সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজকে সিংহাসনচ্যুত করার পরিকল্পনা নিয়েছেন তারই ছেলে বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস)। বাবাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিংহাসনে বসতেই তার এই পরিকল্পনা। এ জন্য রাজপরিবারে যাদেরই প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছেন, তাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছেন দেশটির সিংহাসনের উত্তরসূরি মোহাম্মদ বিন সালমান। আগামী নভেম্বরে রিয়াদে জি২০ সম্মেলনের আগেই সিংহাসনে আরোহণ করতে পারেন তিনি। সেই ভাবনা থেকেই নতুন করে এই ধরপাকড় অভিযান।
পাশ্চাত্যে এমবিএস নামে পরিচিত মোহাম্মদ বিন সালমান তার বাবা বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন না। কারণ বাবার উপস্থিতি সন্তান হিসেবে সিংহাসনে বসতে তার জন্য বৈধতা তৈরি করবে। কাজেই নভেম্বরের সম্মেলনকে বাদশাহ হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে চাচ্ছেন যুবরাজ। সূত্র বলছে, বাবাকে সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য করতেও পারেন তিনি। ৮৪ বছর বয়সী বাদশাহ সালমান বর্তমানে স্মৃতিভ্রষ্টতায় ভুগলেও তার স্বাস্থ্য ভালো আছে।
প্রিন্স মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সিংহাসনের উত্তরসূরি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে এই প্রক্রিয়া শুরু করেন তিনি। আর বাবাকে সিংহাসনচ্যুত করার মধ্য দিয়ে সেটা শেষ হতে পারে। সূত্র বলছে, বাবা থাকা অবস্থায়ই তিনি বাদশাহ হয়েছেন, এমনটা নিশ্চিত করতে চান। এমবিএসের প্রকল্পে যোগ দিতে বাদশাহ সালমানের ছোট ভাই আহমেদকে সর্বশেষ একটি সুযোগ দেয়া হয়েছিল। কারণ এমবিএসের সিংহাসনে বসার ক্ষেত্রে কয়েক বছর ধরেই তিনি বিরোধিতা করে আসছেন।
দ্বিতীয় একটি সূত্র জানায়, এমবিএসকে পূর্ণ সমর্থন দিতে আহমেদের ওপর চাপ ছিল। কোর্টে বাদশাহ সালমান ও অন্যদের সাথে তিনি দেখা করেছেন। সন্তানকে সমর্থন দিতে ভাইকে উদ্বুদ্ধ করেন সালমান। কিন্তু আহমেদ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে এই প্রকল্পে তার কোনো সমর্থন নেই। তিনি কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি। এ ছাড়াও নিজেও বাদশাহ হতে আগ্রহী নন বলে বড় ভাই সালমানকে জানিয়েছেন আহমেদ। অন্য কেউ সামনে চলে আসুক, সেটি তিনি চান। আহমদকে আটকের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ্যে আসছে। গত শুক্রবার তাকে যখন গ্রেফতার করা হয়, তখন তিনি অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেননি। যদিও সৌদি আরবে তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনা হয়েছে বলে জানা গেছে । তাকে গ্রেফতারের কোনো ক্ষমতা এমবিএসের নেই। কাজেই ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেই তাকে গ্রেফতারের ন্যায্যতা তৈরি করা হয়েছে।
ভাতিজার সিংহাসনে বসার ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে আপত্তি জানান আহমদ। তিনি হাইয়াতুল বাইয়ার বা আনুগত্য পরিষদের সদস্য। বাদশাহর মৃত্যুর পরে কে সিংহাসনে বসবেন, সেই প্রশ্ন প্রথমে এই পরিষদে উঠবে। এমবিএসের বাদশাহ হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ‘না’ বলে দিয়েছেন। কিন্তু অভ্যুত্থান চেষ্টা তিনি করেননি। যদিও এমবিএসের সিংহাসনে আরোহণে ক্ষেত্রে এই পরিষদকেই অনুমোদন দিতে হবে। বিদেশে অবকাশ শেষে ফিরে এসে গত বৃহস্পতিবার রাতে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে একটি অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন আহমেদ। তখন শুক্রবার সকালে বাদশাহ তার সাথে দেখা করতে চান বলে তার কাছে একটি বার্তা আসে।
এ ঘটনায় প্রিন্স ফয়সাল বিন আবদুর রহমানকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ আগে তার বিষয়টি তিনি বাদশাহর কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। শুক্রবার সকালে নিজের নিরাপত্তা কর্মীদের সাথে নিয়ে রাজপ্রাসাদে যান তিনি। বাদশাহর কম্পাউন্ডে ঢোকার পরেই তাকে আটক করা হয়। আনুগত্য পরিষদের আরেক সদস্য বলেন, বাদশাহকে দেখারও সুযোগ হয়নি তার। এটা সম্পূর্ণ বিশ্বাসঘাতকতা। ঘরোয়া ও অভ্যন্তরীণ কারণেই এখন এই ধরপাকড় শুরু হয়েছে। সূত্র জানায়, মার্কিন প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়া নিয়ে এমবিএসের উদ্বেগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটদলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থীরা যুবরাজের সমালোচনা করে আসছেন। ২০১৮ সালে ইস্তানম্বুলে সৌদি কনসুলেটে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নির্দেশদাতা আখ্যায়িত করে প্রকাশ্যে যুবরাজের নিন্দা জানিয়েছেন তারা। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডে যুবরাজকে দায়ী করতে বারবার অস্বীকার করে আসছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। জাতিসঙ্ঘ কিংবা এফবিআইয়ের তদন্তের আহ্বানও আটকে দিয়েছেন তারা।
এ দিকে কিছু সূত্র দাবি করেছে যে, আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ বা এমবিজেড, যিনি এমবিএসর দীক্ষাগুরু হিসেবে পরিচিত এবং যার কারণে এমবিএস ট্রাম্প শিবিরে ঘনিষ্ঠ হয়েছেন, তিনিও এই সাম্প্রতিক ধরপাকড়ে সম্পৃক্ত।
এমবিজেডের সাথে সম্পৃক্ত ব্লগার হামেদ আল-মাজরুয়ি ২০১৭ সালে রিটজ কার্লটন হোটেলে এমবিএসের হাতে সৌদি রাজ পরিবারের একাধিক সদস্য ও শ’ শ’ ব্যবসায়ী আটক হওয়ার খবর সর্বপ্রথমে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি এর আগে কাতারের সাথে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পর্ক বিচ্ছেদের খবরও সবার আগে প্রকাশ করেন। এবারের ধরপাকড় জনসম্মুখে আসার আগেই তিনি টুইটারে শুধু দুই শব্দে লিখেছেন : চেক মেট। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তিনি এ ব্যাপারে জানতেন।
একটি সূত্র বলেছে, ‘এমবিএস’র প্রত্যেকটি পদক্ষেপে কলকাঠি নাড়েন এমবিজেড। এমবিএস যত ভুল করেন, ততই অস্থিতিশীলতা শুরু হয়। আর ততই এমবিজেডের হাতে সৌদি ইস্যুতে ক্ষমতা বাড়ে।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ছাড়াও সম্প্রতি তেলের পড়তি দর, সংস্কার কার্যক্রমে ভাটা, করোনাভাইরাস আতঙ্কÑ সব মিলিয়ে এবারই পরিস্থিতি নিজের জন্য মোক্ষম মনে করেছেন এমবিএস।