ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া: পৃথিবীর ৭৮০ কোটি মানুষের প্রত্যেকেই এ মুহূর্তে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশে দেশে মৃত্যুর মিছিল। কোভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমণের শংকায় বিহ্বল, শোকে মূহ্যমান সারা বিশ্ব। চারিদিকে নিরূপায় আর্তি- আহাজারি। দিন-দিনান্তে সংকট আরও ঘনিভূত হচ্ছে। আর্থিক বিপত্তি ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের নেতিবাচক প্রভাব ২০০২-২০০৯ এর বিশ্ব মহামন্দাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
এমন সর্বনাশা রাহুগ্রাস মানব সভ্যতার জন্য এক ক্রান্তিকাল। সভ্যতার অগ্রগতিতে মানুষ কতোটা মানবিক হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সংকটে-যে মানুষ মানুষের সাথি হয়ছে, দুখের দোসর হয়েছে; তা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। অর্থ-সম্পদ, বিত্ত-বৈভব, বংশ-কুল, ধর্ম-বর্ণ, সমাজ-সংস্কার, অসার ভৌগোলিক অবস্থান কালে কালে মানুষের মধ্যে যে বিভেদরেখা টেনে দিয়েছে, সেই কুটিল ভঙ্গুর বালির বাঁধ মানুষের ভালোবাসার উত্তাল ঊর্মিতে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে বহুবার। ভালোবাসার উত্তাপে শীতল যুদ্ধাবস্থারও পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
স্বাভাবিক সময়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের ঘনিষ্টতা ছিল দৈহিক। দূরত্ব ছিল মানসিক । আর চলমান বিপর্যয়কালে দেহের দূরত্ব বেড়েছে, দূরত্ব কমেছে মনের। একের মনের সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়েছে অন্যের মননমধু। প্রলয়ঙ্করী এ দুর্যোগে মানবতার স্বর্ণালি প্রাপ্তি বোধ করি এই হৃদি-নৈকট্য। দেহ দূরে, মন কাছে। অন্যের কল্যাণে কেবলমাত্র প্রার্থনার ঠোঁট নয়; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও শুশ্রূষার সম্প্রসারিত হাত। সকলেই যেন বিশ্বমাতার উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে বলছে, “আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে/ ঘরের হয়ে পরের মতন ভাই ছেড়ে ভাই ক’দিন থাকে?…যেথায় থাকি যে যেখানে/ বাঁধন আছে প্রাণে প্রাণে/সেই প্রাণের টানে টেনে আনে– সেই প্রাণের বেদন জানে না কে?” আশার কথা এই যে, এই মহামারি এখনও একটি আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বের যবনিকাপাত ঘটাতে পারেনি। বরং মহামারিটি নিজেই আমাদের আন্তঃনির্ভরতার প্রমাণ বহন করছে।
নিবিড় সংসর্গই প্রাকৃতিক রীতি। সাগরের সঙ্গে ঢেউ, ফুলের সঙ্গে প্রজাপতি, জলের সঙ্গে আর্দ্রতা, ধূপের সঙ্গে গন্ধ, সুরের সঙ্গে ছন্দ, ভাবের সঙ্গে রূপ, সীমার সঙ্গে অসীম, মুক্তির সঙ্গে বন্ধন, জীবনের সঙ্গে মৃত্যু আর সৃষ্টির সঙ্গে লয়ের সম্মিলন সুনিবিড়। সে মতে, পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকাই মানুষের চিরায়ত জীবনাচার। আদি মানবও অবিলম্বে যুক্ত হয়েছিলো তার অংশি উত্তমার্ধ মানবি’র সঙ্গে । পুণ্যে-পাপে দুঃখে-সুখে পতনে-উত্থানে সাফল্য-ব্যর্থতায় মানুষ নিজেকে অন্যের সঙ্গে যুক্ত রেখে চলেছে । বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে একজন হয়েছে অন্যজনের একান্ত বন্ধু, সহযাত্রী। দুর্গম-গিরি কান্তার–মরু দুস্তর-পারাবারে মানুষই হয়েছে মানুষের সারথি, সহচর। যুগ-যুগান্তে কাল-কালান্তে সংযুক্তিতেই মানবের উত্থান হয়েছে, আর বিযুক্তিতে পতন। এভাবেই মানুষ সৃষ্টির গতিধারায় সুষম গতিশীলতা বজায় রেখে চলেছে। অজ্ঞতার অনগ্রসরতাকে দীপ্যমান করে তুলেছে প্রগতির প্রণোদনায় পারস্পরিক সংযোগের মাধ্যমে।
