রুমিন ফারহানা
২০২০ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বস্তরে ৩৩ শতাংশ নারী রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে আরপিও সংশোধন করেছিল এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যে সময়ে এই আইন সংশোধন করা হয়, তখন রাজনৈতিক দলগুলোয় নারীর অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত সীমিত।
২০২০ সালে এসেও সে সংখ্যা যে খুব বেড়েছে, তেমনটি বলা যায় না। প্রতিবছরই নানা উপলক্ষ সামনে রেখে প্রায়ই কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় আমাকে। ১. সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোয় নারীর অংশগ্রহণ কতটা বেড়েছে?
২. নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য দলগুলোর পরিকল্পনা বা পদক্ষেপ কী? ৩. নারীরা কেন রাজনীতিতে আগ্রহী হচ্ছে না? ৪. নারীবান্ধব রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরিতে দলগুলো কতটা তৎপর?
৫. বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পদে নারী থাকার পরও দলের অন্যান্য পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ তেমন আশাব্যঞ্জক নয় কেন? ৬. নারীকে রাজনীতিতে আগ্রহী করে তুলতে দলগুলো নিজেরা কতটুকু আগ্রহী এবং প্রস্তুত?
৭. রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ এবং উন্নতি কি শুধু পরিবারতন্ত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল ৮. রাজনৈতিক দলগুলোয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে নারীর সংখ্যা এত কম কেন?
রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে আলোচনার আগে একটা বিষয় স্পষ্ট করা ভালো। রাজনীতি বর্তমানে এমন এক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে সৎ, যোগ্য, মেধাবী কোনো পুরুষই রাজনীতিতে নিজেকে যুক্ত করাকে কোনো পথ হিসেবে বিবেচনা করে না, সেখানে নারীবিদ্বেষী এক সমাজে দাঁড়িয়ে রাতারাতি নারীর অংশগ্রহণ আশানুরূপ অবস্থায় যাবে সেই চিন্তা বাস্তবতাবিবর্জিত।
দলগুলোর সর্বস্তরে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণের আলোচনায় সবাই যখন সংখ্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তখন একটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তা হল সংখ্যাধিক্য জরুরি সন্দেহ নেই; কিন্তু মানের ব্যাপারে আমরা ভাবছি কতটুকু?
একটু আগেই বলছিলাম, আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা এমন রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে পারিনি যেখানে একজন মেধাবী, যোগ্য, দেশপ্রেমিক এবং সৎ পুরুষ তার ভবিষ্যৎ দেখতে পায়।
সেখানে এত বৈরিতার মাঝে একজন নারীর রাজনৈতিক দলে যুক্ত হওয়া পরিবার, সমাজ সবদিক থেকেই অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। রাজনীতির পথ যে শুধু অনিশ্চিত তাই নয়, বাংলাদেশের মতো দেশে এর চেয়ে অনিরাপদ, ঝুঁকিপূর্ণ, পিচ্ছিল, কর্দমাক্ত, ঈর্ষা-বিদ্বেষ-পরশ্রীকাতরতা-প্রতিশোধপরায়ণতাপূর্ণ কোনো ক্ষেত্র আছে বলে আমার জানা নেই।
বাংলাদেশে প্রথমত, নারীর নিজের জীবন নিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা অত্যন্ত সীমিত। তারপরও যদি কোনো শিক্ষিত, যোগ্য নারী রাজনীতিতে জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন, সে ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার পরিবার। সেই সঙ্গে নারীবিদ্বেষী সমাজ আর রাষ্ট্রের বাধা তো আছেই।
কিছুদিন আগে পাপিয়াকে নিয়ে যে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে তাতে মূলত সম্রাট, জি কে শামীম, খালেদ এদের সঙ্গে মিলিয়ে দুর্নীতি, টাকা পাচার, টেন্ডারবাজি এ বিষয়গুলোই প্রাধান্য পেয়েছে।
যে বিষয়টি পাপিয়াকাণ্ডকে অন্য ঘটনাগুলোর চাইতে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে তা হল ফিল্মের ‘কাস্টিং কাউচে’র যে ধারণা তা রাজনীতিতেও জেঁকে বসছে। কয়েক বছর আগেও এ ধরনের কাণ্ড রাজনীতিতে অন্তত এভাবে বিস্তার লাভ করেনি।
