ভোরের আলো রিপোর্ট: যশোরে তিন বয়স্ক নাগরিকের সঙ্গে দুর্ব্যবহারকারী সহকারী কমিশনার সাইয়েমা হাসানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে৷ খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে৷ এই আচরণের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছেন জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন৷
শুক্রবার যশোরের মনিরামপুরে তিন বয়স্ক নাগরিককে মাস্ক না পরায় কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখেন সহকারী কমিশনার সাইয়েমা হাসান৷ রাতে এই ছবি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে৷ জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, মণিরামপুরের ইউএনওকে (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) ঐ তিন ব্যক্তির বাড়ি যেতে এবং তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশের নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ পাশাপাশি তাদের কোন ধরনের সহযোগিতা লাগলে তাও করা হবে৷
এই ঘটনায় যশোরের ডিসিকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ রিপোর্ট পেলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷
শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘‘আমরা খুবই দুঃখিত৷ এই ঘটনায় আমরা অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছি৷ আমরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করা তিন হাজার কর্মকর্তাকে কঠোর বার্তা দিয়েছি, কোনভাবেই অকর্মকর্তাসুলভ আচরণ করা যাবে না৷ মানুষকে বুঝিয়ে ঘরে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে৷ তবে যারা হোম কোয়ারান্টিন বা আইসোলেশনে আছেন, তাদের ব্যাপারে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলেছি৷ প্রয়োজনে ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে তাদের সাজার ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়েছে৷ তবে তাদের মানবিক থাকতে হবে৷’’
কী ঘটেছিল
জানা গেছে, মণিরামপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসানের নেতৃত্বে শুক্রবার বিকেল থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়৷ বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে চিনাটোলা বাজারে অভিযানের সময় তাদের সামনে পড়েন প্রথমে দুই বৃদ্ধ৷ এর মধ্যে একজন বাইসাইকেল চালিয়ে আসছিলেন৷ অপরজন রাস্তার পাশে বসে সবজি বিক্রি করছিলেন৷ তাদের মুখে মাস্ক ছিল না৷ এ সময় পুলিশ ওই দুই বৃদ্ধকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে হাজির করলে সাইয়েমা হাসান শাস্তি হিসেবে তাদের কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন৷ শুধু তাই নয়, এ সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিজেই তার মোবাইল ফোনে এ চিত্র ধারণ করেন৷ এছাড়া পরবর্তীতে অপর এক ভ্যানচালককে অনুরূপভাবে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন এবং ছবি তোলেন৷
শুক্রবার বিকেল থেকে ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে৷ ব্যাপকভাবে সমালোচনা শুরু হয়৷ সেই ছবি মনিরামপুরের সরকারি ওয়েবসাইটের ‘ব্যানার হেডে’ও দীর্ঘক্ষণ ছিল৷ তবে যশোরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন ওয়েবসাইট হ্যাক করে কেউ ছবিটি সেখানে আপলোড করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘হ্যাকার গ্রুপ যে ছবি আপলোড করেছিল, সেটা ইতোমধ্যে সরানো হয়েছে৷ আমি মনিরামপুরের ইউএনওকে ওই বৃদ্ধদের বাড়ি পাঠিয়ে সরি বলতে বলেছি৷ তাদের সহযোগিতা করা হবে৷’’
মাস্ক পরা বা না পরা
শুধু এই ঘটনা নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাস্ক ব্যবহার না করার কারণে পুলিশ সদস্যদেরও দেখা যাচ্ছে সাধারণ মানুষকে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতে৷ অনেক জায়গায় মানুষকে বেধড়ক পিটানো হচ্ছে এমন ভিডিও ও ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে৷
তবে আইইডিসিআর থেকে আগে বলা হয়েছিল, সবার মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজন নেই৷ একই পরামর্শ দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও৷ তাদের ওয়েবসাইটে বলা আছে, সুস্থ্য ব্যক্তি তখনই মাস্ক পরতে পারেন যদি তিনি করোনা ভাইরাসের সন্দেহভাজন কোন রোগীর সংস্পর্শে আসেন৷ সেই সঙ্গে কারো হাঁচি, কাশি থাকলে অন্যদের মধ্যে যাতে সংক্রমণ না হয় তার জন্যে মাস্ক পরতে বলা হয়েছে৷
এই বিষয়ে সরকারের নীতি কি, জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন আমরা বলছি, যে কেউ ঘর থেকে বের হলে তাকে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে৷ কারণ এখানেও খুব অল্প পরিমান হলেও সামাজিক সংক্রমন হচ্ছে৷ তাই সবাইকে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে৷ তবে মানুষকে বুঝিয়ে মাস্ক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে৷’’
কর্মকর্তাদের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন
এর আগে কুড়িগ্রামের তিনজন কর্মকর্তা রাতের আঁধারে একজন সাংবাদিককে ঘরের দরোজা ভেঙে ডিসি অফিসে এনে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে শাস্তি দেন৷ অভিযোগ রয়েছে জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন এর নির্দেশ দিয়েছেন৷ এজন্য তাকে সেখান থেকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়৷ তার দুই সপ্তাহ না যেতেই ঘটলো যশোরের মনিরামপুরের ঘটনাটি৷ এতে প্রশাসন ক্যাডারদের প্রশিক্ষন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে৷
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘‘অবশ্যই প্রশিক্ষণ হয়৷ দেখেন তিন হাজার কর্মকর্তা মাঠ প্রশাসনে কাজ করছেন৷ সবারই একই প্রশিক্ষণ৷ কিন্তু সবার ব্যবহার এক না৷ কারণ তার পারিবারিক শিক্ষা, কোথায় পড়াশোনা করেছেন, এগুলোসহ অনেক বিষয় থাকে৷ যারা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে৷ কাউকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না৷’’
এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘‘কুড়িগ্রামে যেটা হয়েছে সেখানে প্রশাসন শিথিলতা দেখিয়েছে৷ আরডিসি নাজিম উদ্দিনকে সাসপেন্ড করা উচিৎ ছিল৷ ডিসি সুলতানা পারভীনকে শুধু প্রত্যাহার না, ওএসডি করতে হতো৷ আর মনিরামপুরের ঘটনায় তো আমি নিজেই প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি করেছি, এ কথা বলতে লজ্জা হচ্ছে৷ তাকে শুধু প্রত্যাহার করলে হবে না কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে৷’’