এই সংযুক্তিই মানুষের , মমতা , প্রেম শিল্প-সাহিত্য নান্দিকতার প্রসূতি। এটিই কান্তিমান সৃজনশীলতার ভাব ও রূপের জগত। এরই আশ্রয়ে মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে প্রাকৃতিক প্রাণনে সভ্যতাকে এগিয়ে নিচ্ছে অভীষ্ট লক্ষ্যে। আর সেই সমাজবদ্ধ মানুষই এখন সমাজচ্যুতির মাঝে জীবনের রক্ষাকবচ খুঁজছে মারী-মড়ার চলমান করাল গ্রাসে। সভ্যতার এমন অসহায় বিপর্যয় নিকট অতীতে মানুষ প্রত্যক্ষ করেনি। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! যুগলবন্দি মানুষ এখন আগলবন্দি। অনিয়ন্ত্রিত মহামারিতে পর্যুদস্ত জনপদ। দাওয়াই নাই, বদ্যি নাই। নাই প্রতিষেধক প্রতিরোধক। প্রতিকার নাই, নিরাময় নাই। প্রবোধ দেবার মতো স্বজনও নাই। কী ভয়ার্ত জনপদ! মানুষের কোলাহলে মুখরিত কর্মক্ষেত্রে এখন সমাধির নিষ্প্রাণ নীরবতা। ধর্মাশ্রমে পুণ্যার্থীদের গতায়ত রহিত । দুর্যোগ-দুর্ভোগে সভ্যতা হুমকির মুখে। জীবন রক্ষার নিরূপায় নিদান হিসেবে মানুষ বেছে নিয়েছে সামাজিক দূরত্বকে। মানুষের জন্য এ এক দুঃসহ পরিস্থিতি। মানুষ ছাড়া-যে মানুষ কতোটা অসহায় তা তখনি গভীর উপলব্ধিতে আসে, যখন মানুষের জন্য মানুষ সোনার হরিণ। ঘরবন্দি মানুষ যেন নিজ ভূমে পরবাসী। এমন বিযুক্তির মাঝে সভ্যতা কেমন করে এগুবে? কেমন করে বিকশিত হবে প্রগতির নিত্যফোটা কলিকা-মুকুল? এ বিচ্ছিন্নতা দীর্ঘস্থায়ী হলে এর কুফল হতে পারে চিরস্থায়ী। উদ্গত হতে পারে পরিবর্তিত নতুন বিশ্ব পরিস্থিতি। বদলে যেতে পারে বৈশ্বিক যাপন পদ্ধতি। নতুন মোড় নিতে পারে জীবন প্রণালী। ক্ষতিগ্রস্ত বৈশ্বিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধারের অযোগ্য হয়ে পড়তে পারে; যেমনটা হয়েছিল অতীতের অন্যান্য প্রলয়ঙ্করী মহামারির অবশ্যম্ভাবি পরিণতি হিসেবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকামতে বড়ো মাপের বিশ্বমহামারি কুড়ি খানেক হলেও পঞ্চদশ শতাব্দি এবং তারও আগ থেকে বিশ্বকে মোকাবেলা করতে হয়েছে নানা প্রকার-প্রকৃতির শতাধিক মহামারির।
আজ থেকে এক শতাব্দী আগে ১৯১৮-১৯২০ সময়কালে অতিমারির দাপটে সংক্রমিত হয়েছিল বিশ্বের প্রায় ৫০ কোটি মানুষ। তাতে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ মানুষের। এখনও পর্যন্ত বিশ্বের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারি। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী এই স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জাতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যার চাইতেও বেশি। সেসময় সারা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশেরই মৃত্যু হয়েছিল এই ভাইরাসে। আর ১৩৩১-৫৩ খ্রিষ্টাব্দ সময়কালটা ছিল ব্ল্যাক ডেথ (প্লেগ) ’র বিধ্বংসী সময়। এ সময় ইউরোপের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় এ মহামারি। তবে এ অভিশপ্ত মহামারির কুপ্রভাব টিকে ছিল অন্তত পরবর্তী দুই শতাব্দি। ইউরোপের জনসংখ্যা পূর্বের স্তরে ফিরে আসতে সময় লেগেছিল প্রায় ২০০ বছর, এবং কিছু অঞ্চল