মাঝে মাঝে ফেসবুকে কিছু নারীর আক্ষেপ শোনা যায়, যাদের পদ দেয়ার চুক্তিতে নেতারা ব্যবহার করেছেন, কিন্তু সেই পদ আর তাদের ভাগ্যে জোটেনি। অর্থাৎ ব্যবহৃত হতে তাদের আপত্তি নেই যদি পদ পাওয়া যায়।
১৯৪২ সাল থেকে রাজনীতির সঙ্গে আমাদের পরিবারের বাস। এ দীর্ঘ সময়ের বড় একটা অংশই আমার জন্মের অনেক আগের হলেও ভীষণরকম রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হিসেবে সেই সময়ের রাজনীতিকদের সম্পর্কে আমার একটা স্পষ্ট ধারণা আছে।
এ ছাড়াও আমার বেড়ে ওঠার সময়কালেও যাদের আমি দেখেছি তাদের সঙ্গেও দল-মত নির্বিশেষে আজকের বেশকিছু নারীনেত্রী-কর্মীর ন্যূনতম কোনো সাযুজ্য নেই। প্রতিটা পেশা বা ক্ষেত্রের একটা নিজস্ব চরিত্র আছে।
পেশা বা ক্ষেত্রের সেই চরিত্র অনুযায়ী তার ব্যক্তিত্ব, আচার-আচরণ, পোশাক, সাজ সবকিছুই নির্ধারিত হয় এবং হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। একজন পেশাদার অভিনেত্রী আর একজন পেশাদার ডাক্তার, শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার বা রাজনীতিবিদের গেটআপ কখনোই এক হয় না, হওয়া উচিতও না।
গালে, চোখে চড়া রং, মেকাপের ভারে পূর্ণ চোখ মেলাও দায়, বাঙালি বর্ণে সোনালি চুলের আজব বাহার, রিভিলিং পোশাক একজন অভিনেত্রীকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে, তার ভক্তকুল বাড়ায়।
কিন্তু নেত্রী আর অভিনেত্রী তো এক নন। এ ধরনের গেটআপ শুধু তাকেই ছোট করে না বরং দলের ইমেজ ক্ষুণ্ন করে, রাজনীতিতে নারীর অবস্থানকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। শিক্ষিত, যোগ্য একটি মেয়েকে রাজনীতিবিমুখ করে তোলে।
এ ধরনের মেয়ে যখন তেমন কোনো যোগ্যতার স্বাক্ষর না রেখেই ‘নেতা’দের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে দলের ভালো একটা অবস্থানে চলে যায় তখন পুরো বিষয়টিই প্রশ্নের মুখে পড়ে।
পাপিয়া ঘটনায় অনেক বিষয়ের সঙ্গে যে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে তা হল অর্থ, তেলবাজি, পেশিশক্তির সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতে পদ-পদবি পেতে যে জিনিসটি ম্যাজিকের মতো কাজ করে তা হল যৌনতা।
এসবকে কাজে লাগিয়েই পাপিয়া জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদটি বাগিয়ে নিয়েছিলেন। তার বয়ান মতে, তিনি ১০ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন এমপি হওয়ার স্বপ্নপূরণে। স্বপ্ন এবার পূরণ হয়নি, তাতে কী?
হয়তো পরের বার ২০ কোটি দিয়ে সংসদেও যেতেন তিনি। পাপিয়া নামটি বারবার উচ্চারিত হচ্ছে তার অর্থ এই নয় যে, সেই শুধু এ ধরনের কাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল। পাপিয়া আসলে একটি শ্রেণিকে প্রতিনিধিত্ব করেন যে শ্রেণির আকার রাজনীতিতে বাড়ছে প্রতিদিন।
এদের শিক্ষা, মেধা, যোগ্যতা, সাংগঠনিক দক্ষতা, রাজনীতির জ্ঞান, প্রজ্ঞা না থাকলেও আছে লোভ, আকাশচুম্বী উচ্চাভিলাষ, আছে জিঘাংসা, আছে তীব্র ঈর্ষা আর পরশ্রীকাতরতা।
যোগ্যতায় বহু নিচে পড়ে থাকা এসব নারী বুদ্ধি-জ্ঞান-যোগ্যতা নিয়ে যেসব নারী রাজনীতিতে এগোনোর চেষ্টা করছে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার কথা ভাবতেও পারে না, তাই সবসময় চেষ্টা করে নিজে অথবা অন্য কাউকে দিয়ে যোগ্য নারীদের ‘ফাউল করে’ দমিয়ে রাখতে। এদের বিস্তার শুধু জেলা পর্যায় বা তৃণমূলে নয়, এদের ব্যাপ্তি বহুদূর পর্যন্ত।
পাপিয়া সমাজের প্রান্তিক শ্রেণি থেকে উঠে আসা একজন যে, ঢাকার এক পাঁচ তারকা হোটেল বেছে নিয়েছিল প্রভাবশালীদের মনোরঞ্জনের জন্য।
রাজনীতিতে পাপিয়ার মতোই উচ্চাভিলাষী অথচ মেধা বা যোগ্যতাহীন কেউ কেউ তার বাড়িটিকেই বানিয়েছেন পাঁচ তারকা হোটেল। সেখানে আছে আলাদা মদের বার, মনোরঞ্জনের সুব্যবস্থা। বড় নেতা, আমলা, স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী কে নেই তাদের অতিথিদের তালিকায়?
