছর ধরে তিনি এ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রথমে ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। তারপর এখন পূর্ণমন্ত্রী। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি কাজের কাজ কিছু করতে না পারলেও নানান ইস্যুতে একাধিকবার সমালোচিত হয়েছেন।
গত বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি যখন মারাত্মক আকার ধারণ করে তখন মন্ত্রী চলে গিয়েছিলেন সিঙ্গাপুরে। এ নিয়েও সমালোচিত হয়েছিলেন সব মহলে। এবার করোনা পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের পিপিই সরবরাহ নিয়েও তীব্র সমালোচনার মুখে জাহিদ মালেক। বিশেষ করে এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে মাস্ক সরবরাহকারী সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের সঙ্গে মন্ত্রীর পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
মন্ত্রী প্রতিদিন পিপিই নিয়ে যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন বিশেষ করে পিপিই দেওয়া হচ্ছে বললেও বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে নারায়ণগঞ্জের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তারা মাস্ক পাচ্ছেন না। যেসব পিপিই ও মাস্ক সরবরাহ করা হয়েছে সেগুলো খুবই নিম্নমানের; যা ব্যবহার করে কভিড-১৯ রোগীদের কাছাকাছি গিয়ে চিকিৎসা করা কঠিন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা অভিযোগ করেছেন, তারা ব্যক্তিগতভাবে মাস্ক ও পিপিই সংগ্রহ করেছেন। শুধু তাই নয়, করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য যেসব চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীকে ডেডিকেটেড করা হয়েছে তাদেরও অভিযোগের শেষ নেই। তাদের যাতায়াত, থাকা ও খাওয়ার বিষয়টি এখন পর্যন্ত অনিশ্চিত। তাদের প্রতিনিয়ত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। উত্তরা বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে কর্তব্যরত স্বাস্থ্যকর্মীরা অভিযোগ করেছেন, তারা এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে অ্যাকশন কমিটি তৈরি করে পরিস্থিতি সামাল না দিলে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া বলেন, বর্তমানে দেশে একটাই সংকট, সেটা করোনাভাইরাস। প্রধানমন্ত্রীর ওপরে আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। আশা করি, তিনি সবকিছু ভেবেচিন্তে সঠিক সিদ্ধান্তই দেবেন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন বলেন, করোনা নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক কমিটি হয়েছে। কমিটির চেয়ে জরুরি হলো করোনা নিয়ন্ত্রণে এগুলো কতখানি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে তা দেখা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে একটি ১১ সদস্যের কোর অ্যাকশন কমিটি হওয়া দরকার, যারা সমস্যা নিয়ন্ত্রণের কৌশল ও করণীয় নির্ধারণ করবেন। যারা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় অভিজ্ঞ, তাদেরই এ কমিটির সদস্য করা উচিত। এ কমিটির নির্দেশনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বাস্তবায়ন করবেন।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশের অর্থনীতির ওপর চাপের সৃষ্টি হয়েছে, সেহেতু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় রেখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনেও একটি অ্যাকশন কমিটি থাকা জরুরি। বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা বাণিজ্য সম্পর্কিত সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করবেন। পাশাপাশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ যেন করোনা পরিস্থিতির ওপর বিরূপ কোনো প্রভাব না ফেলে তা এ কমিটি নিশ্চিত করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, এটা সত্য যে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সারা বিশ্বের জন্যই একটি নতুন অভিজ্ঞতা। আমাদের সীমিত সম্পদ নিয়ে এত বড় দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন আছে। দরকার মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বিত উদ্যোগ। এ ব্যবস্থাপনার সমন্বয়ের ক্ষেত্রেই আমাদের মূল ঘাটতি। ঘাটতি পূরণের জন্য বিশেষায়িত কমিটি করার প্রয়োজন আছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, মন্ত্রীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা তো আছেই। বিতর্কও আছে। এ বিষয়গুলো রাজনৈতিক। এটা দেখার দায়িত্ব শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের। সিদ্ধান্তও সেখান থেকে আসতে হবে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন-বিএমএ সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেছেন, বিএমএ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপের সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো সমন্বয় নেই। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন একটা, স্বাস্থ্যসচিব বলেন আরেকটা। আবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি বলেন ভিন্ন কথা। তারা একেকজন একেক কথা বলছেন। এখন এমন করার সময় নয়। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা দায়িত্বহীন কথাবার্তা বন্ধ করুন। সমন্বয়হীনতা দূর করতে সবাই একসঙ্গে বসতে হবে। এতে সবার জন্যই ভালো হবে। সমন্বয়হীনতার কারণেই আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারছি না।
তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাতদিন কাজ করছেন। প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা সঠিক তথ্য প্রধানমন্ত্রীকে জানাচ্ছেন না। আমাদের প্রতিনিধিরা ডিজি অফিসের সঙ্গে সর্বক্ষণ আছেন। সবাই আমরা একসঙ্গে কাজ করব। কিন্তু তা হচ্ছে না। সমন্বয় না করলে কোনো কিছ্রু সমাধান হবে না।
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে আজকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমাদের চোখে আলাদা করে পড়লেও বাস্তবতা হলো- এ দেশের প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কেউ নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য, এ প্রতিষ্ঠানগুলোই সেভাবে গড়ে ওঠেনি। যে জায়গায় যে সময় যা করা উচিত তা করা হয়নি। তারই প্রতিফলন আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি।
ড. জিয়া বলেন, এত বড় এটা দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য অবশ্যই জাতীয় পর্যায়ে একটা অ্যাকশন কমিটি করা প্রয়োজন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের কমিটিগুলো এমন হয় যে, যার যেখানে যোগ্যতা নেই তাকেই সেখানে বসানো হয়। তার পরও আমাদের অবশ্যই একটি অ্যাকশন কমিটি করে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেন, শুধু স্বাস্থ্য খাত নয়, অন্য যে কোনো খাতে যখন ক্রাইসিস দেখা দেবে, দেখা যাবে সেখানেই অদক্ষতা আছে। যেখানে যে যোগ্যতার লোক বসার কথা ছিল, সেখানে দেখা গেছে এর চেয়ে কম যোগ্য, অযোগ্য, কম মেধাবী লোক উচ্চ আসনে বসে আছেন। এসব লোক দিয়ে দ্রুত ক্রাইসিস সামাল দেওয়া সম্ভব হয় না। মন্ত্রী-সচিবরা যে বলেন, আমরা পূর্বপ্রস্তুতি নিয়েছি, এগুলো আবেগীয় কথাবার্তা। বাস্তবতার সঙ্গে কোনো মিল নেই।