ভোরের আলো ডেস্ক:
করোনা ভাইরাসে দেশজুড়ে চলছে অঘোষিত লকডাউন। স্থবির হয়ে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্ম। ঘরে বন্দি হয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের মানুষ। স্তব্ধ হয়ে পড়েছে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল।
এমন ভয়াবহ অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের পাশে নেই অধিকাংশ এমপি-মন্ত্রী এবং জনপ্রতিনিধিরা। করোনা আতঙ্কে তারা স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন। ঢাকায় বসে মোবাইলফোন এবং ভিডিও বার্তা দিয়ে দায়সারা দায়িত্ব পালন করছেন। অনেকে ঢাকায় বসে মাস্ক ও স্যানিটাইজার নিয়ে ছবি তুলে পোস্ট দিচ্ছেন। অথচ প্রতিটি এলাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে কাজ করছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে দিনরাত ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার কাজও করছেন পুলিশ সদস্যরা। এদিকে মন্ত্রী-এমপিদের নিজ এলাকায় অবস্থান না করার সুবাধে স্থানীয় নেতা-কর্মী ও জনপ্রতিনিধিরা করোনার ত্রাণ বিতরণকে কেন্দ্র করে লুটের উৎসবে মেতে উঠেছেন।
দেশের বিভিন্ন অ লে এ পর্যন্ত ত্রাণ লুণ্ঠনকারী এমন বেশ কয়েকজন চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের পদধারী নেতাদের আটক করেছে পুলিশ। উদ্ধার করা হয়েছে ত্রাণের চাল ও নগদ টাকা। যা নিয়ে ক্ষুব্ধ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা। সুশীল সমাজের মধ্যেও ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে। মাঠ প্রশাসনের সহায়তায় এবং স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলো ভাইরাস প্রতিরোধ সামগ্রী ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল।
সরকারি-বেসরকারি ও সামাজিক সংগঠনগুলো অবশ্য নিজ নিজ উদ্যোগে চাল-ডালসহ নিত্যপণ্য বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়ার কাজ শুরু করেছে, যা অনেকটাই আশাব্যঞ্জক। মার্চের প্রথম সপ্তাহে দেশে প্রথম করোনা ভাইরাস দেখা দেয়। প্রাণঘাতী ভাইরাসটি দেখা দেয়ার পর থেকে নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান করে লিফলেট বিতরণসহ জনসচেনতামূলক কার্যক্রম করে স্থানীয় এমপি-মন্ত্রী এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা। কিন্তু করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে থাকায় দেশজুড়ে গত ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশের সব দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যানচলাচল, অফিস-আদালত এবং জনসমাগম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সরকারের অঘোষিত লকডাউনের এই সিদ্ধান্ত আসার পরই এলাকা ছেড়েছেন অধিকাংশ এমপি এমন অভিযোগ রয়েছে সাধারণ মানুষের মুখে। ঘরবন্দি হয়ে পড়া শ্রমজীবী মানুষের খোঁজখবর নিচ্ছেন না অধিকাংশই। এমপিদের এমন আচরণে ক্ষুব্ধ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন- করোনা ভাইরাসে অনেক মানুষ বেকার হয়েছে পড়েছে। এই মুহূর্তে তাদের সবাইকে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। কিন্তু এমপিরা তাদের জন্য কিছুই করছেন না। এ নিয়ে ব্যঙ্গ করে অনেকে বলছেন, এমপি-মন্ত্রীরা ‘হোম কোয়ারেন্টাইনে’ আছেন।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) একজন নেতা এবিষয়ে বলেন, এটি জাতীয় দুর্যোগ। জনপ্রতিনিধিরা মাঠে থাকবেন এটাইতো প্রত্যাশা ছিল। জনগণের কাছে তাদের কমিটমেন্ট আছে। নগরের দায়িত্বে মেয়র আছেন, কিন্তু সংসদীয় আসনের এমপিদের কাজ কী? তারা যদি এই সময়ে মানুষের পাশে না আসেন তবে তো তাদের রাজনীতি মানুষের জন্য হবে না।
তবে এমপিদের অনেকেরই দাবি, করোনার প্রকোপের কারণে এলাকায় না গেলেও স্থানীয় নেতাকর্মীদের মোবাইলফোনে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে এবং তাদের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক খবরাখবর রাখা হচ্ছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ সকল ইউনিটের নেতাকর্মীরা নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছেন। এছাড়া প্রতিদিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমেও শ্রমবীজী মানুষের মাঝে খাবার বিলি করা হচ্ছে।