(যেমন, ফ্লোরেন্স) ১৯ শতকের আগ পর্যন্ত সেই স্তরটি পুনরুদ্ধারই করতে পারেনি । এটি ছিল এমনই এক ভয়াবহ মহামারি, যার কারণে সমগ্র ইউরোপের অর্থনৈতিক সার্বিক জীবন কাঠামোই বদলে যায়, প্রভাবিত হয় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি। বিলুপ্তি ঘটে সামন্ততন্ত্রের । বিশ্ববাসিকে ব্ল্যাক ডেথের রেখে যাওয়া গভীর ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। পূর্বের প্রলয়ঙ্করি প্লেগ, ফ্লু, ইবোলা ভাইরাস, রেবিজ ভাইরাস, মারবুর্গ ভাইারাস, ডেঙ্গু, এইডস) এইচআইভিতে আক্রান্ত ৭ কোটি মানুষ, মৃত্যু প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ( কিংবা ইনফ্লুয়েঞ্জা— কোন মহামারিই পরাশক্তিধরদের মাঝে বিরাজমান বৈশ্বিক বৈরিতা কিংবা পাশবিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে বিশ্বব্যাপী মানবিক সহযোগিতার নতুন যুগের সূচনা করতে পারেনি । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োগে এবং এর অনুষঙ্গে পাঁচ থেকে সাড়ে আট কোটি লোক মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও আধিপত্য বিস্তারের হুকুম আর বল প্রয়োগের হুমকি থেকে দুর্বলদের রক্ষা করতে পারেনি আমাদের আধুনিক সভ্যতা। বোমা-বারুদের সমাহার ঘটানো থেকে তাদের নিবৃত্ত করতে পারেনি। সেগুলোর যথেচ্ছ ব্যবহারে মানবতার যে মর্মন্তুদ বিপর্যয় ঘটেছে, তা কারো বিবেক-বোধের বধির কানে পৌঁছায়নি। বিশ্বের সকল মানুষের আহার, আবাস, আচ্ছাদন, শিক্ষা,
চিকিৎসার ন্যূনতম মানবিক চাহিদা পূরণ করতে অর্থবহ উদ্যোগ নেয়া হয় নি। সারাটা বিশ্ব শান্তির চেয়ে হ্রস্ব-দীর্ঘ নানান যুদ্ধেই লিপ্ত ছিল বেশিটা সময় জুড়ে। ‘পৃথিবীর সবগুলো প্যারেড গ্রাউন্ড হোক শস্যের বীজতলা/পৃথিবীর সবগুলো বন্দুকের নল হোক লাঙলের চকচকে ফলা’– কবির এই চাওয়ার অপূর্ণতা নিয়েই হয়তো পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিক গতি চিরতরে স্তব্ধ হবে।
তবে মহামারি নভেল করোনা ( কোভিড-১৯) এমন এক বিশ্ব-বিপর্যয়কর ঘটনা, যার সুদূরপ্রসারি পরিণতি আমরা কেবল আজ কল্পনাই করতে পারি। এই মারী-পরবর্তী পরিস্থিতি বিশ্বকে কীভাবে চিরতরে বদলে দেবে, তা শীর্ষস্থানীয় বৈশ্বিক চিন্তাবিদদের গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। এই মারাত্মক ভাইরাসটি দেশে দেশে অপর্যাপ্ত পরিকল্পনা এবং অযোগ্য নেতৃত্বের সংমিশ্রণে মানবতাকে এক অভাবিত নতুন এবং উদ্বেগজনক পথে ঠেলে দিয়েছে।
এটি অনেকটা নিশ্চিত যে, বার্লিন প্রাচীরের পতনের মতো করোনাভাইরাসটি যেভাবে জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে, পুঁজিবাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলছে এবং সরকারগুলোর যোগ্যতা ও সক্ষমতার পরিসরকে উন্মোচিত করছে; তাতে স্পষ্টতই অনুমিত হচ্ছে যে — বৈশ্বিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক শক্তিবলয় স্থায়ীভাবে পরিবর্তিত হতে চলেছে। সে লক্ষণ ইতোমধ্যেই ধীরে ধীরে প্রতিভাত হতে শুরু করেছে। এই সঙ্কট উদ্ভূত হওয়ায় আমাদের পায়ের নীচের জমিনের প্রকৃতি প্রতীকি ও প্রকৃত অর্থেই থিতু হারাচ্ছে। মহামারি অভ্যন্তরিণ রাষ্ট্র-ব্যবস্থা এবং জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালি করে তুলতে পারে। এতে বৈশ্বিক ধারণা বিশ্বজনীনতা হারাতে পারে। জন্ম নিতে পারে অতি বা উগ্র-স্বাদেশিকতার নয়া দৈত্য। পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যে