লিখেছেন গোলাম মোর্তোজা
একজন বাংলাদেশি ডাক্তারের সূত্রে জানার সুযোগ হলো, করোনো ভাইরাস প্রতিরোধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে ভুটান। দেশটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিষয়ে আমরা জানি। ‘সুখি মানুষের দেশ‘ হিসেবেও কিছুটা জানি। জানি, ভুটানী শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে পড়তে আসে। এর চেয়ে খুব বেশি তথ্য আমরা অনেকেই জানি না। ভুটানকে খুব একটা গুরুত্বের মধ্যেও ধরি না। এক সময় ভুটানকে ফুটবলে সাত-আট গোলে হারাতাম। সেই দিন আর নেই। এখন মাঝে-মধ্যে আমরা ভুটানের কাছে হেরেও যাই।
প্রায় আট লাখ জনসংখ্যার ১৪ হাজার ৮২৪ বর্গমাইলের দেশটি সফলভাবে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করছে— সংবাদ হিসেবে যা বেশ কৌতূহল তৈরি করে।
করোনাভাইরাস বিষয়ে জনগণকে সতর্ক করতে স্যানিটাইজার হাতে রাস্তায় দেখা গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিংকে।
তাকে আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি। গত বছর দুদিনের সফরে বাংলাদেশে এসে গণমাধ্যমের উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে রেখেছিলেন কয়েকদিন। ভাঙ্গা-ভাঙ্গা বাংলা বক্তৃতা মূলধারার গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল।
‘ভালো ডাক্তার হতে হলে আগে ভালো মানুষ হতে হবে ভাই‘— নিশ্চয় স্মরণ করতে পারছি। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছেন। এফসিপিএসও করে গেছেন বাংলাদেশ থেকে।
প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিংয়ের দেশে মার্চের প্রথমদিকে করোনা আক্রান্ত এক মার্কিন নাগরিক শনাক্ত হয়েছিলেন থিম্পুতে। এরপর আর তেমন কিছু জানা যায়নি।
করোনাভাইরাস সামরিক দিক দিয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী আর্থিক দিক দিয়ে ধনী দেশগুলোকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে।
সেখানে ভুটানের মতো ছোট্ট একটি দেশ কী করে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করছে? খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে জানা গেল বেশ চমকপ্রদ তথ্য।
বাংলাদেশি ডাক্তার মাহবুবে মুস্তাফা রনি ভুটানের জিগমে দর্জি ওয়াংচুক ন্যাশনাল রেফারেল হাসপাতালে কর্মরত। তিনি অ্যানেসথেসিওলজিস্ট। বর্তমানে ভুটানে ১৯ জন বাংলাদেশি ডাক্তার কাজ করছেন। ডা. রনি বলছিলেন, ‘আমি ভুটানে এসেছি ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখে। বিমানবন্দরে আধুনিক পিপিই পরিহিত স্বাস্থ্যকর্মীরা সব যাত্রীদের স্ক্রিনিং করছিলেন। ঢাকা বিমানবন্দরের ঢিলেঢালা অবস্থার তুলনায় ভুটানের তৎপরতা বিস্মিত করেছিল। এখন পর্যন্ত ভুটানে পাঁচজন করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে দুজন মার্কিন নাগরিক যারা ভারত হয়ে ভুটানে এসেছিলেন। দুজন ইংল্যান্ড, একজন আমেরিকা ফেরত ভুটানি শিক্ষার্থী। এরা যতোজনের সঙ্গে মিশেছিল, তাদের সবাইকে কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে।’
ভুটান পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তার নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশের ভুটান দূতাবাসের কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীদেরও ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। প্রবাসী ভুটানীরা দেশে ফিরে এসেছেন।
ডা. রনি বলছিলেন, ‘ভুটান তার যত নাগরিককে দেশে ফেরত এনেছে তাদের সবাইকেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় কোয়ারেন্টিনে রেখেছে, তিন-তারকা থেকে পাঁচ-তারকা হোটেলে। হোটেলের মালিকরা ভাড়া নিচ্ছেন না। সরকারের কাছ থেকে প্রতিজনের কোয়ারেন্টিন খরচ বাবদ প্রতিদিন পাচ্ছেন এক হাজার থেকে দেড় হাজার ডলার।
তার মানে সরকার কোয়ারেন্টিনের জন্য জনপ্রতি ১৪ দিনে ন্যূনতম ১৪ হাজার ডলার খরচ করছে। এই মুহূর্তে পাঁচ হাজারেরও বেশি নাগরিক বিদেশ থেকে ফিরে কোয়ারেন্টিনে আছে। যদিও কোয়ারেন্টিনের মেয়াদ ১৪ দিন থেকে বাড়িয়ে ২১ দিন করা হয়েছে। সরকারের খরচ আরও বেড়েছে। কারণ, কোয়ারেন্টিনের ১৪তম দিনে দুই জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও তার দুই ছেলে আলাদা আলাদা রুমে কোয়ারেন্টিনে আছেন। কর্মরত বিদেশি নাগরিক ও তাদের পরিবারের কোয়ারেন্টিনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব ভুটান সরকারের।’
নিশ্চয় ভূটানের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা চলে না। ভুটানে বিদেশ থেকে ফিরেছে পাঁচ হাজার, আমাদের ফিরেছে পাঁচ-সাত লাখ। আমরা বলেছি, ‘প্রবাসীরা দেশে ফিরে নবাবজাদা হয়ে যায়। তারা ফাইভ স্টার হোটেলে থাকতে চায়।’ আর ভুটান তার নাগরিকদের ফাইভস্টার হোটেলে রেখেছে।
সংখ্যায় কম, এটাই কী একমাত্র কারণ? না, দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থাপনার দিকটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ? ভেবে দেখার সুযোগ আছে।
ভুটানে করোনা শনাক্তের পরীক্ষা, কিট, পিপিই’র অবস্থা কেমন? কতোগুলো হাসপাতালে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে?