একজন নারী যখন রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন এই দেশের রাজনীতির মাঠের যে বীভৎসতা আছে, তার সবকিছু তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। নারী, একজন পুরুষের মতোই সেই বিপদগুলোয় পড়ে, মোকাবেলা করে, করতে হয়।
আবার একটা চরম পুরুষতান্ত্রিক এবং নারীবিদ্বেষী সমাজ মুখিয়ে থাকে রাজনীতিতে নেমে পড়া এবং নামতে চাওয়া নারীদের চলার পথে নানা রকম বাধা তৈরি করতে। এসব মানুষের হাতেই এক ভয়ংকর অস্ত্র তুলে দিচ্ছে ‘পাপিয়া’রা।
স্টেরিওটাইপিং ভালো বিষয় নয় মোটেও, কারণ এটা সব মানুষের ওপর শ্রেণির কিছু বৈশিষ্ট্য আরোপ করে যেটা আসলে অনেকেরই নেই। কিন্তু স্টেরিওটাইপিং এ দেশের মানুষের সহজাত প্রবণতা। আর এটা যদি কোনো ক্ষেত্রে কারও অন্যায় সুবিধা তৈরি করে তাহলে সেটা মানুষ লুফে নেয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘পাপিয়া’দের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, সন্দেহ নেই; কিন্তু রাজনীতিতে অনেক নারী এখনও নিজের মেধা, যোগ্যতা পরিশ্রম দিয়ে তার জায়গা করে নিতে চায়।
সমাজের নারীবিদ্বেষী মানুষ এই নারীদের গায়েও ‘পাপিয়া’দের কালিমা লেপনের চেষ্টা করবে, যেটা রাজনীতিতে নতুন নারীদের ভীত করে তুলবে।
রাজনীতির আর সব কষ্ট, ঝুঁকি মোকাবেলা করা একজন নারীর জন্য খুবই কষ্টকর সন্দেহ নেই; কিন্তু চরিত্রের ওপর এ অপবাদ অগ্রাহ্য করে এ সমাজের ক’জন নারী পারবে রাজনীতিতে আসতে?
ওদিকে ‘পাপিয়া’দের মতো যেসব নারী টাকা খরচের পাশাপাশি পাঁচ তারকা হোটেলে, কিংবা বাসায় প্রমোদখানা খুলে দলের উঁচু পদধারী, বুদ্ধিজীবী এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রভাবশালীকে মনোরঞ্জন করে পদ-পদবি বাগানোর চেষ্টা করে সফল হয়, তাদের সঙ্গে পেরে উঠবে না যারা এই চেষ্টায় নামবে না।
দলের উঁচু পদধারী আর তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী কারও কাছে যদি ‘মনোরঞ্জন’ খুব গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা হয়ে থাকে, তাহলে যারা সেই চেষ্টায় যাবে না তাদের ভবিষ্যৎ কেমন হবে সেটা না বোঝার কোনো কারণ নেই।
রাজনীতিতে ‘পাপিয়া’দের উত্থান আরেকটা বড় বিপদ তৈরি করছে। এদের অনেকের সাফল্য সমাজের আরও অনেক সম্ভাবনাময় ‘পাপিয়া’কে পথ দেখাবে।
জ্ঞান-বুদ্ধি, যোগ্যতা, পরিশ্রম ছাড়া ‘বিশেষ ব্যবস্থায়’ রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এ নারীরা নারী রাজনীতিকের সংখ্যাই বাড়াবে শুধু। শুরুতে এ কারণেই বলেছিলাম সংখ্যা বৃদ্ধির আলোচনার মধ্যে আমার মনে সবসময় প্রশ্ন আসে মান নিয়ে।
গত কয়েক বছর ক্ষমতাসীনদের দেখে এ প্রজন্মের যে কারও ধারণা হতে পারে কোনো রকমে রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে অন্যায়ভাবে টাকা বানানো মানেই রাজনীতি। জনগণ দেখছে এ পথে লক্ষ্য অর্জনের জন্য করা হচ্ছে যা ইচ্ছে তা।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে রাজনীতিকে ধীরে ধীরে ‘পাপিয়া’দের কব্জায় দিয়ে দেয়া হবে, নাকি রাজনীতিতে মেরিটোক্রেসি পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু করা হবে।
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা : সংসদ সদস্য; আন্তর্জাতিকবিষয়ক সহ-সম্পাদক, বিএনপি