করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সারা দেশের ন্যায় সিলেটেও বন্ধ রয়েছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। যার ফলে চরম বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষজন। এই মানুষদের বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে সহযোগিতা করতে সিলেটের সরকারি, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এগিয়ে আসলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা নেই জনগণের পাশে। গরীব মানুষদের ত্রাণ বিতরণের মত কার্যক্রমে নেই সিলেটের এমপি, মন্ত্রী, মেয়র ও কাউন্সিলররা। জনপ্রতিনিধিদের এমন আচরণে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষেরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দিয়েছেন- যেভাবে ভোট চাইতে জনগণের দরজায় গিয়েছিলেন, এখন সেভাবে খাবার নিয়ে মানুষের দরজায় যান।
প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনা সত্ত্বেও সিলেটের ৬টি সাংসদের মধ্যে একমাত্র সিলেট-৩ আসনের সাংসদ মাহমুদ-উস সামাদ কয়েস ছাড়া আর কেউই এলাকায় নেই। সিলেট সিটি মেয়র নিজ এলাকায় জীবাণুনাশক ছিটানোসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালালেও অসহায়দের মধ্যে খাবার সরবরাহের কোনো কার্যক্রম চালাতে এখনও দেখা যায়নি। সিসিকের দু’একজন কাউন্সিলর ছাড়া অন্য কাউন্সিলররাও নেই দুস্থদের পাশে।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় গত ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশের ন্যায় সিলেটেও গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করা রয়েছে। ২৪ মার্চ দেশের সব রুটে অনির্দিষ্টকালের জন্য যাত্রীবাহী রেল চলাচল, যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গত ১৬ মার্চ থেকে দেশের সব স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রমও বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতে দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষজনের মধ্যে আর্থিক অসচ্ছলতা চরম আকার ধারণ করেছে। অনেকেই রিকশা, ভ্যান নিয়ে বের হলেও ১ কেজি চালের দাম নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারছেন না।
এই পরিস্থিতিতে সরকারি, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের বিতরণ করা ত্রাণ অপ্রতুল। তাই এই সময়ে প্রয়োজন ছিল স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তা। এই সংকট মুহূর্তে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এই আচরণে ক্ষুব্ধ নাগরিকরা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এখানকার জনপ্রতিনিধি যারা তাদের আমরা জনপ্রতিনিধি হতে বলিনি। তারা নিজেরাই জনগণের সেবা করার জন্য নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। এখন যখন জনগণের সেবা দরকার তখন তারা ঘরে বসে রয়েছেন।
ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমাদের যারা জনপ্রতিনিধি আছেন তারা প্রত্যেকেই আর্থিকভাবে অনেক সচ্ছল। তারা চাইলে ব্যক্তিগতভাবে ৪০/ ৫০ লাখ টাকা খরচ করে মানুষজনকে ত্রাণ দিয়ে সহযোগিতা করতে পারেন। এটাও যদি না পারেন তাহলে দেশের অন্যান্য শ্রেণি পেশার মানুষদের কাছ থেকে তারা শিখতে পারেন কিভাবে বিপদের সময়ে মানুষদের সহায়তা করতে হয়। প্রতিদিনই বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ তাদের ১৫ দিনের বেতন, ১ মাসের বেতন দিয়ে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের সাহায্য করছেন। জনপ্রতিনিধিরাও পারতেন তাদের ১ বছরের বেতন থেকে মানুষদের সাহায্য করতে। কিন্তু না তারা কিছুই করছেন না। তারা ঘরে বসে রয়েছেন আর গরিব মানুষ অনাহারে দিনযাপন করছেন।
জানা যায়, সিলেট-১ আসনের সাংসদ ড. একে আব্দুল মোমেন দরিদ্র মানুষদের মধ্যে কিছু খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করছেন। সিলেট-৬ আসনের সাংসদ সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ফেসবুকে এক বার্তার মাধ্যমে এলাকার জনগণকে সাবধানে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে এলাকায় আসেননি তিনি। সিলেটের সংসদ সদস্যদের মধ্যে কেবল সিলেট-৩ আসনের সাংসদ মাহমুদ-উস-সামাদ কয়েস এলাকায় রয়েছেন। বাকীরা নিজ নির্বাচনী এলাকায় নেই।
এ ব্যাপারে সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী বলেন, ১০দিন ধরে আমি এলাকায় আছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন- যেভাবে ভোট চাইতে জনগণের দুয়ারে গিয়েছিলেন এখন সেভাবে খাবার নিয়ে জনগণের দুয়ারে যান। আমি প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশ পালন করছি।
কয়েস বলেন, প্রশাসনের কর্মকর্তারা যদি মাঠে নেমে কাজ করতে পারেন, আমরা জনপ্রতিনিধিরা কেন পারবো না? শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে এখন সকল জনপ্রতিনিধিকে মানুষের পাশে থাকা উচিত। অসহায় মানুষদের সাধ্যমত সাহায্য করা উচিত। তিনি নিজের পক্ষ থেকে ও নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সাহায্য করে যাচ্ছেন বলে জানান সাংসদ কয়েস।
সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা। তবে নগরীর দরিদ্র মানুষদের অনেকেই সরকারী সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র কাউন্সিলররাও নেই অসহায় মানুষদের পাশে। সিটি মেয়রের পক্ষ থেকে খাদ্য ফান্ড গঠনের উদ্যোগের কথা জানালেও এখন পর্যন্ত নগরীর দরিদ্রদের মধ্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণের আনুষ্ঠানিক কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
এ ব্যাপারে সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কল ধরেননি। তবে এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের ৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. ইলিয়াছুর রহমান বলেন, সিলেট সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে জনগণকে ত্রাণ দেওয়া হবে। আমরা সকল কাউন্সিলর ও মেয়র মিলে ত্রাণ বিতরণের জন্য ফান্ড সংগ্রহ করেছি। আমরা নিজেদের ব্যক্তিগত তহবিল, সরকারি তহবিল ও বিভিন্ন মানুষজনের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করেছি। শিগ্রই দরিদ্র মানুষকে আমরা ত্রাণ পৌঁছে দিব।
এ ব্যাপারে সিলেট সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ বলেন, আমাদের প্রতিদিনই মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করতে হচ্ছে। প্রতিদিন বাসায়ও চলে আসে অনেকে। তাদের কাউকেই খালি হাতে ফেরানো যায় না। তবে ঘটা করে অর্থ বা খাদ্যসামগ্রী বিতরণের মতো সামর্থ্য আমাদের নেই। সরকার ছাড়া আসলে এমন সামর্থ্য কারোই নাই।
সিলেট-২ আসনের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেন, আমি নিজেও অসুস্থ ছিলাম। তবু এলাকার খোঁজখবর নিচ্ছি। মঙ্গলবার থেকে আমি ও আমার পরিবারের পক্ষ থেকে এলাকার অসহায় মানুষদের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ শুরু করবো।