ডা. রনি বললেন, ‘ভুটানে কোনো বেসরকারি হাসপাতাল নেই, সবই সরকারি হাসপাতাল। জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে ভুটান পুরোদমে করোনা প্রস্তুতি শুরু করেছে। টেস্টিং কিট বা ডাক্তারদের পিপিই’র কোনো সংকট নেই। বিমানবন্দর ও স্থলবন্দর দিয়ে আসা সব যাত্রীর স্ক্রিনিং ও ডাটা সংরক্ষণ করেছে। কে, কোথায় থাকছে, তা ট্র্যাক করেছে। যে কারণে শুরুতেই ভুটান করোনাভাইরাস আক্রান্ত শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পেরেছে। আমি বাংলাদেশের সোহরাওয়ার্দী, হৃদরোগ ইনন্সিটিউটসহ বড় বড় হাসপাতাল ও জেলা-উপজেলা শহরের হাসপাতালে কাজ করেছি। কিন্তু, ভুটানের করোনা প্রস্তুতি আমাকে মুগ্ধ করেছে। বিশেষ প্রয়োজনে বিশেষ অনুমতি ছাড়া এক শহর থেকে আরেক শহরে যাওয়ার সুযোগ নেই। সম্পূর্ণ লকডাউন।’
‘কোয়ারেন্টিনে যারা আছেন তাদের কোনো অপারেশন প্রয়োজন হলে, কীভাবে অপারেশন হবে— কোথায় হবে, অপারেশনের পরে যদি দেখা যায় যে ওই রোগী করোনা পজিটিভ, চিকিৎসা প্রদানকারী ডাক্তাররা কী করবে, নার্সরা কী করবে, তাদের থাকার কী ব্যবস্থা হবে, সবকিছু এখনই প্ল্যান করে রেখেছে ভুটান।’
এটা হয়ত থিম্পুর চিত্র। বাইরের জেলার মানুষের জন্যে চিকিৎসা ব্যবস্থা কেমন, কোনো ধারণা আছে?
ডা. রনি বললেন, ‘নিজের আগ্রহ থেকেই জেলা বা গ্রাম পর্যায়ের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি। যেমন, ভুটানের একটি জেলার নাম ট্রাসিগাও। এই জেলার লোকসংখ্যা সাড়ে তিন হাজার। এই সাড়ে তিন হাজার মানুষের জন্যে করোনা পরীক্ষাসহ সব আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন ২০ শয্যার একটি হাসপাতাল আছে। এই হাসপাতালে বাংলাদেশি ডাক্তার আছেন দুই জন। ২০ শয্যার হাসপাতালেও সর্বাধুনিক সিটি স্ক্যান মেশিন আছে। অপারেশন থিয়েটারে স্কেভেনজিং সিস্টেম আছে। যা বাংলাদেশের অনেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেই। প্রতিটি অপারেশন থিয়েটারে ভেন্টিলেটর আছে।’
ভুটানে কোনো মেডিকেল কলেজ নেই। তাদের শিক্ষার্থীরা ভারত, বাংলাদেশ, আমেরিকা, ইউরোপ থেকে পড়ে দেশে ফিরে যান। যেভাবে গেছেন প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং। ভুটানের হাসপাতালগুলোতে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, মিয়ানমারের ডাক্তাররা কাজ করেন। তবে বিদেশি ডাক্তার ২০ শতাংশের বেশি নয়। ৮০ শতাংশ ভুটানি ডাক্তাররাই তাদের চিকিৎসাখাতের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ভুটানে তাহলে মেডিকেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি কেন?