শক্তি ও প্রভাবের পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে পারে। এক কথায় বলতে গেলে ,কোভিড-১৯ এমন একটি বিশ্ব তৈরি করবে, যা হবে অপেক্ষাকৃত অনুদার, ন্যূনতর উন্মুক্ত এবং স্বল্প সমৃদ্ধ । অতি জাতীয়তাবোধের সঙ্কীর্ণতার কুঠারাঘাতে উদার বিশ্বায়নের অঙ্গহানি বা সমাপ্তি কিংবা সমাধি রচিত হতে পারে। চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি এমন এক পরিবর্তনকেই ত্বরান্বিত করবে– যা ইতোমধ্যে সূচিত হয়েছিল: মার্কিন কেন্দ্রিক বিশ্বায়ন থেকে চীন-কেন্দ্রিক বিশ্বায়নের দিকে ক্রমাপসারণ। এই মহামারির অভিজ্ঞতার কারণে বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্র, সরকার, সংস্থা এবং সমাজিক সংগঠন অর্থনৈতিক স্ব-বিচ্ছিন্নতার পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তাদের স্ব-স্ব সক্ষমতা জোরদার করতে চাইবে। ইতোমধ্যে বিশ্বায়ন এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মার্কিন জনগণের বিশ্বাসে চির ধরেছে। কারণ এতে তাদের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে । কিন্তু এর বিপরীতে, চীন বিশ্বাস হারায়নি। গত কয়েক দশকে তারা বিশ্ব-বিচ্ছিন্নতাকে জয় করেছে। বৈশ্বিক সংযুক্তির মাধ্যমে অর্থনৈতিক পুনরুত্থানের সুফল অর্জন করেছে। চীনা জনগণও সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাসের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। তারা বিশ্বাস করে যে, তারা যে কোনও জায়গায় প্রতিযোগিতা করবার সক্ষমতা রাখে। হয়তো কিছু ক্ষেত্রে সে আত্মবিশ্বাস অতিবিশ্বাসের মরীচিকায় বিলীন হয়ে যেতে পারে কারণ । বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য চাই কাঙ্ক্ষিত সততা ও স্বচ্ছতা– যার অনুশীলনে চীনাদের আরও পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে গভীর শংকার বিষয়এই যে, এমন ভাঙ্গা-গড়ার পরিক্রমায় তৃতীয় কোন কুটিল শক্তিও চালকের আসনে আপদের মতো অবলীলায় বসে যেতে পারে। আর তখন সে আপদ হবে সমূহ বিপদের চেয়েও ভয়ংকর । বিশ্বজোড়া উস্কে দিতে পারে ধর্ম-বর্ণবাদের বিষবাষ্প।
প্রসঙ্গান্তরে মধ্যযুগে রচিত ইতিহাসে বিস্ময়কর গৌরবময় লোককাহিনীর নায়ক ‘কিং আর্থার’-এর বাণী চিরন্তনির শরণ নিয়ে বলি, ” “The old order changeth, yielding place to new/ And God fulfils Himself in many ways/Lest one good custom should corrupt the world….If thou shouldst never see my face again/ Pray for my soul/ More things are wrought by prayer/ Than this world dreams of.” নতুনের জন্য স্থান সংকুলানের প্রয়োজনেই সাবেকি রীতি-নীতির বদল হয়। বিধাতা তাঁর পরিকল্পনার পরিপূর্ণতা নব-নব বিচিত্র পন্থায় সম্পাদন করেন– যাতে করে কোন শ্রেয় আচারও দীর্ঘকাল বিশ্ব-ব্যবস্থাকে কলুষিত করবার মওকা না পায়। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই এই পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবি।
প্রার্থনা করার তাগিদ দিয়ে আর্থার তার অনুসারীদের বলেছেন, প্রার্থনা দ্বারা এমন সব অর্জন সম্ভব যা মানুষ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনা। আমরাও সাম্প্রতিক সকল অকাল প্রয়াণের সহমর্মী। তাদের জন্য নতজানু হয়ে প্রার্থনা করি। তাদের পুণ্য স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসকদের প্রতি জানাই গভীর কৃতজ্ঞতা।