এদিকে দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে ত্রাণ সহায়তা ও দশটাকা কেজিতে চাল কেনার সুযোগ দেয়া হয়েছে। তবে এই মহামারীতেও এক শ্রেণির অসাধু জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী তাতে হাত দিয়েছে। কেউ চুরি করে অন্যত্র বিক্রি করছেন, কেউ আত্মসাৎ করতে গিয়ে ধরা খাচ্ছেন।
এরইমধ্যে বেশ কয়েকজন চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং আওয়ামী লীগের নেতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ত্রাণের সামগ্রীসহ গ্রেফতারও হয়েছেন। যদিও প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, যারা এই সময়ে সহায়তা নিয়ে দুর্নীতি করবে তাদের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। তাতেও থামছে না এই অপকর্ম।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত সোমবার পটুয়াখালীতে জেলেদের জন্য বরাদ্দকৃত ভিজিএফ’এর চাল চুরির মামলায় সদর উপজেলার কমলাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনির হোসেন গ্রেফতার হন। এর আগে একই ঘটনায় চেয়ারম্যানের কাছের লোক মো. জাকির হোসেন ও ব্যবসায়ী সোহাগকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
জেলেদের জন্য বরাদ্দ হওয়া ৪৪ মেট্রিক টন চাল আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেফতার হন পাথরঘাটা ইউপি চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন পল্টু। এদিকে ঝালকাঠির বাসন্ডা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনিরের বাসা থেকে মজুদ করা ত্রাণের আড়াই টন চাল জব্দ করা হয়। পরে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
একই অভিযোগে গ্রেফতার হন নাটোরের সিংড়ার সুকাশ ইউনিয়ন পরিষদের ৬নং ওয়ার্ড সদস্য ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহিন শাহ্, চাল ব্যবসায়ী গোলাম মওলা ও চালের ডিলার লেবু হোসেন। ত্রাণের ১৩ বস্তা চালসহ এই তিনজনকে আটক করে উপজেলা প্রশাসন। জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ সাইদুর ও তার শ্যালক আনোয়ার হোসেনও গ্রেফতার হয়েছেন চাল চুরির অপরাধে। যশোরের শহরতলীর এক গুদামে অভিযান চালিয়ে সরকারি ৮০ বস্তা চাল জব্দ করে ডিবি পুলিশ।
এ সময় দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। শরণখোলায় আত্মসাৎ করে পাচারের উদ্দেশে রাখা ১৮ বস্তা সরকারি চালসহ একজন গ্রেফতার হন। মাদারীপুরের শিবচরে সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল কালোবাজারে বিক্রির জন্য মজুদ করা ৬৮ বস্তা চাল জব্দ করে প্রশাসন। এতে জড়িত ছাত্রলীগের বাঁশকান্দি ইউনিয়ন কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য আবু বক্কর সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ময়মনসিংহের ত্রিশালে ডিলার আব্দুল খালেক, সুনামগঞ্জে ব্যবসায়ী শওকত আলী ও ডিলার বিপ্লব সরকার, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে তিনজন এবং শফিকুল ইসলাম ও শহিদুল ইসলাম, রংপুরে তিনজন গ্রেফতার হয়েছেন একই ধরনের অভিযোগে। নরসিংদীর মনোহরদীতে একটি রাইস মিল থেকে একশ’ বস্তা সরকারি চাল উদ্ধার। আর খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সরকারি গুদামে অবৈধভাবে চাল মজুদ করার অভিযোগে একজন আটক হয়েছেন।
এসব বিষয়ে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, মানুষের নীতি নৈতিকতা বলতে এখন আর কিছু নেই। আর সরকার সবসময় দলীয় লোকদের প্রশ্রয় দেয় এটাও এসবের জন্য একটা কারণ। শুধু করোনা নয়, অন্য সময়ও আমরা দেখেছি এমন লুটপাট, দুর্নীতি করতে। কিন্তু সেগুলোর সঠিক বিচার হয়নি। হলে পরিস্থিতি এমনটা নাও হতে পারতো।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্যরা কেউ দায়িত্ব নিয়ে কিছু করছেন না। এটা একটা সিস্টেম হয়ে গেছে। ফলে অপকর্মকারীদের মধ্যে কোনো ভয় কাজ করে না। উল্লেখ্য, এ পর্যন্ত দেশে নভেল করোনা ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪ জনে আর আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৬২১ জন।
(ভোরের আলো/ফআ)