ডা. রনির পর্যবেক্ষণ, ‘না, এমবিবিএস নেই। তবে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আছে, পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন হয়। নার্সিং শিক্ষায় ভুটান বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে। বলা হয়ে থাকে ভুটানি নার্সদের স্ট্যান্ডার্ড ইউরোপের সঙ্গে তুলনীয়। কাজ করতে গিয়ে তার প্রমাণও পাচ্ছি। ধারণা করছি, লোটে শেরিংয়ের ভুটান চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার দিকটিতে গুরুত্ব দিয়ে সামনে এগুচ্ছেন।’
যারা দেখেছেন তারা হয়ত একমত হবেন, ভূ-প্রকৃতিগত সৌন্দর্য ও মানুষ বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সুন্দর দেশ ভূটান। ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর দেশের প্রকৃতির সঙ্গে মিল আছে ভুটানের প্রকৃতির। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে বরফ আচ্ছাদিত ভুটানি জনপদে তাপমাত্রা মাইনাস ১০-১৫ ডিগ্রিতে নেমে আসে। যখন লিখছি ঢাকার তাপমাত্রা তখন ৩৭ ডিগ্রি, থিম্পুতে ১৩ ডিগ্রি। ইউরোপের সঙ্গে বেশ মিল। এই দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থায় খরচ বিষয়ে আলোচনা করছিলাম।
ডা. রনির অনেক তথ্যেই বিস্মিত হচ্ছিলাম। তবে সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হওয়ার তথ্যটি এখনও অজানা। ভুটানের নাগরিকরা সব রকমের চিকিৎসা পেয়ে থাকেন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। চিকিৎসাবাবদ নাগরিকদের কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয় না। করোনাভাইরাস পরীক্ষা, চিকিৎসা চলছে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। যেসব রোগীদের চিকিৎসা ভূটানে হয় না, সেসব রোগীদের ভারতে পাঠানো হলে সে খরচও সরকার বহন করে।
যেমন, ব্রেন টিউমারের মধ্যে শুধু মেনিনজিওমার চিকিৎসা হয় ভুটানে। এছাড়া অন্যদের চিকিৎসা রাষ্ট্রীয় খরচে ভারত থেকে করিয়ে আনা হয়।
শুধু ভারত থেকে চিকিৎসা করিয়ে আনার দিকেই ভুটানের মনোযোগ সীমিত নয়। নিজেদের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ক্রমেই স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তুলছে। এজন্যে তারা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিয়ে আসছে বিভিন্ন দেশ থেকে। সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে একজন নেফ্রোলজিস্ট নিয়ে গেছে। থিম্পুতে গড়ে তুলছে আধুনিকতম ৩০ শয্যার কিডনি ডায়ালাসিস সেন্টার। ডা. রনি বলছিলেন, ‘এটা এতটাই আধুনিক যে, বলা যায় নেফ্রোলজিক্যাল আইসিইউ।’
কয়েকদিন আগে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর করোনাবিষয়ক ব্রিফিং শুনছিলাম। ট্রুডো বলছিলেন, ‘কোথায় কী এবং কত পরিমাণ মেডিকেল সরঞ্জাম লাগবে, সেই সিদ্ধান্ত আমরা রাজনীতিবিদরা নেই না। সিদ্ধান্ত নেন ডাক্তাররা। আমরা সংগ্রহ এবং পৌঁছানোর বিষয়টি নিশ্চিত করি।’
প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং একজন ডাক্তার, সার্জন। ময়মনসিংহ মেডিকেল থেকে পাস করে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেলে ডাক্তারি করেছেন কয়েক বছর। ২০০২ সালে ভুটানে ফিরে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে সার্জন হিসেবে কাজ করতে থাকেন। কয়েক বছর পর ভুটানের চিকিৎসা ব্যবস্থায় পরিবর্তনের মানসিকতায় বন্ধু ডা. টান্ডি দর্জির গড়া রাজনৈতিক দলে যোগ দেন, সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে। ২০১৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেন, কিন্তু তাদের দল পরাজিত হয়। তারপর চিকিৎসা ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দিয়ে ‘ডোর টু ডোর’ প্রচারণা শুরু করেন। বিজয়ী হন ২০১৮ সালের নির্বাচনে। যোগ্যতা বিবেচনায় নিয়ে লোটে শেরিংকে প্রধানমন্ত্রী করে দলের প্রতিষ্ঠাতা টান্ডি দর্জি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন। লোটে শেরিং-টান্ডি দর্জি সরকারের হাত ধরেই ভুটানের চিকিৎসা ব্যবস্থা পৌঁছায় জনগণের দুয়ারে। প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং এখনও নিয়ম করে হাসপাতালে যান, অপারেশন করেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভুটানের চিকিৎসা ব্যবস্থার তুলনা করা যাবে না। ভুটান ছোট দেশ, মানুষ আট লাখ। বাংলাদেশে মানুষ ১৬-১৭ কোটি। ভুটানের মাথাপিছু আয় প্রায় ৩ হাজার ২০০ ডলার, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় প্রায় ২ হাজার ডলার। ভুটানের তুলনায় বাংলাদেশের ডাক্তার সংখ্যা, চিকিৎসা অবকাঠামো বিপুল। কিন্তু, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার পুরোটাই আমলা এবং রাজনীতিবিদদের হাতে। অল্প কিছু সংখ্যক চিকিৎসক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারাও রাজনীতিবিদ-আমলাদের চেয়ে আলাদা কিছু নন। ফলে ছোট-বড় বা কম-বেশির বিষয় নয়। বিষয় হলো জনকল্যাণ ও দুর্নীতিমুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। একজন লোটে শেরিং যার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।