সংকট উত্তরনান্তে সময়ের দাবিতে যে পরিবর্তনই আসুক, সেই তালের সঙ্গে সংগত করা ছাড়া হয়তো গত্যন্তর থাকবেনা। তবে সে পরিবর্তন যদি প্রগতির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, তাহলেই যতো বিপত্তি। বিশ্ব নেতাদের ভুললে চলবে না যে, সকল গতিই প্রগতি নয়। ব্যাক-গিয়ারে চলায় গতি আছে, তবে তাতে প্রগতি নেই। তাতে পথ এগোয় না; পিছোয়। গন্তব্যের দূরত্বকে আরও বাড়ায়। আর তা করতে গিয়ে মাঝে মাঝে পথও হারায়।
বিধাতার এই সুন্দর পৃথিবীকে মানুষ যতোটা বিপন্ন, বিষাক্ত ও কলুষিত করেছে , প্রকৃতিও বোধ করি সেই অনাচারেরই প্রতিশোধ নিচ্ছে নির্মম হাতে। আহত বাঘের থাবা বেশি ভয়ংকর হয়। আমরা যেন সেই বিষাক্ত থাবারই অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছি। আমাদের চিৎস্রোতে যেন শুনতে পাচ্ছি সেই অনুরণনঃ ‘তোমারে যা দিয়েছিনু, সে তোমারি দান।’প্রার্থনা করি, এই বিপর্যয় কেটে গেলে মানুষের চৈতন্য আরও শাণিত হবে, বিকলাঙ্গ বিবেচনাবোধ আরও জাগ্রত হবে। সংকট একদিন কাটবেই কাটবে। সম্ভাবনার সোনালি সকাল আবার হাসবেই। মানুষে মানুষে আবার প্রাণের আলিঙ্গন হবে। কারণ পারাজিত হবার জন্য মানুষের জন্ম হয়নি। সংকটের কল্পনায় তার ম্রিয়মাণ হবার সুযোগ নেই। বরং অদম্য সাহসের সঙ্গে সংকট মোকাবেলা করার মাঝেই মানুষের অন্তর্গত প্রাণশক্তি নিহিত। তাই মানুষ পরাভব মানেনা। মানুষ বিজিত হয় না, বিজয়ী হয়। আর সেখানেই সৃষ্টির সেরা জীবের শ্রেষ্ঠত্ব। সৃষ্টির এই বীরত্বের মাঝেই স্রষ্টার অতুল অহংকার।
মানুষে মানুষে চলমান বর্তমান অনিবার্য সামাজিক দূরত্ব, বিচ্ছেদ-বিচ্ছিন্নতা সাময়িক। মানুষের পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হবার প্রাকৃতিক পরিক্রমায় কোন চিরস্থায়ী ছেদ পড়তেই পারে না। মানুষের সঙ্গ-লাভের অভিযাত্রা চির চলমান। যেখানেই মানুষ, সেখানেই সান্নিধ্য। তাই মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচ্ছিন্নতা রহিত। সভ্যতার অগ্রযাত্রায় আমিত্ব নির্বাসিত। বহুত্ব আদৃত। অন্যের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে বলেই মানুষ আপন হতে বের হয়ে বাইরে এসে দাঁড়াতে পারে। তার অন্তর জুড়ে বিশ্বলোকের সাড়া অনুভব করতে পারে। যুক্ত হতে পারে আত্মার পরম আত্মীয়ের সঙ্গে; মানুষের সঙ্গে।
সম্প্রতি মানুষে মানুষে যে বিচ্ছিন্নতা সে অধ্যায়ের অবসানে মানুষ আবার নতুন সখ্যতার আনন্দে উদ্বেল হবে। এই সাময়িক বিচ্ছেদ যেন বান্ধবকে নতুন করে পাবার আকুতিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ।
“তোমায় নতুন করেই পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ/ ও মোর ভালোবাসার ধন। দেখা দেবে বলে তুমি হও যে অদর্শন/ ও মোর ভালোবাসার ধন।” বিচ্ছিন্নতার পরিবর্তে সম্পৃক্ততার নান্দনিক চর্চায় মানুষ যুগ- যুগান্তে নিবেদিত। মানুষ যেমনি মানুষের সুখের দিনের সখা, তেমনি দুঃখের দিনের দোসর। তাই বিশ্ব- মানবতার সমবেত প্রার্থনা, “অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে/ নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে/… যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ/ সঞ্চার করো সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ।”
লেখক: সাবেক উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা